কোভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলায় ভারত সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। লক ডাউনের চতুর্থ দফা শেষ হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সংক্রমিত মানুষের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি গোটা দেশে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। লক ডাউনের শুরু থেকে আমরা বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট এর ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে অবগত ছিলাম এবং তিন মাস পরেও ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা স্তিথিশিলতার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
বিখ্যাত রিসার্চ ফার্ম ক্রিজিল ও ভারতের পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ( SBI) তাদের রিপোর্টে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কে বিগত ৪০ বছরের মধ্যে তীব্রতম হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তারা বলেছে যে বেশিরভাগ রাজ্যে কন্টেনমেন্ট জোন থাকার কারণে এই অর্থনৈতিক সংকট ২০২০-২১ অর্থনৈতিক বর্ষে আনুমানিক ৫-৬.৮% জিডিপি হ্রাস ঘটাবে, যা কিনা প্রায় ৭০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। তাই জিডিপির বিপুল হ্রাস একপ্রকার ভবিতব্য।
শুধু SBI বা ক্রিজিল নয়, বেশিরভাগ বিখ্যাত অর্থনৈতিক প্রকাশনা গুলি যেমন দ্যা ইকোনমিক টাইমস, ব্লুমবার্গ, কুইন্ট, লাইভ মিন্ট এবং অন্যান্যরা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে বিগত ২০ বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং তারা বলেছে যে এটি সমগ্র অর্থনীতিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শুধু ভারত নয় সমগ্র বিশ্বই একই সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার(IMF) তাদের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে সতর্ক করেছে যে সমগ্র বিশ্ব ২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও বড় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে চলেছে।
এই পূর্বাভাসের পরেও ভারতের সরকার এটিকে ব্যবস্থাগত সংকট হিসাবে চিহ্নিত করতে নারাজ এবং তারা এটিকে শুধুমাত্র স্বল্পস্থায়ী ঋতুকালীন সংকট হিসাবে দেখাত চায়। পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকার বলেছেন খুব দ্রুত অর্থনীতির হাল ফিরবে। শুধু দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদরা নয় এমনকি কিছু খ্যাতনামা কেন্সিয়ান ও বামপন্থী অর্থনীতিবিদ ও এটিকে পুঁজিবাদের সংকট হিসাবে স্বীকার করতে প্রস্তুত নন।
পল ক্রুগম্যান নামক একজন বিখ্যাত কেনসিয়ান অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধের মত একটি ক্ষণস্থায়ী ঘটনা। রবার্ট রেইখ নামক একজন বামপন্থী অর্থনীতিবিদ বর্তমান সংকটকে অর্থনৈতিক সংকটের পরিবর্তে একটি স্বাস্থ্য সংকট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন এবং বলেছেন যে স্বাস্থ্য সংকট মেটার সাথে সাথেই অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। আরো কিছু অর্থনীতিবিদ আছেন যারা এটিকে ঋতুকালীন সংকট হিসাবে সওয়াল করেছেন, কিন্তু আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই সংকটকে পুঁজিবাদের সংকট হিসাবে নির্ধারিত করছি। তারা এটিকে ঋতুকালীন সংকট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তার কারন যেকোনো অর্থনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে তাদের ভুয়ো দর্শন লব্ধ স্বল্পকালীন বিশ্লেষণ এর পদ্ধতি। কিন্তু আমরা যদি প্রচলিত মত বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংকট কে অনুসন্ধান করি তাহলে আমরা এর মূল উৎস খুঁজে পাব।
বিগত ১৫ বছর ধরে ভারতের অর্থনীতি বর্তমান সংকটের সমস্ত প্রকার সম্ভাবনা তৈরী করছিল। যদিও শেয়ার মার্কেট সূচকের তুরীয় ঊর্ধ্বগতি ভারতীয় অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থার দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষন করেনি, প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছিল। বিগত কয়েক বছরে ভারতে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার তলানি তে ঠেকেছে এবং এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে সাধারণ ভারতবাসীর ব্যক্তিগত ব্যয়ক্ষমতা তুমুলভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বিগত কয়েকটি ত্রৈমাসিকে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৫%, কিন্তু বিগত কয়েক বছরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির বিপুল হ্রাস আমাদের বর্তমান সংকটের বিপদ সংকেত দিচ্ছিল। গড় প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধি কে একশো শতাংশ ধরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হারের শতাংশের হিসাবে পতন দেখলে আমরা বুঝতে পারব ভারতের অর্থনীতি সমস্ত বিধ্বংসী উপাদান গুলিকে একত্রিত করছিল এবং কোভিড-১৯ অতিমারী তাতে অগ্নি সংযোগ ঘটিয়েছে মাত্র।
ত্রৈমাসিক | আসল জিডিপি বৃদ্ধি | বৃদ্ধির দরে পতন |
গড় আসল জিডিপি বৃদ্ধির দর | ৭.৫ | ১০০% |
অক্টোবর ২০১৮ | ৭.০০২ | ৯৩.৩৬ |
জানুয়ারি ২০১৯ | ৬.৫৭৭ | ৮৭.৬৯ |
এপ্রিল ২০১৯ | ৫.৮৩১ | ৭৭.৭৪ |
জুলাই ২০১৯ | ৫.০১৪ | ৬৬.৮৫ |
তাই এটি একটি সুস্পষ্ট প্রবনতা যে বিগত দুই বছর ধরে ভারত একটি অর্থনৈতিক সংকটের সমস্ত উপাদান তৈরী করেছে এবং তা সামনে আসা শুধু ছিল সময়ের অপেক্ষা। তাই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কেবলমাত্র ঋতুকালীন সংকট নয়, খুব স্পষ্ট ভাবেই সংকটাপন্ন পুঁজিবাদের ফলাফল মাত্র।
একটি অর্থনৈতিক চক্রের মধ্যে প্রকৃত জিডিপির বৃদ্ধির হার জাতীয় অর্থনীতির স্বাস্হ্যের সূচক এবং তার দীর্ঘকালীন দ্রুত পতন প্রমান করে দেশ একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং তা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনো পথ সরকারের জানা নেই।
অন্য একটি আলোচনায় আমি বিগত কয়েক বছরে ভারতীয় কর্পোরেট দের লাভজনক তার বিষয় টি বিশ্লেষণ করেছি। পেন ওয়ার্ল্ড টেবিল ৯.১ বিশ্বের সমস্ত দেশের ১৯৫০ সাল ২০১৭ থেকে সাল পর্যন্ত ইন্টার্নাল রেট অফ রিটার্ন অন ক্যাপিটাল (IRR) নামে একটি নতুন সিরিজ প্রকাশ করেছে। এটি দেখায় যে ভারতের কর্পোরেট রা তাদের নিম্নগামী লাভের হার এর সাথে লড়াই করছিলেন।
অবশ্য অনেকে এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, IRR দীর্ঘকাল ব্যাপী নিম্নগামী লাভের হার বিশ্লেষণের জন্য সঠিক সূচক নয় কারণ এর হিসাব পরিবর্তনশীল পুঁজি ও বাজার এ থাকা পুঁজির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে না। যদিও এই যুক্তির পিছনে কিছুটা সত্যতা রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদের জটিল অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক এর মধ্যে প্রকৃত IRR নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব এবং পেন ওয়ার্ল্ড টেবিল প্রকাশিত সংখ্যাগুলি আমাদের পুঁজিবাদের অবস্থা সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারনা পেতে সাহায্য করে।
এই গ্রাফ এর পরিসংখ্যানগুলো খুব স্পষ্টভাবেই দেখায় যে ভারত অর্থনৈতিক মন্দার সময়কালে স্বল্প রেট অফ রিটার্ন এর সমস্যায় ভুগছিল এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জয়লাভ একটি কর্পোরেট সমর্থিত ক্ষমতা দখল ছাড়া আর কিছু নয়। এটি আরো একবার আমাদের দেখায় যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছু না এবং তা কেবল অতি ধনীদের স্বার্থেই কাজ করে। এটি কেবল ভারতের ক্ষেত্রে নয় সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রেই সত্যি এবং ক্রম হ্রাসমান লাভের হার পুঁজিবাদের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও মোদী জামানার প্রথম কয়েক বছর কর্পোরেট রা লাভের হারে স্বল্প ঊর্ধ্বগতি দেখেছিল, কিন্তু খুব দ্রুতই আবার লাভের হার পড়তে থাকে। মোদী জমানার দ্বিতীয় দফায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লভের পর ট্যাক্স কাট ও সস্তা লোনের মাধ্যমে কর্পোরেট দের সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়। এটি স্বল্প সময়ের জন্য লাভের হার কে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও প্রকৃত অর্থনীতি কে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেনি। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মুনাফার হারকে আরো সঙ্কুচিত করবে। এই দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা কে একমাত্র কার্ল মার্ক্স এর মুনাফার হার সংক্রান্ত দুই মুখী তত্ত্ব ই ব্যাখ্যা করতে পারে।
হেনরিক গ্রসম্যান সংকটের তত্ত্ব কে মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরুদ্ধার করেন এবং দেখান কিভাবে মুনাফার হার এবং পরিমাণ একে অপরকে প্রভাবিত করে। ভারতের ক্ষেত্রে, মুনাফার হারে পতনের ফলে ভারতীয় কর্পোরেট দের মুনাফার পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতের মার্কসবাদী রচনাগুলো তে প্রধান তাত্ত্বিকরা সবসময় উক্তি ব্যবহার করেন তাদের সমতার আদর্শ সম্পর্কিত জ্ঞানকে প্রমাণ করার জন্য এবং অনেক সময় তারা ভুল করে থাকেন। কিন্তু বর্তমান সংকট কে বোঝার জন্য গ্রশম্যান এর নিজের উক্তি তার থেকে ভালো কাজে দিতে পারে।
“শুধু লাভের হারের ই পতন ঘটে না, লাভ এর পরিমাণের বৃদ্ধিরও পতন ঘটে এবং তা উৎপাদনের মূল্যের বৃদ্ধির হারের থেকে পিছিয়ে পড়ে। তাই অবশেষে এমন একটি সময় আসে যখন মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি বিনিয়োগের প্রত্যাশিত বৃদ্ধি, যা উচ্চ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কভার করতে যথেষ্ট নয়। মুনাফার হারের পতন তাই তাৎক্ষণিক ভাবে ঘটে না। পুঁজির সঞ্চয়ের যে মডেল ই ধরা হোক না কেন, মুনাফার হার অবশেষে এমন একটি স্তরে নেমে আসে যেখানে বর্ধিত মূল্যের পরিমাণ আর পুঁজির সঞ্চয়ের হারকে ধরে রাখতে সমর্থ হয় না”
—(Grossmann 1929b pp 103, Grossmann 1932a pp 331-332)
বিগত কয়েকটি বছরে, মুনাফার হার ও জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পেতে ভয়ানক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি পুঁজিপতি দের একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফার হারের পতন শুধু পুঁজিপতিদের ই নয় সাধারণ মানুষেরও শঙ্কার বিষয়। কারন পুঁজিপতিদের মুনাফা ব্যক্তিগত হলেও পুঁজিপতিদের লোকসান সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে। ২০০৮ এর সময় মুনাফার হার তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়। মার্ক্সীয় ভাষায় আমরা বলতে পারি, এটি পুঁজির অতি সঞ্চয়ের পূর্ণ মাত্রাটিকে ছুয়ে যায় এবং তারপর তা পড়তে শুরু করে এবং ২০১৯ নাগাদ এটি ১৫ বছরের সর্ব নিম্ন অবস্থায় পৌঁছায়।
লাভের হার হ্রাস ভারতের বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে। প্রতিটি উৎপাদন খাতে উৎপাদন কমেছে এবং নিম্ন উৎপাদন মারাত্মক লে-অফগুলি ঘটায় । ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার ঠিক আগে উৎপাদন তার শীর্ষে পৌঁছায় এবং তারপর থেকে তার পতন শুরু হয়।
উৎপাদনের নিম্নগামীতা শুধু দ্রুত কাজ হারানোর পরিস্থিতিই তৈরী করেনা, সাথে সাথে এটি নতুন কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি কেও হ্রাস করে। এটি সরাসরিভাবে চাহিদা কে প্রভাবিত করে কারন মানুষের কাছে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার টাকা থাকে না। বর্তমান চাহিদা হ্রাসের মূল কারণ হচ্ছে উৎপাদন সংকট।
মোদী সরকার ও নিম্নগামী কর্মসংস্থান
যদিও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি মন্দা ছিল, ভারতের স্টক মার্কেট শেয়ার বাজারে এক উচ্ছ্বাসের সাক্ষী হয়েছিল। মুনাফা ও ইক্যুইটি র অনুপাত (P/E ratio) দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং ২০২০ র জানুয়ারি মাসে তা সর্বোচ্চ সীমা তে পৌঁছায়। পূর্ববর্তী লেখাগুলোতে আমি এটা বিশ্লেষণ করেছি যে কীভাবে বৃহৎ আর্থিক সংস্থাগুলি P/E ratio বাড়ানোর জন্য শেয়ার বাজার কে নিজেদের কাজে লাগায়। আপনি এখনও না দেখে থাকলে এটি এবং এই নিবন্ধগুলি একবার দেখতে অনুরোধ করছি।
শেয়ার বাজারের উচ্ছ্বাস এই কারণেই হয়েছিল যে সরকার কর্পোরেশনগুলিকে সস্তা লোনের সরবরাহ করেছিল এবং গত কয়েক বছরে সরকার এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) রেপোর হার কমিয়েছে। সুতরাং, এখন কর্পোরেশনগুলি চাহিদা সৃষ্টি করতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন পুনরায় চালু করতে আরও অর্থ ধার নিতে পারে।
বছর ও মাস | সংশোধিত রেপো হার (শতাংশে) |
জানুয়ারি ২০১৪ | ৮ |
জানুয়ারি ২০১৫ | ৭.৭৫ |
মার্চ ২০১৫ | ৭.৫ |
জুন ২০১৫ | ৭.২৫ |
সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ৬.৭৫ |
এপ্রিল ২০১৬ | ৬.৫ |
অক্টোবর ২০১৬ | ৬.২৫ |
অগাস্ট ২০১৭ | ৬ |
জুন ২০১৮ | ৬.২৫ |
অগাস্ট ২০১৮ | ৬.৫ |
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ৬.২৫ |
এপ্রিল ২০১৯ | ৬ |
জুন ২০১৯ | ৫.৭৫ |
অগাস্ট ২০১৯ | ৫.৪ |
অক্টোবর ২০১৯ | ৫.১৫ |
কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন, রেপো হার সর্বকালের সর্বনিম্ন ৪.৪% এ পৌঁছেছে। তবে উৎপাদনের পতনের হার দেখিয়েছে যে এমনকি আরবিআই এর সুদের হারের হ্রাস ও সত্যিকারের উৎপাদনের হার বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে ধার দেওয়া এত টাকা গেল কোথায় ? রেপো রেটের পতন প্রমাণ করেছে যে পুঁজিপতিরা আরও বেশি মুনাফা বৃদ্ধির জন্য তাদের টাকা কে স্টক মার্কেটে ব্যবহার করেছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একেবারেই বিনিয়োগ করেনি।
হয় পুঁজিপতিরা ধার করা অর্থ গচ্ছিত রাখবে বা তারা শেয়ার বাজারের ফাটকা গুলিতে এটি বিনিয়োগ করবে কারণ উৎপাদন তাদের পছন্দসই লাভ দিচ্ছে না। জিডিপিতে বিনিয়োগ দেখায় যে কর্পোরেশনগুলি অর্থনৈতিক চক্রে বিনিয়োগের পরিবর্তে তাদের অতিরিক্ত লাভ গচ্ছিত রাখছে। মোদী ২.০ সরকার কর্পোরেশনদের কেন্দ্রীয় বাজেট ২০১৯- এ একটি বিশাল করের ছাড় দিয়েছে এবং তাদের মুনাফা গচ্ছিত রাখার প্রবণতা বাড়িয়েছে কারণ এটি এখন আর ব্যয়বহুল নয়। ক্রেডিট সুইস থেকে নেওয়া একটি প্রতিবেদন গণনা করেছে যে ৯০% কর্পোরেশন অর্থনৈতিক চক্রে তাদের লাভের অবদান রাখেনি বরং তা গচ্ছিত রেখেছে।
সুতরাং, এটি দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, যদিও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দা ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে চলেছে, তার ঊর্ধ্বগতি বজায় ছিল কারন আরবি আই অর্থনীতিতে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ঋণের জ্বালানিতে একটি অর্থনৈতিক বুদবুদ কে বৃদ্ধি করছিল। তবে বিনিয়োগের অভাব কল্পিত মূলধনের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে তুলছিল এবং আমরা বাস্তব জিডিপিতে হ্রাস পেয়েছি।
এমনকি সরকারী সংস্থাগুলিও সরকারকে আশংকা র কথা জানিয়েছিল। এনএসএসও রিপোর্টে গণনা করা হয়েছে যে ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয়দের গড় ব্যয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু মোদী জমানা তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। নতুবা, এই সঙ্কট থেকে ভারতকে বাঁচানোর কোনও বিকল্প তাদের কাছে ছিল না কারণ পুঁজিবাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও অনুশাসন থেকে মুক্ত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ব্যাংকিং সংকট নিয়ে মার্কিন জাতীয় অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর কারম্যান রেইনহার্ট এবং কেনেথ রোগফের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে বিশ্বায়নের এই সর্বশেষ সময়টি অর্থনীতির ওঠা পড়া কমানোর ক্ষেত্রে অন্যতম সাফল্য ছিল না, বরং ছিল তার ঠিক বিপরীত।
গত ২৫ বছর আগের তুলনায় আরও আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে: উদীয়মান অর্থনীতিতে (১৯৮০ এবং ১৯৯০), এশিয়া (১৯৯৭-৯৯), জাপান (১৯৯০), মার্কিন ঋণ সংস্থা (১৯৯০); নর্ডিক ব্যাংক (১৯৯০-এর দশক) ইত্যাদি এবং পুঁজিবাদ ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করছে। সুতরাং, মোদী শাসনের এই সঙ্কট সমাধানের আর কোনও উপায় ছিল না কারণ এই ব্যবস্থাটি আসলে সরকারের চেয়ে পুঁজিবাদীদের দ্বারা বেশি নিয়ন্ত্রিত । সুতরাং, এই উৎপাদন শক, বা অর্থনৈতিক দিক থেকে সরবরাহের শক, ভারতীয়দের ব্যয় ক্ষমতা হ্রাস করে এবং একটি মারাত্মক চাহিদা শক বাজারে আঘাত হানার কারণ হয়।
সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে এই সংকট দীর্ঘকাল ধরে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং কাভিড-১৯ মহামারী এবং পরবর্তী লকডাউনটি কেবল অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। প্রচলিত অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে এই সংকট বোঝার চেষ্টা করা অর্থহীন কারন কোনো কেন্সিয়ান পদ্ধতি আমাদের সংকটের পিছনে আসল কারণটি দেখায় না। পুঁজিবাদের দীর্ঘ ঢেউ এবং বিনিয়োগের পতনের কারণে সরবরাহের ধাক্কারের ফলে লাভের পতন ঘটে এবং এর পরে চাহিদা সংকট দেখা দেয়। বাস্তবে,পুঁজিবাদের প্রতিটি সংকট এইভাবেই ঘটে।
মুল ইংরাজী প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন অর্পণ কুণ্ডু