বলা হয় যখন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হচ্ছিল তখন গাছে চেপে, টিলায় চেপে যত মানুষ যুদ্ধ দেখছিলেন আর শিস দিচ্ছিলেন, তাঁরা যদি হাতে করে একটা করে পাথর ছুড়তেন তাহলেও লর্ড ক্লাইভ-র নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা হেরে যেত। কিন্তু তাঁরা সে পথে যাননি কারণ তাঁদের সেই চেতনা ছিল না এটা বোঝার যে তাঁদের মাটি ও জীবন কী ধরণের পরাধীনতার শৃঙ্খলে জড়াতে চলেছে। বর্তমানে ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ঘটনাবলী আবার পলাশীর যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় কী ভাবে বাংলার বুকে মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, উর্মি চাঁদ, জগৎশেঠেরা আজও বেইমানি করে যাচ্ছে। কী ভাবে তিল তিল করে বাংলার মানুষ কে নিষ্পেষিত করে, বন্দী ক্রীতদাসে পরিণত করার কাজে তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে, সংগঠিত বিকল্প নেতৃত্বের অভাবে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ আজ চেয়ে চেয়ে তাঁদের সর্বনাশের দিন আসতে দেখছেন।
সেই মার্চ ২০২১ এর শুরুতে যখন নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ, তখনই বোঝা গেছিল কী অপেক্ষা করছে বাংলার মানুষের জন্যে। ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দর্শনে দীক্ষা নেওয়া সুনীল অরোরা যখন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, তখন গেরুয়া শিবিরের যে কোন চিন্তা নেই সে কথাই স্পষ্ট হল এই আট পর্যায়ের নির্বাচন ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। যেহেতু এই অরোরার সাহায্যেই মসৃন ভাবে, সমস্ত অভিযোগের তীর কাটিয়ে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন জিততে পেরেছিলেন, তাই এই বার যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি কে বেশি বেগ পেতে হবে না সেটা স্পষ্টই জানান দিয়েছিল কমিশন। তারপর তো বুথে পোলিং এজেন্ট সংক্রান্ত নিয়মও খুব সহজেই বদল করে ফেলে বিজেপি কে সাহায্য করতে। এর ফলে কারুরই আর নির্বাচন কমিশনের কাছে কোন আশা ছিল না।
কিন্তু সব ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করলো কুচবিহারের শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার পরে। যে ভাবে নির্বাচন কমিশন বিজেপি কে ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে জেতাতে সাধারণ গরীব মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা শুরু করলো, যে ভাবে সেই হিংসার স্বপক্ষে অবস্থান নিল আর যে ভাবে নির্লজ্জের মতন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায় কে নির্বাচন প্রচার থেকে বিরত থাকার হুকুম দিল, তার ফলে বোঝা গেল যে শুধুই ভিতরে-ভিতরে না, একদম খোলাখুলি বিজেপি-র পক্ষে তলোয়ার ধরেছেন সাবর্ণ পাঞ্জাবি অরোরা সাহেবের দলবল। এইবার অবসর গ্রহণের পরে হয়তো ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারক রঞ্জন গগৈ এর মতন কোন রাজ্যসভার বার্থ পেতে পারেন অরোরা সাহেব। স্বপন দাশগুপ্ত বিজেপির তারকেশ্বর কেন্দ্রের প্রার্থী হওয়ায় তাঁর সিটটা তো খালি আছেই।
ভাবুন বঙ্গবাসী কে কী চোখে দেখে দিল্লী। যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কে নিয়ে কুৎসিত আর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে মোদী তাঁর গরিব ও পিছিয়ে পড়া সকল শ্রেণীর সমর্থকদের তাঁতিয়ে তোলেন, তখন নির্বাচন কমিশন চুপ থাকে। যখন দিলীপ ঘোষ থেকে সায়ন্তন বসু-র মতন বাংলার খেয়ে দিল্লী-গুজরাট এর দালালি করা বিজেপি নেতারা বাকি চারটি নির্বাচন পর্বে আরও চারটি করে শীতলকুচি-র মতন গণহত্যা করার ডাক দেন, তখন চুপ থাকে নির্বাচন কমিশন। যখন মমতা বন্দোপাধ্যায় কে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করে অপমান করেন সদ্য বিজেপি হওয়া, তৃণমূলের একদা নয়নের মণি, শুভেন্দু অধিকারী, তখনও চুপ থাকে নির্বাচন কমিশন। আবার যখন মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেই আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ করেন, পায়ে আঘাত পাওয়ার অভিযোগ করেন, তখন কিন্তু সেই নির্বাচন কমিশন আইন শৃঙ্খলা নিয়ে নিজের দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছিল কাঁধ থেকে। এমন কী শীতলকুচি-র জোরপাটকিতে হওয়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও দায় নিহতদের ঘাড়ে চাপান অরোরা সাহেব।
কিন্তু ২৪শে মার্চ দিনহাটা শহর বিজেপি সভাপতি অমিত সরকার আত্মহত্যা করার পরে যেই বিজেপি খুনের অভিযোগ করেছিল, তেমনি কুচবিহার সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ কে কান্নান কে বদলী করে দেওয়া হয়। নিয়ে আসা হয় সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার দেবাশীষ ধর কে। এর সাথেই ঘটনার তদন্ত করতে পাঠানো হয় বিজেপি-ঘনিষ্ঠ ও রাজ্যের নির্বাচনের স্পেশাল পুলিশ অবসার্ভর ভিভেক দুবে কে। সেই বিহারী ব্রাক্ষণ দুবেজি এসে বাঙালি সরকারের মৃত্যু কে আত্মহত্যা ঘোষণা করার পরেই কিন্তু ক্ষান্ত হয় নির্বাচন কমিশন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের করা কোন অভিযোগ তো দূরের কথা, শীতলকুচির জোরপাটকিতে তদন্ত করতেই গেলেন না দুবেজি। বরং দূর থেকে বসে রিপোর্ট লিখে পাঠালেন যেখানে রাষ্ট্রের হাতে নিহত ব্যক্তিদের নামও ভুল উল্লেখ করেন তিনি। চেয়ে চেয়ে দেখে জোরপাটকি, যেখানকার স্কুলছুট শ্রমজীবী মানুষেরা এতদিন ভাবতেন নির্বাচন কমিশন বোধহয় কোন নিরপেক্ষ সংস্থা।
২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের লড়াই আজ পলাশীর যুদ্ধের মতন একটা পরিস্থিতি তৈরী করেছে। শত দোষ সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বিজেপি-র মতন একটা বহিরাগত ডাকাতদল কে, যাঁরা বঙ্গভূমি কে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় ডুবিয়ে, মানুষের রক্তে মাটি সিক্ত করে বঙ্গেরই সমস্ত সম্পদ লুটে নিয়ে যেতে চায়, বঙ্গের মানুষ কে সস্তা দাসশ্রমিকে পরিণত করতে চায়, রোখার জন্যে নির্বাচনী লড়াই চালাচ্ছেন। অথচ এই রকম চরম প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিস্ট বিজেপির মতন শত্রু কে না রুখে, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস জগৎশেঠ আর উর্মি চাঁদের মতন হাত মিলিয়েছে তাদের সাথেই। ফলে শীতলকুচিতে গুলি চালানো কে সমর্থন করতে তাঁদের রাজনৈতিক বিবেকে বাঁধছে না, ফলে মমতা বন্দোপাধ্যায় কে সেন্সর করার নির্লজ্জ প্রয়াস কে তাঁরা বিরোধিতা করছেন না।
এটা সঠিক যে নির্বাচনী পথে ফ্যাসিবাদ কে রোখা বা পরাজিত করা যায় না। কিন্তু নির্বাচনী ময়দানে নেমে যদি কেউ ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার নাম করে ফ্যাসিবাদ কে সমর্থন করে বঙ্গবাসী কে তুলে দিতে চায় দিল্লী আর গুজরাটের হাতে, চরম শোষণ ও নিপীড়ণের জন্যে, তাহলে বুঝতে হবে যে তাঁরাই আজকের জগৎশেঠ, উর্মি চাঁদ, মীরজাফর। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তি হতে পারে তবুও তা কোনদিনই বিজেপির মতন সাংঘাতিক কোন শক্তিতে পরিণত হবে না। কিন্তু যে ভাবে আজ অন্ধ মমতা বিরোধিতা করে বাম-কংগ্রেস জোট আজ বিজেপির জন্যে পথ প্রশস্ত করছে তাতে আগামী দিনের ইতিহাস এই দুই খুনে শক্তিকে ক্ষমা করবে না। ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের খেলায় অনেকেরই মুখোশ খুলে গেছে এবং এর ফলে আগামীর ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে শত্রু ও মিত্র চিনতে সুবিধা হবে।