আম্ফান (সঠিক উচ্চারণ উম পুন) ঘূর্ণি ঝড়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি সচক্ষে দেখলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর ঘোষণা করলেন ১ হাজার কোটি টাকা অগ্রিম ত্রাণের। মোদীর আম্ফান ত্রাণের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হয় কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, যিনি প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যপাল জগদীশ ধনখোরের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর যৌথ বিমান পরিদর্শনে যান, নিজেও স্পষ্ট ভাবে জানাতে পারলেন না যে প্রধানমন্ত্রীর এই ত্রাণ কি শুধুই ১ হাজার কোটি টাকার না কি তাঁর কথা মতন এটি অগ্রিম এবং বাকি টাকা রাজ্য পরে পাবে। এই অস্পষ্টতার জন্যেই মোদীর ঘোষণা করা ত্রাণের পরিমান নিয়ে শুরু হয় বিদ্রুপের পালা। যথারীতি মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর ফলে খানিকটা ব্যাকফুটে চলে যায়। তবে এই ত্রাণের অর্থ নিয়ে কচকচানির পালায় রাজ্য রাজনীতিতে ত্রাণ নিয়ে বিজেপি কী ভাবে ২০২১ সালে মসনদ দখলের পরিকল্পনা সফল করবে সেই ব্যাপারে কেউই বিশেষ নাক গলালেন না।
মোদীর আম্ফান ত্রাণের অর্থ যে ১ হাজার কোটি টাকা নয় বরং এই টাকাটা তিনি যে রাজ্য সরকার কে অগ্রিম হিসাবে দিলেন সে কথা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাবেই জানান বসিরহাটে রাজ্য প্রশাসনের সাথে মিটিং করে ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক হিসাব জেনে। এর ফলে এই ত্রাণের অর্থ নিয়ে রাজনীতির কোন মানে বর্তমানে হয় না। এই ত্রাণের অঙ্ক বনাম পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রের কাছে পাওনা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার হিসেব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যেও কিন্তু বেশির ভাগ বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক মানুষেরা মোদীর বর্তমান সফরের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিজেপির এই ত্রাণের রাজনীতির মাধ্যমে গ্রাম বাংলায়, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, পূর্ব বর্ধমান, প্রভৃতি জেলায় নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করলেন না।
আসলে মোদীর আম্ফান ত্রাণের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কে উৎখাত করার এক মারণাস্ত্র। বন্দোপাধ্যায় বর্তমানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কে ধরতে পারছেন না। আজ থেকে ১১ বছর আগে এমনিই এক মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় আছড়ে পড়ে আয়লা ঘূর্ণি ঝড়। বর্তমানের আম্ফানের থেকে যদিও তার প্রকোপ কম ছিল তবুও বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে বহু মানুষের ক্ষতি করে এই ঘূর্ণি ঝড়। সেই সময়ে রাজ্য শাসন করছে বন্দোপাধ্যায়ের চির শত্রু সিপিআই (এম) এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার। বন্দোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা বা ইউপিএ ২ সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে আয়লা ঘূর্ণির জন্যে রাজ্য কে ত্রাণ দিতে কেন্দ্র কে মানা করেন বন্দোপাধ্যায়। তিনি অভিযোগ করেন যে ত্রাণের টাকা সিপিআই (এম) নেতৃবৃন্দ দলের তহবিলে ঢালবেন এবং এর ফলে বিপর্যস্ত এলাকার মানুষের কোন উপকার হবে না। এই নিয়ে সিপিআই (এম) ও বন্দোপাধ্যায়ের ভীষণ তরজাও হয়। আর এই ত্রাণের রাজনীতি করে ২০১১ সালে আয়লা বিপর্যস্ত এলাকাগুলোতেও সিপিআই (এম) কে পরাজিত করেন তিনি।
বর্তমানে, তাঁর শাসনকালের এক দশকের শেষ প্রান্তে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ছোট, মেজ আর বড় নেতারা আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ের দুর্গতদের ত্রাণের অর্থ বেমালুম হাপিস করে দিতে বেশি দেরি করবেন না, আবার এই নেতাদেরই একটা বড় অংশ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির খাতায় নাম লেখাবেন, সে কথা কিন্তু বন্দোপাধ্যায় উপলব্ধি করেছেন আর তাই তিনি এখন থেকেই বিজেপির সঙ্গে আপোস করে চলতে চাইছেন। তবে এর ফলে সমস্যায় তিনিই পড়বেন। প্রথমত তিনি জানেন ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি হলে দুর্গত মানুষদের তৃণমূলের উপর বিতৃষ্ণা বাড়বে আর এই সুযোগ কাজে লাগাবে বিজেপি। দ্বিতীয়ত কংগ্রেসি কায়দায় গড়া দলের কাঠামোর ফলে তিনি কোন ভাবেই তৃণমূলের নেতা কর্মীদের দ্বারা আম্ফান ঘূর্ণির ত্রাণের টাকা লুঠ হওয়া ঠেকাতে পারবেন না। তৃতীয়ত তিনি এটাও জানেন যে তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ রাজ্য কংগ্রেসের একাংশ ও সম্পূর্ণ সিপিআই (এম) কিন্তু বিজেপির সুরেই সুর মেলাবে। তাই এই ত্রাণের টাকা আসলে বন্দোপাধ্যায়ের গলায় একটা ফাঁস হয়ে যাবে এবং এর ফলে তাঁকে গদিচ্যুত করা বিজেপির পক্ষে সুবিধাজনক হবে।
মোদীর আম্ফান ত্রাণের টাকা যত বেশি করে তৃণমূলের নেতারা ঝেড়ে দেবেন, তত বেশি করে বিজেপি আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ের দুর্গতদের নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারবে। যদিও উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা ভালই তবুও হিন্দু ভোটের যদি বিজেপি এই দেখিয়ে মেরুকরণ করতে পারে যে বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল শুধু মুসলিমদের ত্রাণ দিচ্ছে, যে ত্রাণ নাকি মোদী হিন্দুদের জন্যে পাঠিয়েছেন, তাহলেই দক্ষিণ বঙ্গে কেল্লা ফতে হবে বিজেপির। যেহেতু বন্দোপাধ্যায় বা উঁচু স্তরের তৃণমূলের নেতারা কোন ভাবেই নিচু তলায় ত্রাণ চুরি আটকাতে পারবেন না এর ফলে এক ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হবে গোটা বিপর্যস্ত এলাকা জুড়ে, ঠিক যেমন বর্তমানে রেশন দুর্নীতি কে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদ সহ নানা জায়গায় চরম বিক্ষোভ দেখা গেল। নানা জায়গায় এইরকম জনরোষের প্রকোপে তৃণমূলের অন্তরে যে সত্যিই এক বিরাট বিপর্যয় দেখা দেবে এ কথা অনস্বীকার্য। এর আগেও বন্দোপাধ্যায়ের কাট মানি ফেরত দেওয়ার আদেশের পরে কী ভাবে গ্রাম বাংলায় তৃণমূল নেতৃত্ব কে বিপর্যস্ত করেছিল বিজেপি সে কথা কিন্তু এখনো জনতার স্মৃতির থেকে মুছে যায়নি।
বন্দোপাধ্যায় মোদীর সাথে বৈঠকের পরে বলেছিলেন যে কেন্দ্র যদি দিতে চায় ত্রাণ তাহলে দেবে না দিলেও ক্ষতি নেই। এর কারণ রাজ্যের তহবিল গড়ের মাঠ হলেও নিজের গলায় জেনেশুনে ফাঁস পড়তে মুখ্যমন্ত্রী গররাজি। বর্তমানে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন, ২০০৫, ব্যবহার করে রাজ্যের মসনদে কিন্তু বকলমে মোদীই বসে। করোনা ভাইরাসের বৃদ্ধি নিয়ে ইতিমধ্যেই বন্দোপাধ্যায় কে ঘেরাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে যদি আবার ত্রাণ চুরি নিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয় তাহলে বন্দোপাধ্যায় জানেন তাঁর খাস ভোটারদের বড় অংশটাই তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে। মোদীর আম্ফান ত্রাণের টাকা তাই বন্দোপাধ্যায় কে না বরং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কে পরিত্রাণ পাইয়ে দেবে।