স্বাধীনতা দিবস নিয়ে হৈচৈ শুরু হল বলে। বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো নানা ধরণের অফার নিয়ে আসবে। সাবেক চৈত্র সেলের চেয়েও বড় আকারে বর্তমানে ‘ইন্ডিপেন্ডেনস ডে স্পেশ্যাল সেল’ হয় আর ভারতবর্ষের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অনলাইন কেনা কাটার ধুম পড়ে যায় এই সময়ে। কারণ এর পর বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন ই কমার্স পোর্টালগুলো সোজা দুর্গা পূজা আর দীপাবলিতে অফার দেবে। তো এহেন স্বাধীনতা দিবস দেশের উচ্চবিত্ত আর শহুরে মধ্যবিত্তের জন্যে হরেক রকমের অফার আনলেও, গরিবের জন্যে হতাশা ছাড়া আর কী নিয়ে আসে? কী ভাবে ভারতের গরিব মানুষ ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবেন? ঠিক কী কী কারণে স্বাধীনতা দিবসে খুশি হবেন দেশের আপামর শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতী জনগণ?
পিউ রিসার্চ একটি সমীক্ষায় জানিয়েছে ২০২০ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভারতে দরিদ্র তালিকা ভুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের দৈনিক আয় দুই মার্কিন ডলার (প্রায় ₹১৫০) বা তার কম হয়েছে। অন্যদিকে মধ্য আয়ভুক্ত শ্রেণীর, যাদের দৈনিক আয় ১০.০২ থেকে ২০ মার্কিন ডলার (প্রায় ₹৭৫০ থেকে ₹১,৫০০), সংখ্যা ৩.২ কোটি হ্রাস পেয়েছে। এহেন সময়ে, মুকেশ আম্বানি যেমন বিশ্বের নবম থেকে ষষ্ঠ হয়ে দশম ধনী ব্যক্তি হয়েছেন, তেমনি গৌতম আদানি তাঁর ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলে এশিয়ার দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি হয়েছেন।
এই করোনা মহামারীর বাজারে যদিও গরিবের কাজ চলে গেছে, কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চটকলে তালা ঝুলছে, আর ছোট ব্যবসা লাটে উঠেছে, তবুও স্বাধীনতা দিবস তাঁদের পালন করতেই হবে, না হলে তাঁরাও যে দেশদ্রোহীর তকমা পাবেন। তাঁদের যদিও পেটে ভাত নেই আর মহামারীর আগের থেকেই যেহেতু দেশে ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়ে গেছিল, তবুও তাঁদের স্বাধীনতা দিবস পালন করতেই হবে কারণ এই মহামারীর বাজারেই কিন্তু ভারতের ১০০ জন ধনকুবেরের ₹১২,৯৭,৮২২ কোটি ধনবৃদ্ধি হয়েছে যা দিয়ে তাঁরা প্রতিটি ভারতবাসী কে ₹৯৪,০৪৫ করে দান করতে পারেন। ভারতের প্রতিটি গরিব মানুষের, শ্রমিক আর কৃষকের, স্বাধীনতা দিবস পালন করা উচিত কারণ তাঁরা তিন বছরের কঠিন শ্রমে যে অর্থ উপার্জন করেন, তাঁদের “প্রধান সেবক” সাজা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান স্পন্সর আম্বানি সাহেব প্রতি মুহূর্তে সেই অর্থ আয় করেন।
তবুও মোদী সাহেব গরিব মানুষ কে বিনামূল্যে খাদ্য শস্য দিয়েছেন বলে বুক পিটিয়ে প্রচার করেন, কিন্তু চুপ করে থাকেন কী ভাবে “এক দেশ এক রেশন কার্ড” প্রকল্প এনে ২০ থেকে ২৫ কোটি গরিবের রেশনের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন তিনি। যখন তিনি ভিডিও কনফারেন্সে বলেন যে তাঁর সরকার গরিবদের ভীষণ ভালবাসে, তখন তিনি এটা বলেন না যে তাঁর শাসনকালে, তাঁর প্রদত্ত নোটবন্দী, পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি-র, আর লকডাউনের কারণে, দেশে গরিবের সংখ্যা তর তর করে বেড়ে যাচ্ছে।
তাই তিনি আমাদের জ্ঞান দিতে পারেন স্বাধীনতা দিবসের থিম নিয়ে। অনলাইন শপিং করতে করতে, অ্যাপ দিয়ে খাবার অর্ডার করে ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা বাড়ি থেকে কাজ করতে করতে, খুব সহজেই দেশের সাবর্ণ হিন্দু উচ্চবিত্ত আর শহুরে মধ্যবিত্তরা সেই থিম নিয়ে টুইট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দেবে যে সত্যিই তাঁরা তাঁদের দেশ কে কত ভালবাসেন। এবং অবশ্যই মোদী কে ধন্যবাদ দেবেন তাঁদের স্বাধীন করার জন্যে, মানবতা বোধ থেকে, চক্ষু লজ্জা থেকে। তাই এইবার মোদী সাহেব কৃষক আন্দোলনের ভয়ে শিপিং কন্টেনার দিয়ে লাল কেল্লার সামনে দেওয়াল বানিয়ে তবেই সেখানে ভাষণ দিতে যাবেন। কারণ গরিব কৃষকেরা নাকি সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারছেন না। তাঁরা আজ অযথাই গোল পাকাচ্ছেন। বাড়ি গিয়ে অনলাইন শপিং না করে দিল্লীর সীমান্তে বসে মোদী সরকার কে শাসাচ্ছেন।
আগামী দিনে যখন লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, কৃষির সর্বনাশ, কোটি কোটি দলিত, আদিবাসী, নমঃশূদ্র, সংখ্যালঘু মানুষের বেনাগরিক হয়ে যাওয়ার ফলে দেশজোড়া এক বিক্ষোভ ধূমায়িত হবে, যখন গরিব পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে ভাত চাইবে, যখন কর্মহীন মানুষ কাজ চাইবে, যখন কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্য দাম চাইবে, যখন নারীরা, দলিতেরা, সংখ্যালঘুরা, আর শোষিত জনজাতির মানুষ সাম্যের দাবি করবে, তখন কি স্বাধীনতার টোপ কাজ করবে? নাকি য়েতি নরসিংহানন্দ বা যোগী আদিত্যনাথ কে ব্যবহার করে মোদী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ভিত্তিতে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে সেই মানুষগুলো কে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চিরকালের মতন এবারও পার পেয়ে যাবেন?
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়? এই চির সত্যটি কে আজ নতুন করে দেখার সময় এসেছে। কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দি সিনেমা, কিছু সংবাদ মাধ্যমের চিরাচরিত স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় ব্যাখ্যা, কিছু নেতা আর মন্ত্রীদের ভাষণ, সরকার আর বিরোধীদের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে একে অপর কে স্বাধীনতার শত্রু বলে গাল দেওয়ার মতন বাসি স্ক্রিপ্টের বাইরে, খেটে খাওয়া মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার, কাজের অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, নারী ও শিশুদের সুরক্ষিত থাকার অধিকার কায়েম না করে কী রকম স্বাধীনতা পালন করবেন ভারতবাসী আর কেনই বা করবেন? পছন্দের ব্র্যান্ডের থেকে আজাদী অফার পেতে এমন সময়ে যখন “আজাদী” কথাটাই দেশবিরোধী বলে চিহ্নিত হয়েছে? এই নিয়ে শুধু ভেবে লাভ নেই, ভাবনা কে কাজে লাগাতে হবে, সমাজ কে বুঝে তাকে পরিবর্তনও করতে হবে।