প্রতি ১৫ দিন অন্তর কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে ও আসে-পাশের জেলার থেকে কর্মসূত্রে যে অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ রাজধানী শহরে পেটের টানে প্রতিদিন আসেন, আশা করে থাকেন যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বোধহয় লোকাল ট্রেন (local train) পুনরায় চালু করবেন। কিন্তু প্রতিবার তাঁদের হতাশ হতে হয়। ১৬ই মে থেকে যে “বিধিনিষেধের” নামে লকডাউন শুরু হয়েছে, তাতে নানা ধরণের ছাড় দেওয়া সেই জুন মাস থেকেই শুরু হয়ে গেলেও, বাস, অটো, ট্যাক্সি, রিকশা, মেট্রো রেল, প্রভৃতি চালু হয়ে গেলেও, লোকাল ট্রেন চালু করা হয়নি। বলা হয় যে লোকাল ট্রেন চললেই নাকি করোনা সংক্রমণ বাড়বে। আগামী ১৫ই অগাস্ট পর্যন্ত কোভিড নিয়ন্ত্রণ বিধি বাড়ালো রাজ্য সরকার কিন্তু এই সময় কালেও লোকাল ট্রেন চালানোর কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি।
যদিও মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ চালু করে অন্তর্বর্তী সরকার, বন্দোপাধ্যায় ১৬ই মে থেকে বন্ধ করে দেন গোটা রাজ্যের যান চলাচল ও মানুষের জীবন জীবিকার উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় খাঁড়া। যদিও সরকারি ভাবে এই “কোভিড নিয়ন্ত্রণবিধি” কে লকডাউন বলা হয়নি, কিন্তু ২৪শে মার্চ ২০২০-র সন্ধ্যা আটটায় হঠাৎ করে টিভিতে ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মানুষমারা, বীভৎস লকডাউনের চেয়ে এই “বিধিনিষেধ” কিছু কম ছিল না। এই লোকাল ট্রেন না চলায় চরম কষ্টে রয়েছেন গরিব মানুষেরা যাঁদের গত এক বছরে আয় তো বহুগুণ কমে গেছেই, কিন্তু সাথে সাথে এখন বেশি পয়সা খরচ করে যাতায়াত করার ফলে তাঁদের আর্থিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছর লোকাল ট্রেন প্রায় সাত মাস ধরে বন্ধ থাকার পরে চালু হলেও কিন্তু মান্থলি টিকিট ব্যবস্থা চালু হয়নি আর তার ফলে চরম সঙ্কটে পড়েন গরিব মানুষেরা। আর এখন, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া না বাড়িয়ে বাস চালাতে চাইছেন না বাসের মালিকেরা। ফলে অনেক সময়েই চড়া দামে টিকিট কেটে বাসে করে নিজেদের কার্যক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ কে। তাঁদের সমস্যা নিয়ে বন্দোপাধ্যায় বা সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরা তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাঁদের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত নয় বিরোধী দল, মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), কারণ এই ইস্যুতে ধর্মীয় মেরুকরণ করা সম্ভব নয়। কংগ্রেস বা সংসদীয় বাম দলগুলো এই মুহূর্তে ৩০০ জন বিশিষ্ট লোকের ফোনে মোদীর আড়িপাতা নিয়ে বেশি চিন্তিত, গরিবের লোকাল ট্রেন তাঁরা ধাত্যবের মধ্যেই আনে না। কিন্তু এই দলগুলোর অক্ষমতার কারণে কিন্তু কোনো ভাবেই জনগণ পিছিয়ে থাকছেন না লড়াই থেকে।
গত ২৮শে জুন কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে রেড ফ্যাকশন নামক একটি বামপন্থী সংগঠন রেল অবরোধের ডাক দেয়। সেই রেল অবরোধে শুধুই যে শয়ে-শয়ে গরিব মানুষ সামিল হন এবং দাবি তোলেন যে হয় সবার জন্যে ট্রেন চলবে না হলে স্পেশ্যাল ট্রেন, যাতে করে জরুরী পরিষেবার কর্মীদের যাতায়তের সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল, চলতে দেওয়া হবে না। রাজ্য সরকারের গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) অনুরোধ করে রেল অবরোধ সেদিন তুলে দিলেও, এর পর থেকে গরিব মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রকের রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স (আরপিএফ) পরবর্তী কালে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন সংলগ্ন রেললাইনের ধারে বাস করা বস্তি বাসীদের উপর আক্রমণ শুরু করে ও তাঁদের পরিচয়পত্র কেড়ে নিয়ে যায়।
অভূতপূর্ব ভাবে রেল অবরোধের কারণে মামলা করে সমন পাঠানো হয় রেড ফ্যাকশনের সংগঠকদের আর তাঁদের দমদম স্টেশনের আরপিএফ থানায় হাজির হতে বলা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। ট্রেন রোখার জন্যে নয়, বরং রাজ্য সরকার যাতে প্রতিটি মানুষ কে লোকাল ট্রেনে চেপে যাতায়ত করার সুযোগ দেয় সেই দাবি তোলার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার মামলা করলো আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। সেই কেন্দ্রীয় সরকার যার শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদী আর যার চালিকা শক্তি হল তাঁর বিজেপি, যার বিরুদ্ধে নাকি বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস লড়ছে। অথচ লকডাউন করে গরীব মানুষের ভাত মারার কাজে, মাসের পর মাস লোকাল ট্রেন বন্ধ রেখে দক্ষিণ বঙ্গের জনগণ কে চরম সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দেওয়ার মতন কার্যকলাপে কিন্তু বন্দোপাধ্যায় কোনো অংশেই মোদীর থেকে আলাদা নন।
গত বছর সাত মাস পরে যখন রাজ্যে লোকাল ট্রেন চালু হয়েছিল সেই সময় থেকে যদি আমরা আট দফায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন শুরুর আগের সময় অবধি পরিসংখ্যান দেখি তাহলে দেখা যাবে যে লোকাল ট্রেন চলায় কোভিড সংক্রমণ কিন্তু বাড়েনি। ২৫শে নভেম্বর ২০২০ তে যখন ৫০% যাত্রী নিয়ে, কোভিড বিধি মেনে লোকাল ট্রেন চলছিল তখন দৈনিক সংক্রমণ ছিল ৩,৫২৮টি এবং ৮.২৬% নমুনা পরীক্ষার থেকে পজিটিভ রেজাল্ট আসছিল। এর পরে, ১৫ই জানুয়ারি ২০২১ এ, লোকাল ট্রেন সমস্ত কোভিড বিধি কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছিল, কিন্তু দৈনিক সংক্রমণ হয় মাত্র ৬২৩টি আর ৭.৪৩% নমুনা পরীক্ষার থেকে পজিটিভ রেজাল্ট এসেছিল। এর পরে ১৫ই মার্চ ২০২১, লোকাল ট্রেন চলছে পুরোদস্তুর আর মানুষ ঝুলে ঝুলে অফিস-কাছারি যাচ্ছেন, কিন্তু সেই দিন দৈনিক সংক্রমণ ছিল মাত্র ২৫১টি, মাত্র ৬.৫৪% নমুনা পজিটিভ এসেছিল।
তারপরে, নির্বাচনী ঢাকে কাঠি পড়ায় পুরোদস্তুর প্রচার শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো। ২৫শে মার্চ ২০২১, দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে হল ৫১৬টি, ৬.৪৪% থাকলো পজিটিভ কেসের সংখ্যা। নির্বাচনী প্রচার তুঙ্গে উঠতেই, ভিন রাজ্য থেকে দলে দলে বহিরাগত গুন্ডা বাহিনী এনে একের পর এক বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি দাপট দেখাতে শুরু করাতেই হুহু করে বেড়ে গেল সংক্রমণের হার। ১৫ই এপ্রিল ২০২১, ৬,৭৬৯টি দৈনিক সংক্রমণ হল, ৬.৫৮% হল পজিটিভ কেস সংখ্যা। তারপরে ২৫শে এপ্রিল ২০২১, ১৫,৮৮৯টি দৈনিক সংক্রমণ, পজিটিভ কেস ৭.৩২% হল। তারপর নির্বাচনের ফলাফল বের হওযার পরের দিন, ৩রা মে ২০২১, ১৭,৫০১টি দৈনিক সংক্রমণ আর তার সাথে ৮.৩১% পজিটিভ কেস। এর পরে ৫ই মে ২০২১, ১৮,১০২টি দৈনিক সংক্রমণ, পজিটিভ কেসের হার ৮.৫৫%, আর কড়া বিধিনিষেধের আগের দিন, ১৫ই মে ২০২১, ১৯,৫১১টি দৈনিক সংক্রমণ আর তার সাথে ৯.৮০% পজিটিভ কেসের হার।
বর্তমানে, ২৯শে জুলাই ২০২১-এ গোটা পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ৭৬৬টি আর ১.৬৭% পজিটিভের হার। তাহলে ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান আমাদের দেখাচ্ছে যে লোকাল ট্রেন চলাকালীনও সংক্রমণের হার কম থাকে আর বর্তমানে তা নভেম্বর ২০২০-র থেকে অনেক কম। এই সংক্রমণ বৃদ্ধি ও রাজ্যে স্বাস্থ্য সঙ্কট কিন্তু কোনো ভাবেই লোকাল ট্রেন থেকে হয়নি, বরং তারিখের হিসাবে সেই কাজের জন্যে দায়ী বিজেপির রাজনৈতিক সভাগুলোয় ভিন রাজ্যের থেকে আনা ভিড় আর ওই দলের ভিন রাজ্যের কর্মীরা, যাঁরা নানা অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ফলে যে বিজেপি কে আটক করলে করোনা মহামারী থেকে পশ্চিমবঙ্গ কে বাঁচানো যেত, তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের, বিশেষ করে গরিব মানুষ কে, আঘাত করা বেশি শ্রেয় বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। আর বিজেপির কারণে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসছে চরম সঙ্কট, সেটার বিরুদ্ধে লড়াই করলেই, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পথ ধরলেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষেরই তাঁদের করের টাকায় চলা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার কে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে কেন বিজেপির পাপের শাস্তি গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ পাবে? কী তাঁদের দোষ? কেন শহরের রেস্তোরাঁ-বার, মল, স্পা, প্রভৃতি ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের সেবা প্রদান করা জায়গায় যেতে কোনো বাঁধা থাকবে না, শুধু হামলা হবে লোকাল ট্রেন চালাবার দাবি করলেই? কেন সাধারণ মানুষ লোকাল ট্রেনে চাপতে পারবেন না? কেন তাঁদের বাসে বাদুড়-ঝোলা ঝুলে গেলে করোনা হবে না আর ট্রেনে, ৫০% যাত্রীর সাথে গেলে করোনা হবে?
আজ বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস নিজেকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির প্রধান বিরোধী হিসাবে পরিচিত করাতে চাইছে। সেই কারণে আজ বেশি করে প্রশ্ন করা দরকার যে তৃণমূল কংগ্রেস যদি বিজেপি-বিরোধীই হবে, তাহলে কেন মোদীর গরিব-মারা, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ-রক্ষাকারী, ফ্যাসিস্ট রাজনীতি আজ এই দলটি পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করছে? কেন গরিবের ক্ষমতা হরণ করে ধনীদের সহযোগিতা করছে? আর লোকাল ট্রেন চালু না হওয়া পর্যন্ত যদি গণআন্দোলনগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সাধারণ মানুষের ভরসার লোকাল ট্রেনের চাকা আর হয়তো কখনোই আর সাধারণ মানুষের জন্যে ছুটবে না, বরং রেল বেসরকারিকরণের মাধ্যমে শুধু “লাভজনক” রুটে বেশি ভাড়ার যাত্রী নিয়েই ছুটবে কর্পোরেট-চালিত স্পেশ্যাল ট্রেন। সেই দিনটাই কি কাম্য তৃণমূল কংগ্রেস আর বন্দোপাধ্যায়ের কাছে?