এক জন প্রৌঢ় সাধু’র সাথে একজন কমবয়সি সাধু এবং তাঁদের ড্রাইভারকে নৃশংস গণপিটুনির শিকার হতে দেখে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই আঁতকে উঠেছেন। কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হল যে নাগরিক আন্দোলনের প্রতিবাদী মুখেরা সাধুদের হত্যার নিন্দার বদলে, এই ঘটনা মুসলিমেরা ঘটায়নি সেটা প্রমাণ করতে বেশী সোচ্চার হলেন? বুদ্ধিজীবী বা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সেকুলারিজম নিয়ে প্রশ্ন তোলে গেরুয়া শিবির-ঘেঁষা বলে চিহ্নিত জি নিউজ, রিপাবলিক টিভি, ইত্যাদি, মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম। কে বা কারা আছে এই ঘটনার পেছনে এই নিয়ে একাধিক তত্ত্ব উঠে আসছে। আমরা বিভিন্ন স্তরে হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বক্তব্যগুলো এবং অন্যান্য সূত্রের খবরগুলোকে মিলিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবো।
গেরুয়া শিবিরের প্রিয় সংবাদ মাধ্যম জি নিউজ ডিএনএ এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের শুরুতেই তাঁরা দাবি করেছে ঘটনাস্থলে গিয়ে, তদন্ত করে, সমস্ত পক্ষের সাথে কথা বলেই তাঁরা এই “এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদনটি” তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদনে “ভিড়” কে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রামবাসীদের ভিড়। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, স্ক্রোল, ইত্যাদি সংবাদমাধ্যম আবার জি নিউজের মত শুধুমাত্র “ভিড়” বলে ছেড়ে দেয়নি। ভিড়ের পরিচয় তারা জানিয়েছে আদিবাসী বলে। গেরুয়াপন্থী হোক বা বিরোধী, এখনো পর্যন্ত কোনো মান্য সংবাদমাধ্যম কিন্তু এমন কথা একটিবারও বলেনি যেখান থেকে জানা যায় এই গণপিটুনির ঘটনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ জড়িত!
কিন্তু আমরা দেখলাম যে সংগঠিত ভাবে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) কর্মী আর সমর্থকেরা প্রচার করলো যে মুসলিমরা চক্রান্ত করে নাকি হিন্দু সাধুদের হত্যা করেছে। এই হত্যার প্রতিশোধের ডাক দেওয়া হল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ঘটনায় কোনো মুসলিম সংগঠন দোষী এই রকম তথ্য কোথা থেকে এলো সেটা কিন্তু অজানা রইলো।
দুই জন সাধুর হত্যায় যারা সব চেয়ে শোক স্তব্ধ তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই সবার আগে থাকবেন ঐ সাধুদের সাথে জুনা আখারায় যে সাধুরা থাকতেন তাঁরা। অথচ জুনা আখারা’র বিষ্ণুমিত্রানন্দ গিরি তাঁর ভিডিও বার্তায় মহারাষ্ট্র সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেছেন- সাধুদের শাস্ত্রের জ্ঞান যেমন আছে তেমনি তারা অস্ত্র চালাতেও জানে। আগামী ৩রা মে’র মধ্যে দোষীদের চৌরাস্তার উপর প্রকাশ্যে গুলি না করলে বা ফাঁসিতে না ঝোলালে সাধুরা রাস্তায় নেমে এমন তান্ডব চালাবে আর মোল্লা মৌলবীদের নাকি এমন “বাজানো” হবে, এমন অবস্থা করা হবে, যে তাঁদের দৌড়াতে দেখা যাবে। এই রকম বেশ কয়েক জন সাধু’র ভিডিও বার্তা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এবং “শিব তান্ডব” এর হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
যদিও বিজেপি কর্মীদের এত আয়োজনে জল ঢেলে দিয়েছে খোদ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। আরএসএস এর সাংগঠনিক মুখপত্র অর্গানাইজার এর ওয়েব ভার্সানে ২০ এপ্রিল সাধু হত্যা নিয়ে পরপর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রবন্ধে হামলাকারীদের শুধুমাত্র “গ্রামবাসী” বলা হয়েছে। অন্যটিতে সাধু হত্যার ঘটনায় সরাসরি খ্রীস্টান মিশনারী এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে সিপিআই(এম) বিধায়ক বিনোদ নিকোলে’র পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্তের ফলে এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। আরো লেখা হয়েছে ঐ অঞ্চলে খ্রীস্টান মিশনারীরা ধর্মান্তরিত করার কাজে সক্রিয় এবং গণপিটুনির ঘটনায় ধৃতদের হয়ে যে উকিল মামলা লড়ছেন তার সাথে খ্রীস্টান মিশনারীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফ থেকে ঐ অঞ্চলে বামপন্থী কার্যকলাপের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সাধু হত্যার ঘটনায় বামপন্থীদের হাত নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে তদন্তের দাবি করা হয়েছে।
অর্গানাইজার হল আরএসএস’র পুরানো পত্রিকা। অর্গানাইজারের মাধ্যমে ঠিক করে দেওয়া হয় সারা দেশ জুড়ে কর্মীরা কি বলবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গেল ইঞ্জিনের আগেই বগি ছুটতে শুরু করেছে। অর্গানাইজারে পরিচালক সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ হওয়ায় আগেই নিজদের বুদ্ধি অনুযায়ী বিজেপি’র কর্মীরা স্যোশাল মিডিয়ায় অতি সক্রিয় হয়ে দোষ চাপাতে শুরু করে দিয়েছে মুসলিমদের উপর। অন্যদিকে আরএসএস নেতৃত্ব নির্দিষ্ট ভাবে এই ঘটনা কে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সাংগঠনিক লাভ তুলতে চেয়েছে। আদিবাসী অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদীদের সাথে সংঘাত মূলত খ্রিস্টান মিশনারীদের। তাছারা আদিবাসী অঞ্চলে রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের প্রভাব আছে। মহারাষ্ট্র লাল পতাকা হাতে মুম্বাই অবরোধকারী “কিষান লঙ মার্চ” দেখেছে। পালঘরের পাশের বিধানসভা এলাকা ডাহানুতে সিপিআই(এম) প্রার্থী জিতেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কিন্তু শুধু সিপিআই(এম) নয় সামগ্রিক ভাবে অঞ্চলে বামপন্থী কার্যকলাপকে অভিযুক্ত করেছে।
প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যমই এটা বলেছে যে ঐ অঞ্চলে বাচ্চা চুরির গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। আউটলুক পত্রিকায় মুসলিম দের থুতু ছিটিয়ে করোনা ভাইরাস ছড়াবার গুজবের কথা’রও উল্লেখ আছে।
সাধু হত্যার আগে গুজবের উপর ভিত্তি করে আরো দুটি গণপিটুনির ঘটনা সেখানে ঘটে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু কেন সাধুরা হাইওয়ে না ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে সুরাত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? কী ভেবে? কার পরামর্শে? প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যম লিখেছে লকডাউনের সময় হাইওয়েতে পুলিশি হয়রানি এড়াতে তাঁরা ঐ পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের এই কথা কে বললেন তার কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া গেল না।
আউটলুক পত্রিকা’র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে সিপিআই(এম) নেতা অশোক ধাওলে বলেছেন পুলিশের খতিয়ে দেখা উচিৎ যে সাধুদের কাছে অফিশিয়াল পারমিট থাকার পরেও কেন মুম্বাই-সুরাট ন্যাশনাল হাইওয়ে না ধরে, ঘুরপথে প্রত্যন্ত এলাকা দিয়ে তাঁরা সুরাট যেতে চাইলেন?
মহারাষ্ট্র কংগ্রেস দাবি করেছে গড়চিঞ্চিলে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হলেন চিত্রা চৌধুরী। বিজেপি ঐ গ্রামে দশ বছর ধরে জিতে আসছে। কংগ্রেসের দাবি অনুযায়ী এই ঘটনায় ১০০ জনের বেশী গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের প্রায় প্রত্যেকেই বিজেপি কর্মী। অন্যদিকে বিজেপি নেত্রী চৌধুরী দাবি করেছেন যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) ও সিপিআই(এম) শক্তিশালী। আরএসএস দাবি করেছে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে পাঁচ জন সিপিআই(এম) কর্মী।
মহারাষ্ট্রে এখন সরকার চালাচ্ছে দীর্ঘদিন বিজেপি’র জোটসঙ্গী থাকা উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল শিব সেনা। মুখ্যমন্ত্রী’র পদ’কে কেন্দ্র করে বিরোধের ভিত্তিতে বিজেপি’র সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেস ও এনসিপি’র সমর্থনে সরকার গড়েছে উদ্ধব ঠাকরে’র শিব সেনা। যদিও একক দল হিসেবে বিধানসভায় বিজেপি’র আসন সংখ্যা বেশী। বিজেপি’র তাগিদ থেকেছে এটা প্রমাণ করার যে, বিজেপি না কী শিব সেনা — কে আসল হিন্দুত্ববাদী উগ্রতার প্রতিনিধি?
সরকারে যেই থাকুক দেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশী হিন্দুত্ববাদের অনুশীলন যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো করে তাদের মধ্যে গুজরাট ও মহারাষ্ট্র পুলিশের নাম সামনের সারিতে থাকবে। গণপিটুনির দায় রাজ্য সরকার কোনো ভাবেই এড়াতে পারে না ঠিকই। কিন্তু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মারমুখী ভীড়ের সামনে পুলিশের অসহায় চেহারা। যদিও ঘটনা ঘটার পর কালবিলম্ব না করেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে ১০০’র অধিক গ্রামবাসীদের। এই মানুষগুলোর শাস্তিও হবে, তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। আইনে যা শাস্তি আছে তার থেকে বেশী শাস্তিই পাবেন এরা গরীব আদিবাসী বলে।
পুলিশের এই সক্রিয়তা কিন্তু দেখা যায় না আক্রান্ত যদি গরীব আদিবাসী, দলিত বা মুসলিম হন এবং আক্রমণকারী যদি উচ্চবর্ণ হিন্দু বা কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হয়। পুলিশের ঝটপট গ্রামবাসীদের গ্রেফতারের পরে এবার সাধুরা আবদার জুড়েছেন আগামী ৩রা মে’র মধ্যে ধৃতদের প্রকাশ্যে হত্যা করার। নয়তো তাঁরা নাকি সশস্ত্র ‘শিব তান্ডব’ চালাবেন! ঠাকরের মতন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট পর্যন্ত বার বার ঘোষণা করছেন সাধু হত্যার সাথে কোনো ধর্মীয় হিংসার সম্পর্ক নেই। সন্দেহ জাগে বিধায়ক কিনে সরকার ফেলতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই সাধু হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার ফেলার কোনো চক্রান্ত চলছে কি না তা নিয়ে!
চক্রান্ত বা দুর্ঘটনা যাই হোক না কেন, ভুয়ো খবর রটানো এবং গণপিটুনির যে মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি কে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তার শিকার এই সাধুদের হতে হল। সাধুদের দুঃখজনক মৃত্যু’র ঘটনাকে গেরুয়া শিবির ঠাণ্ডা মাথায় আরো এক দফা ভুয়ো খবর রটিয়ে বিদ্বেষ প্রচার এবং বিরোধীদের উপর শারিরীক আক্রমণ শানাবার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইছে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটের দরুন খেটে খাওয়া মানুষ যখন সরকারি অবহেলা’র বিরুদ্ধে শ্রেণী-সচেতন হয়ে উঠলেন ঠিক তখনই এই ধরণের ঘটনা গেরুয়া শিবিরের কি প্রয়োজন ছিল না? যেহেতু এই অঞ্চলের আদিবাসী আর কৃষকদের একটা বৃহৎ অংশ “কিষান লঙ মার্চে” অংশগ্রহণ করেছিলেন তাই এই সাধু হত্যা কি এই অঞ্চলে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন বাড়িয়ে লকডাউনের ফলে জমে থাকা আক্রোশ কে না বিস্ফোরিত হতে দেওয়ার একটা চক্রান্ত নয়? এর জবাব কিন্তু ভবিষ্যৎ দেবে।