নয়া দিল্লীর যন্তর মন্তর। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারতের রাজধানী শহরের বুকে একমাত্র আইনী বিরোধ প্রদর্শনের জায়গা। একদিকে চলছে কিসান সংসদ, অর্থাৎ কৃষকদের নিজেদের পার্লামেন্ট, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের পাশ করা তিনটি বিতর্কিত কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন দেশের নানা কোন থেকে আসা কৃষকেরা, আর অন্যদিকে শাসক দল কে মদদ করতে দলে দলে ভাড়াটে হার্মাদ বাহিনী এনে অশ্বিনী উপাধ্যায় আর গজেন্দ্র চৌহানের মতন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী গুন্ডারা রাজধানী দিল্লী শহর জুড়ে মুসলিমদের কচুকাটা করার হুমকি দিচ্ছে। এই নিয়ে নানা মূলধারার সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে, নিতান্তই বাধ্য হয়ে দিল্লী পুলিশ, যা বিজেপির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও মোদীর ডান হাত অমিত শাহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, জানিয়েছে যে অজ্ঞাত পরিচয়ের কিছু লোকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। এই হল হিন্দুত্ব বাদী রাষ্ট্রের প্রহসনের নমুনা।
কিসান সংসদ যেহেতু মোদী বিরোধিতার পারদ তুঙ্গে তুলেছে, বিগত আট মাস ধরে তিনটি কৃষক মারা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ও নতুন আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-তে কৃষি পণ্য কেনা বাধ্যতামূলক করার দাবিতে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা যেহেতু দিল্লীর তিনটি সীমান্ত কে কার্যত মুক্তাঞ্চল বানিয়ে ফেলেছেন, তাই রাজধানী ও উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাট অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন লাগাতে বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) উঠে পড়ে লেগেছে। তারই ফল স্বরূপ ৮ই আগষ্ট ২০২১ দেখা গেল যন্তর মন্তরে এই বিনা অনুমতিতে, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনিতে বাঁধা সংসদ মার্গে অনুষ্ঠিত এই হিন্দুত্ববাদী উপদ্রব।
য়েতি নরসিংহানন্দ নামক গাজিয়াবাদের দাস্না মন্দিরের পুরোহিত ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কুখ্যাত এক চরিত্রের শিষ্যরা এই জমায়েতে স্লোগান তোলে “যব মুল্লে কাটে জায়েঙ্গে, তো রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে” (যখন মুসলিমদের কাটা হবে তখন তাঁরা রাম-রাম বলে চিৎকার করবে) এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক, গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া স্লোগান। এই ঘটনার ভিডিওগুলো প্রকাশ্যে আসার পর থেকে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী লোকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় “বেশ করেছে, আবার হবে” গোছের কথা বলছেন।
উপাধ্যায় ও চৌহান বিজেপির পরিচিত কুখ্যাত নেতা হওয়া সত্ত্বেও দিল্লী পুলিশ প্রথমে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেদের বিরুদ্ধেই মামলা করে। এই রকম অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেদের বিরুদ্ধে মামলা করার মানে হল যে কোনো দিন, যে কোনো ব্যক্তি কে এই কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার রাস্তা খোলা রাখা। পরে দিল্লী পুলিশ চাপে পড়ে উপাধ্যায় আর তাঁর চার সাঙ্গপাঙ্গ কে আটক করেছে কিন্তু গ্রেফতার করেনি। তাই নিয়েও বিজেপির উগ্র সমর্থকেরা তাঁদের অসন্তোষ গোপন করেননি। পরে অবশ্য যথারীতি উপাধ্যায় জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসেন। কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান থেকে শুরু করে দিল্লীর ছাত্র নেতা উমর খালিদ, মিরান হায়দার, প্রভৃতি আজও জেলে বন্দী। তাঁদের মুক্তির প্রশ্ন তোলাও যেন দেশদ্রোহ।
“ভারত জোরো আন্দোলন” নামের এই রাজনৈতিক সমাবেশ ঠিক কিসান সংসদের সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণ যেমন বোঝা যাচ্ছে তেমনি রাজধানী দিল্লীর উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব জেলায় বসবাসকারী সংখ্যালঘুরা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছেন, কারণ ২০২০ সালের দিল্লী মুসলিম নিধন যজ্ঞের সময়ে এই ভাবেই মুসলিম বিরোধী রণ হুংকার দেওয়া শুরু করেছিল বিজেপি নেতারা। আর তখনো প্রশাসনের ভূমিকা বর্তমানের চেয়ে কিছু আলাদা ছিল না। তখনো প্রশাসন শুধু নির্বিকার ছিল না, বরং দেখা গেছে বেছে বেছে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করতে দিল্লী পুলিশ আরএসএস-পরিচালিত হার্মাদ বাহিনী কে মদদ করেছে আর পরে, মুসলিম গণহত্যার দায় চাপিয়ে মুসলিম রাজনৈতিক কর্মীদেরই গ্রেফতার করেছে। খালিদ, হায়দার থেকে শুরু করে অসংখ্য মুসলিম রাজনৈতিক কর্মীদের, বিশেষত নারীদের গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে বন্দী করে রেখেছে। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তোলা হয়েছে তাঁদের নামে।
ধরুন, যদি দিল্লীর বুকেই, ওই যন্তর মন্তরেই একটি মুসলিম সংগঠনের লোকেরাও “ভারত জোরো” বলে একটি সভা করতেন আর তার থেকে হিন্দু মারার ডাক দেওয়া হত। তাহলে ভারতের সংবাদমাধ্যম, পুলিশ প্রশাসন, প্রভৃতি কি চুপ থাকতো? কোনো অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকের বিরুদ্ধে কি মামলা রুজু হতো? নাকি দেশের সুরক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত করার দায়ে তখনই বেআইনি কার্যকলাপ (নিরোধ) আইন বা ইউএপিএ জাতীয় কালো আইন ব্যবহার করে জেলে বন্দী করা হতো প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী কে? কী বলে চিৎকার করে উঠতেন “জাতি জানতে চায়” গোছের টেলিভিশন সঞ্চালকরা?
অথচ আজ সেই রাজধানীর বুকেই খোলাখুলি গণহত্যার ডাক দিয়ে, দেশের বিপন্ন হওয়া সংখ্যালঘুদের কচুকাটা করার কথা বলে তাঁদের আরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে, জনগণের মধ্যে হিংসা আর বিদ্বেষের বীজ বপনকারী উপাধ্যায় বা চৌহান কে কি পুলিশ বেশি দিন বন্দী রাখবে না সত্ত্বর জামিনে বের হওয়ার রাস্তা করে দেবে? তাঁদের কি আর ইউএপিএ দেওয়া হবে? নাতাশা নারওয়াল আর দেবাঙ্গনা কলিতার মতন তাঁদের কি মাসের পর মাস বন্দী রাখা হবে? নিজের নামের আগে “রাম ভক্ত” উপাধি ব্যবহার করা ব্রাক্ষণ সন্ত্রাসী গোপাল শর্মা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের সামনে এক কাশ্মীরি ছাত্র কে গুলি করে বাইরে ঘুরে বেরিয়েছে কলার তুলে। মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়ায় তাঁর উপর পুলিশ হাল্কা কেস দেয় আর গ্রেফতার করে। কিন্তু সবাই জানে বিজেপির এই সমর্থকেরা, যাঁরা খোলাখুলি মোদী ও যোগী আদিত্যনাথ কে সমর্থন করে, তাঁদের কেউই বন্দী করে রাখতে পারবে না।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা পালনের তাগিদ সংখ্যালঘুদের নয়, সংখ্যাগুরুর। অথচ কোনো হিন্দু সংগঠনই এই সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজ কে রাজনৈতিক ভাবে জাগিয়ে তুলছে না। কেন? কারণ, ভারতের মাটিতে হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক কে মেরুকরণ করে তাঁদের মধ্যেকার সুপ্ত মুসলিম বিদ্বেষ কে জাগিয়ে তুলেছে বিজেপি আর আরএসএস। ফলে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদই এখন হিন্দু ধর্মের, সকল জাতির মানুষ কে, নিজের কুক্ষিগত করেছে। তাহলে এর থেকে বের হওয়ার পথ কী? সেই পথ দেখিয়েছে দেশের কৃষকেরা। কী করে আরএসএস আর বিজেপি কে পর্যদুস্ত করতে হয়, সেই শিক্ষা আজ তাঁদের থেকে নেওয়া উচিত।