ভারতবর্ষের মতন একটা অনুন্নত ১৩০ কোটি মানুষের দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে মানুষ কে বাঁচাতে, বিশেষ করে ৮০ শতাংশ গরীব ও নিম্নবিত্ত জনগণ কে বাঁচাতে, জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা ভীষণ জরুরী এবং তা করা দরকার একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। অথচ দেখে মনেই হচ্ছে না যে করোনাভাইরাসের প্রকোপটি থেকে ধনী, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বাদ দিয়ে, বিশেষ করে সাবর্ণ হিন্দুদের বাদ দিয়ে, আর কারুর সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার বা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কোন ভাবেই উদ্বিগ্ন।
মোদী সরকার লকডাউন ঘোষণা করে ভেবে নিয়েছে যে শুধু এই দিয়েই করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে দেশ কে মুক্ত করা যাবে। তাই যে পরিমাণ টেস্টিং বা পরীক্ষা করা উচিত ব্যাপক মানুষের বা যে পরিমাণ সাজসরঞ্জাম, যেমন পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই ও ভেন্টিলেটর দরকার তা দেশের কলকারখানাগুলো কে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন সংস্থাগুলো কে দিয়ে না বানিয়ে, শুধু আমদানি করার উপর জোর দিয়ে চলেছে এই সরকার। এর ফলে দেশে এক চরম অভাব দেখা দিয়েছে পিপিই ও ভেন্টিলেটরের, আর এর মধ্যেই খবর এসেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশ থেকে ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর আমদানি করার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে। এর কারণ হিসাবে যদিও বারবার করে দেখানো হচ্ছে দেশের মধ্যে এই ভেন্টিলেটরের চূড়ান্ত অভাব কে, তবুও যেহেতু ধোঁয়া উঠেছে তাই বোঝা যাচ্ছে যে কোথাও না কোথাও আগুন নিশ্চয় লেগেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তীব্রতা ধারণ করতেই সারা বিশ্ব জুড়ে একটা হাহাকার সৃষ্টি হয় ভেন্টিলেটরের অপ্রতুলতার দরুন। যদিও চীনা কোম্পানিগুলো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সারা বিশ্বে এই ভেন্টিলেটর সাপ্লাই করতে, তবু তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এর মধ্যে পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটে যে বিগত এক থেকে দেড় বছর যাবত গাড়ি শিল্পে চরম মন্দা নেমে আসে তার থেকে উদ্ধার পেতে বৃহৎ গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোও ভেন্টিলেটর বানাবার কাজ শুরু করেছে, নিজেদের ব্যবসা বৃদ্ধির স্বার্থে। এমতাবস্থায়, ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর আমদানি করা নিয়ে জনমত সৃষ্টি করা শুরু করে একটি কায়েমি স্বার্থে চালিত বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের দল, বিজেপি নেতৃত্ব ও বড় বড় আমলারা। নানা ভাবে সংবাদ মাধ্যম ও বিজেপি’র প্রচার যন্ত্র কে ব্যবহার করে তাঁরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে ব্যবহৃত ভেন্টিলেটরগুলো নাকি ভাল এবং তা রুগীদের চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করা সম্ভব।
ইলেক্ট্রনিক ওয়েস্টেজ বা বৈদ্যুতিন বর্জ্য পদার্থ হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া ব্যবহৃত ভেন্টিলেটরের আমদানির উপর পরিবেশ মন্ত্রকের নিষেধাজ্ঞা বহুদিন যাবত বহাল ছিল। এই ভেন্টিলেটরগুলো কে অনেকে ব্যবহৃত গাড়ির সাথে তুলনা করলেও তাঁদের কেউই এটা বলছেন না যে একটি গাড়ি ও একটি চিকিৎসা উপকরণের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত আছে। এই ভেন্টিলেটরগুলো কেন কোন দেশ বর্তমান সময়ে রপ্তানি করবে যদি সেগুলো অচল না হয় বা রুগীদের জন্যে ক্ষতিকারক না হয়? যখন দেশে দেশে ভেন্টিলেটরের জন্যে হাহাকার, যখন মার্কিন মুলুকে অপ্রতুল ভেন্টিলেটর থাকার কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন, সেখানে কেন সেই দেশ চলমান এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ভেন্টিলেটর ভারত কে রপ্তানি করবে?
আমদানি করা ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর এ কী কী ক্ষতি হতে পারে? প্রথমত, যদি সঠিক ভাবে sterilisation না করা হয় তাহলে এই ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর থেকে সংক্রমণ হতে পারে একজন রুগীর। দ্বিতীয়ত, এই ভেন্টিলেটর থেকে ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে কারণ তা ফুসফুসের কোষগুলো কে নষ্ট করে দিতে পারে। তৃতীয়ত এই ভেন্টিলেটরগুলো চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়ে, কারণ এগুলো ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এদের এফিকেসি বা ক্ষমতা শুরু থেকেই কম থাকে, এরপরে চলতে চলতে যে কোন সময়ে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তার ফলে রুগীর জীবনহানি পর্যন্ত হতে পারে। এত ধরণের জটিলতা থাকার কারণে আমদানিকৃত ভেন্টিলেটরগুলো লাভের চেয়ে বেশি অনেক বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।
এত জটিলতা ও ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর আমদানি করার পিছনে যে আসলে মানুষের জীবন রক্ষার নয় বরং মুনাফা আর কাটমানি খাওয়ার তাগিদ আছে তা বুঝতে কারুরই বাকি যায় না। গত ৬ এপ্রিলের ইন্ডিয়া টুডে‘র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে একটি মার্কিন সংস্থা থেকে চেন্নাই-স্থিত স্কাইলারক অফিস মেশিন্স নামক কোম্পানি ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে কিছু ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর আমদানি করে কিন্তু কাস্টমস তা বাইরে নিয়ে যেতে দেয়নি কারণ সেই ভেন্টিলেটরগুলো বৈদ্যুতিন বর্জ্য পদার্থ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ হয়েছে। কাস্টমস থেকে আমদানিকারি কোম্পানি কে জরিমানা করা হয় যা না দেওয়ার জন্যে কাস্টমসের ট্রাইব্যুনালে কোম্পানিটি আর্জি জানায় এবং সেই ট্রাইব্যুনাল আশ্চর্যজনক ভাবে জরিমানা মকুব করে দিয়ে কোম্পানিটিকে সেই সমস্ত ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর পুনরায় মার্কিন মুলুকে রপ্তানি করে ফেরত পাঠাবার আদেশ দেয়।
এই দিকে ভারত সরকার মার্চ মাসের মাঝামাঝি ভারত থেকে ভেন্টিলেটর রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ওই ভেন্টিলেটরগুলোর কোন হিল্লে সেই কোম্পানি করে উঠতে পারেনি। অথচ আচমকা এই ভাবে আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেওয়ায় সেই স্কাইলারক কোম্পানির বিপুল অর্থ ব্যয় হওয়ার থেকে বেঁচে যেমন গেল ঠিক তেমনি সেই বর্জ্য কে আজ চিকিৎসা সরঞ্জামের তকমা দিয়ে ঝেড়ে মুছে মানুষের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্য কে বিপন্ন করার পথও প্রশস্ত করা হল। স্কাইলারক অফিস মেশিন্স এর মালিক কিন্তু কোন তামিল নন বরং একজন মাড়োয়ারি শেঠ, যার নাম রোহিত ঝুনঝুনওয়ালা। তিনি কোন সংবাদ মাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দেননি।
ভারতে মাত্র ৪০,০০০ থেকে আনুমানিক ৬০,০০০ ভেন্টিলেটর এই মুহূর্তে চলমান অবস্থায় রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে মানুষ কে বাঁচাতে যেমন অসংখ্য টেস্ট কিট লাগবে, ঠিক তেমনি অসংখ্য, বা কয়েক লক্ষ ভেন্টিলেটর দরকার। কিন্তু তা বলে কোন ভাবেই ব্যবহৃত ও বিদেশের বর্জ্য পদার্থ আমদানি করা কে সমর্থন করা যায় না। এই আমদানি করার বিরোধিতা করেছেন দেশের অনেকেই। দ্যা টেলিগ্রাফ‘র গত ১৭ এপ্রিল একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যাতে একদিকে যেমন দিল্লী’র চিকিৎসক মঞ্জু মণি বলেছেন যে তিনি কোন সঙ্কটগ্রস্ত রুগীর ক্ষেত্রে একটি ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর ব্যবহার করবেন না, তেমনি ভারতীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প সঙ্ঘের বা এআইএমইডি’র তরফ থেকে রাজীব নাথ জানিয়েছেন যে সরকারের কোন ভাবেই এই ব্যবহৃত সামগ্রী আমদানি করা উচিত নয়।
তবুও মানুষের আতঙ্ক ও সঙ্কট কে পুঁজি করে মোদী সরকার নির্লজ্জের মতন বিদেশ থেকে, বিশেষ করে মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর নিয়ে আসবে কারণ তার ফলে একদিকে শুধুমাত্র ধনী ও উচ্চবিত্তদের জন্যেই নতুন, অব্যবহৃত সমস্ত ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা যাবে আর গরীব মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে অনেক টাকা কাটমানি হিসাবে উপার্জন করা যাবে। অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে কোন তথ্যের আধিকার বা আরটিআই কর্মী, কোন দুর্নীতি-বিরোধী মঞ্চ বা কোন সরকারি সংস্থা যেমন কম্প্রটলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা ক্যাগ বা ভিজিলেন্স এই চরম দুর্নীতি নিয়ে, এই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা’র বিরুদ্ধে একটি নৈতিক অবস্থান থেকে সরকার কে প্রশ্ন করবে না বা এই দুর্নীতির স্বরূপ দেশের করদাতা মেহনতি মানুষের সামনে তুলে ধরবে না।
করোনাভাইরাস যখন সমাজের ও অর্থনীতির মাজা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, যখন লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষ কে সারা বিশ্বে অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, ঠিক তখন মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে এত বড় ফাটকা খেলার মধ্যে দিয়ে মোদী সরকার জানান দিল যে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি এবং তাদের দোসর ভারতীয় বৃহৎ মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজি আজ এমন সঙ্কটে নিম্মজিত যে কোন ভাবেই সে মুনাফার কোন সুযোগ ছাড়বে না, তাতে যদি লক্ষ মানুষের জীবনহানি হয়, তবুও সে পিছু হটবে না। করোনাভাইরাসের জুজু দেখিয়ে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যে ভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে, যেভাবে গরিব মানুষ কে নৃশংস ভাবে পুলিশ দিয়ে অত্যাচার করেছে, তা দেখে মনে হচ্ছে এই ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর আমদানি করাটা আসলে সমুদ্রের অতল থেকে উঠে থাকা বরফের শৃঙ্গ মাত্র, আসল গল্প এখানে শেষ নয় বরং এখান থেকেই শুরু হবে আর তীব্র ভাবে বিস্তৃত হবে, কারণ পুঁজি ও মুনাফার খোঁজে পুঁজির হন্য হয়ে ছুটে বেরানো যে কোন ভাইরাসের চেয়েই ক্ষতিকারক।