২৬শে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে, লক্ষ লক্ষ কৃষক রাজধানী দিল্লী শহরের বুকে ট্র্যাক্টর নিয়ে ভারতের সামরিক বাহিনীর সমান্তরাল একটা প্যারেড করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারের কাছে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো জোরালো ভাবে তুলে ধরতে। তবে বিভিন্ন নীতিগত ও কৌশলগত পার্থক্যের কারণে সামগ্রিক ভাবে কৃষক সংগঠনগুলো এই প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড নিয়ে একমত হতে পারছেন না। দিল্লীর উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত সিংহু বর্ডারে গিয়ে জানতে চাইলাম যে আন্দোলনরত কৃষকেরা প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড নিয়ে কী ভাবছেন।
কৃষকেরা আর দিল্লী সীমান্তে থাকতে চাইছেন না
কৃষকদের বড় অংশটি আর সিংহু বর্ডার, টিকরি বর্ডার, প্রভৃতি সীমানায় আর বসে না থেকে দিল্লী শহরে প্রবেশ করতে চাইছে। তাঁরা দিল্লী শহরে অবস্থান করবেন বলেই দুই মাস আগে পাঞ্জাব আর হরিয়ানার গ্রামগুলোর থেকে বেরিয়েছিলেন। এর পরে তাঁদের সীমানায় অবস্থান করতে হয় আর দেখতে দেখতে, আলোচনার মরীচিকা ব্যবহার করে মোদী সরকার আর বিজেপি দুই মাস সময় নষ্ট করে। বিজেপি দলের রণনীতি হল এই কৃষকদের হতাশ করে গ্রামে ফেরত পাঠানো। তবে সেই আশা গুড়ে বালি কারণ কৃষকেরা আগের থেকেই জানতেন যে মোদী সরকার আর বিজেপি তাঁদের ক্লান্ত ও হতাশ করে আন্দোলন-বিমুখ করতে চায়। তাই তাঁরা গ্রামের থেকেই এক অভূতপূর্ব বন্দোবস্ত করে এসেছিলেন।
পাঞ্জাবের গ্রামগুলোর থেকে ২৫% করে কৃষকেরা এসেছেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের ক্ষেতের কাজ ও বাড়ির যে কোন প্রয়োজনের দ্বায়িত্ব নিয়েছে তাঁদের গ্রাম। এই ২৫% ফিরলে একটি নতুন দল আসবে আর যাঁরা ফিরবেন তাঁরা এবার যাঁরা আন্দোলনে যোগ দেবেন, তাঁদের ক্ষেতের আর পরিবারের দেখাশুনা করবেন। এর ফলে আন্দোলনটি কোন সংগঠনের নিজস্ব আন্দোলন না থেকে সমগ্র পাঞ্জাবের মানুষের, তাঁদের গ্রামগুলোর নিজেকে রক্ষা করার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আন্দোলনটি সবার আন্দোলন হয়ে উঠেছে যা কে হারাবার ক্ষমতা বিজেপি-র নেই। ফলে কৃষকদের বাড়ি ফেরার উৎকণ্ঠা নেই।
ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন (ক্রান্তিকারী) রাজ্য সভাপতি সুরজিৎ সিংহ ফুল জানালেন যে পাঞ্জাবের গড় আয়ু যেহেতু ৬০-৬৫ বছর, তাই বহু প্রৌঢ় কৃষকরা এসেছেন এই আন্দোলনে বাড়ি না ফেরার চেতনা নিয়ে। তাঁরা নিজেদের জীবন একটি মহৎ কারণে উৎসর্গ করে দিতে চান। তাঁদের কোন ভয়ও নেই। তাই দিল্লী শহরে প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে ঢুকতে তাঁরা উৎসাহী। অন্যদিকে যাঁরা যুব, তাঁরাও বাড়ি ফিরতে না, দিল্লী জয় করতে চান। তাই বিজেপি যতই চাইতে থাক, কৃষকদের কোন পিছনে ফেরার বা পালাবার ইচ্ছা নেই।
তাই প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে কৃষকেরা কী করতে চাইছেন? একদিকে সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ নেতৃত্ব চাইছে শান্তিপূর্ণ ভাবে কৃষকেরা ট্র্যাক্টর করে দিল্লী শহরে ঢুকবেন ও তারপরে প্যারেড করে আবার সীমান্তে ফিরে আসবেন। যদিও বেশির ভাগ কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব এইরকম চাইছে, তবে অনেক সংগঠন ও ব্যাপক অংশের কৃষকদের ইচ্ছা হল যতটা সম্ভব দিল্লীর ভিতরে ঢুকে যাওয়া। তাঁরা বলছেন সীমান্তে বসে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা পাঞ্জাব থেকে আসেননি। এদের সাথে হরিয়ানার ব্যাপক কৃষকেরাও আছেন, যাঁরা চাইছেন দিল্লীর দখল নিয়ে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে আন্দোলন কে নিয়ে গিয়ে সরকার কে জোর করে এই আইন প্রত্যাহার করানো।
প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে দিল্লীর থেকে আবার ফিরে আসা হবে না ওখানেই অবস্থান করা হবে এই নিয়ে মোটামুটি দুটি ভিন্নমত দেখা গেলেও ব্যাপক কৃষকেরা নেতৃত্বের কাছে দাবি তুলছেন রেডিক্যাল দাবি তুলতে ও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে আন্দোলন গড়ে তুলতে। এই দাবির ফলে যেমন নেতৃত্ব বিপাকে পড়েছেন তেমনি মোদী সরকারেরও অবস্থা কাহিল।
আন্দোলন করতে না প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করতে ট্র্যাক্টর প্যারেড?
আর একটা বড় ইস্যু হল প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে কৃষকেরা কী করতে চাইছেন? তাঁরা কি প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করতে গ্রাম থেকে এসেছেন না তাঁরা চাইছেন তাঁদের আন্দোলনের জয়? শহরের বাইরে বাইরে তেরঙ্গা “জাতীয় পতাকা” উড়িয়ে ট্র্যাক্টরে করে ঘুরে, আবার সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে গেলে রাজনৈতিক ভাবে কী হাসিল হবে? এই নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ও একের সাথে অন্য সংগঠনের ভীষণ মতাদর্শগত বিভেদ দেখা যাচ্ছে। তবে এই প্রশ্নগুলোয় কৃষকদের মধ্যে শ্রেণী ঐক্য জোরদার হচ্ছে।
এই আন্দোলনে কৃষকদের বিভিন্ন শ্রেণী এসেছে। এদের মধ্যে মূল হল দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, পাঞ্জাবের হিসাবে যাঁদের মোট দুই একরের কম জমি আছে। ভূমিহীন কৃষক মানে যাঁরা এখানে ধনী কৃষক বা বড় বড় জোতদার-জমিদারদের থেকে জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন। আর ক্ষেত মজুর হচ্ছেন যাঁরা পারিশ্রমিকের জন্যে জোতদার বা ধনী কৃষকের জমিতে মেহনত করেন। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড এর সাথে ওই দিবস পালনের কোন সম্পর্ক নেই। তাঁদের অনেকেই “জাতীয় পতাকা” ছাড়া নিজেদের সংগঠনের পতাকা নিয়েই যেতে চান। তার কারণ তাঁদের কাছে এই ট্র্যাক্টর প্যারেড নিজেদের দাবি কে জোরালো ভাবে রাখার একটা সুযোগ আর দিল্লীর ভিতরে যাওয়ার একমাত্র সুযোগ।
অনেকদিন ধরে কৃষকেরা পরিকল্পনা করছিলেন বড় বড় রোলার আর জেসিবি মেশিন এনে সমস্ত বর্ডারে বানানো মোদী সরকারের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলবেন। কিন্তু কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব এখনো শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চাইছেন। অন্যদিকে, হান্নান মোল্লা-র মতন অখিল ভারত কৃষক সভা-র নেতারা, যাঁদের পাঞ্জাবের কৃষকদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই , তাঁরা বারবার জোর করছেন যাতে কৃষকেরা প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে ফিরে যান কারণ মোদী সরকার বিতর্কিত কৃষি আইন গুলো দেড় বছরের জন্যে স্থগিত করার কথা ঘোষণা করেছে। ফলে এই দুই শিবিরের, অর্থাৎ আপসকামী কিছু নেতা আর ব্যাপক কৃষকের দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এই প্যারেডের মাধ্যমে কৃষকদের সংগ্রাম কে নতুন স্তরে উন্নীত করার আর অন্যদিকে তাকে শেষ করার প্রচেষ্টাও চলবে।
কৃষকেরা প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে কর্পোরেটদের জায়গায় নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করতে চান
বিভিন্ন সংগঠনের, রাজ্যের ও শ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে যে পরিমাণ মোদী ও বিজেপি-বিরোধী ঘৃণা জেগে উঠেছে তা মিষ্টি কথার বুলি ছুটিয়ে, “মন কী বাত” শুনিয়ে মোদী কব্জা করতে পারবেন না। বিজেপি নেতারা আজ হরিয়ানা আর পাঞ্জাবে গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। অন্যদিকে মোদী ও বিজেপি নেতৃত্ব সেই সময়ে বড় বড় কর্পোরেটদের স্বার্থহানি করবে না বলে জানান দেওয়ায়, আইন বাতিল করবে না বলায় চরম ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা। জোর করে ট্র্যাক্টর নিয়ে তাঁরা প্যারেড করতে চান আর তাই তাঁরা মোদী বা তাঁর সঙ্গীদের সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানছেন না।
যখন মোদী সৈনিকদের সেলামি নেবেন ইন্ডিয়া গেটে, গৌতম আদানি আর মুকেশ আম্বানিদের প্রজাতন্ত্র কে রক্ষা করার শপথ নেবেন, ভারতবর্ষ কে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজির শোষণের আর লুন্ঠনের মৃগয়া ক্ষেত্র বানিয়ে রাখবেন বলে শপথ নেবেন, যখন বড় জোতদার-জমিদার, কর্পোরেট পুঁজি আর সামন্ততান্ত্রিক ফড়েদের স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকার করবেন, তখন প্রায় ১১-১২ লক্ষ কৃষকেরা প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে দিল্লী শহরের রাস্তা থেকে এই দেশের উপর নিজেদের প্রতিপত্তি, নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করবেন।
দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে ভারত রাষ্ট্র কৃষকদের হক মেরেছে। তাঁদের অধিকার খর্ব করে বৃহৎ জোতদার, জমিদার আর মুৎসুদ্দি-দুর্নীতিপরায়ণ পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। সেই জন্যে এই প্রজাতন্ত্র আদানি-আম্বানিদের প্রজাতন্ত্র হয়ে গেছে, টাটা আর বিড়লাদের প্রজাতন্ত্র হয়ে রয়েছে। এরই ফলে এই “প্রজাতন্ত্র” থেকে বিজেপি শক্তি সংগ্রহ করে ফ্যাসিবাদ কে শক্তিশালী করতে পারে। এই কারণেই এই প্রজাতন্ত্রে কৃষকদের অধিকার মার খায় বার বার, আদানি-আম্বানি আর কোক-পেপসির স্বার্থ রক্ষায়।
তাই কৃষকের প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড আসলে এক নতুন প্রজাতন্ত্রের অঙ্গীকার করছে। সীমানায় বসে মসনদের তামাশা দেখতে গররাজি পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকরা। তাই তাঁরা এগিয়ে যেতে চান। ডাকাতদের, বাটপাড়দের স্বর্গ ভূমি দিল্লী শহর কে, রক্তচোষা শাসকশ্রেণীর রাজধানী কে কাঁপিয়ে নিজের অধিকার যেমন আদায় করতে চান তাঁরা তেমনি তাঁরা বন্দোবস্ত করতে চান তাঁদের প্রজাতন্ত্রের। যে প্রজাতন্ত্র কৃষককে, শ্রমিককে প্রাধান্য দেবে, শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ কে শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেবে। তাই ট্র্যাক্টরের মাধ্যমেই তাঁরা যেমন জমির থেকে আগাছা উপড়ে ফেলেন তেমনিই তাঁদের দেশ থেকে যে তাঁরা শোষকদের আগাছা উপড়ে ফেলবেন তার বন্দোবস্ত করছেন। অতএব শাসক শ্রেণীর, মোদীর বা ভীতু নেতাদের নিয়মে ট্র্যাক্টর চলবে না, ট্র্যাক্টরের নিয়মে এবারে দেশ চালাবেন কৃষকেরা।