আনিস খাঁন নামক এক ছাত্র নেতা ও রাজনৈতিক কর্মীর হত্যাকাণ্ডে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন তোলপাড় শুরু হয়েছে। আনিস খাঁনের হত্যার অভিযোগের তীর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে তাক করা হলেও, সেই দলের নেতারা অভিযোগ খণ্ডন করেছেন ও “নিরপেক্ষ তদন্তের” আশ্বাস দিয়েছেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ-র ছাত্র, বছর ২৩-এর খাঁন দীর্ঘদিন ধরে নানা গণআন্দোলনের সাথে, বিশেষ করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি)-বিরোধী আন্দোলন ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের, জড়িত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ফলে বহু গণসংগঠন এবং বিরোধী বামফ্রন্ট পথে নেমেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে।
আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা
গত ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারির মাঝরাতে, খাঁনের হাওড়া জেলার আমতা থানার সারদা গ্রামের দক্ষিণ খাঁন পাড়ার বাড়িতে হঠাৎ নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে চড়াও হয় একদল লোক। তারা সংখ্যায় ছিলেন চারজন——যদিও পুলিশে করা আনিস খাঁনের হত্যার অভিযোগে তাঁর বাবা সালেম খাঁন ছয়-সাতজনের উল্লেখ করেন——যাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সিভিক ভলান্টিয়ারের পোশাকে আর একজন রাজ্য পুলিশের খাকি উর্দি পরিহিত। এই খাকি উর্দিধারী খাঁনের বাবার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দরজা খোলায় ও তারপরে তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকে সবাই কে মারধর করা শুরু করে খাঁনের খোঁজ করার অছিলায়। বাড়ির মহিলাদেরও ছাড় দেয়নি তারা।
শুক্রুবার, ১৮ই ফেব্রুয়ারির রাতে একটি ইসলামিক জলসা থেকে ফিরে খাঁন সেই সময়ে তাঁর বাড়ির দোতলায় ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে ধরে পেটাতে শুরু করে সিভিক ভলান্টিয়ারের পোশাক পরিহিত তিনজন আর তারপরে, তাঁর পরিবারের অভিযোগ অনুসারে, খাঁন কে টেনে হিঁচড়ে নির্মীয়মাণ তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হয় ও ওখানে মারধর করার পরে তাঁকে উপর থেকে নিচে ছুড়ে ফেলা হয়। এর পরে সেই তিনজন সিভিক ভলান্টিয়ারের পোশাক পরিহিত লোকেরা এসে খাকি উর্দিধারী কে জানায় যে “স্যার, কাজ হয়ে গেছে”, ও তারা সেখান থেকে চলে যায়।
উপর থেকে কিছু ভারী পড়ার আওয়াজে বিহ্বল খাঁনের বাড়ির লোকেরা এই পুলিশের উর্দিধারীদের চলে যেতেই দৌড়ে বাড়ির থেকে বের হয়ে দেখেন যে বাইরে তাঁর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। তাঁকে সেই রাতেই হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার সেবাব্রত নার্সিং হোমে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে। খাঁনের বাবা ফোনে আমতা থানার পুলিশকর্মীদের শত অনুরোধ করলেও কেউই থানার থেকে সেই রাতে তাঁর গ্রামে যায়নি।
আনিস খাঁনের হত্যার অভিযোগ কেন তৃণমূল কংগ্রেসেরই বিরুদ্ধে?
বহুদিন ধরেই দক্ষিণ খাঁন পাড়ায় খাঁনের বাড়িই একমাত্র বামফ্রন্টের প্রধান শরিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] সমর্থক হিসাবে পরিচিত। এর আগে খাঁন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের (এআইএসএফ) নেতৃত্বে ছিলেন। তার সাথে অতি-বাম রাজনীতিরও সম্পর্ক ভাল ছিল। এর পরে তিনি আব্বাস সিদ্দিকীর সারা ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট (আইএসএফ) কর্মীও হন। এর সাথে সাথে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস আর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধীতা করেন ও তাঁর বুথের পার্টে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার কমে যায়। এর ফলে স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস বুথ সভাপতি ও স্থানীয় কুশবেড়িয়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মালেক খাঁন আনিস খাঁনের উপর বেজায় চটে যায়।
গত ২৪শে মে ২০২১-এ খাঁন আমতা থানায় একটি চিঠি দেন যার প্রতিলিপি তিনি রাজ্যের গৃহ সচিব, রাজ্যপাল থেকে শুরু করে নানা মানবাধিকার সংগঠনের কাছেও পাঠান। চিঠিতে খাঁন নিজের প্রাণহানির আশংকা প্রকাশ করেন ও জানান যে ২২শে মে ২০২১-এ তিনি তৎকালীন করোনা ভাইরাসের প্রকোপে হওয়া রক্ত সঙ্কট কাটানোর জন্যে একটি রক্তদান শিবির করবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময়, ২১শে মে ২০২১-এ মালেক খাঁন, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মাসুদ খাঁন আর অন্য তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা শাঁসানি দেয়। এর পরে, সেই সন্ধ্যায় তাঁরা খাঁনের বাড়ি আক্রমণ করে ও বাড়ির সবাই কে মারধর করে ও দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে।
এর পর খাঁন বাড়ি ছাড়া হলেও, তিনি অভিযোগ করেন যে ২৩শে মে ২০২১-এ জাহাঙ্গীর খান আর আলী হোসেন খান নামক দুইজন তাঁর কাকা কে মারধর করে ও সন্ধ্যা বেলায় মেহবুব খাঁন (মধু), রাজা খাঁন, আতি খাঁন সহ অনেকেই তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করে ও গোয়ালঘর ভেঙে দেয়। এই চিঠির ভিত্তিতে আমতা থানার পুলিশ বা রাজ্য প্রশাসন কোনো অভিযোগ নথিভুক্ত করেনি, দোষীদের গ্রেফতার করা তো দূরের কথা। ফলে খাঁন কে বাড়ির থেকে পালিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের হামলা থামেনি। জুন মাসেও তাঁদের বাড়িতে বহুবার হামলা চালায় স্থানীয় শাসকদলের দুষ্কৃতীরা।
আনিস খাঁনের চাচী (কাকীমা) আলেয়া বেগম, ১৮ই জুন ২০২১-এ এই বিষয়ে আমতা থানা কে প্রমাণ (বাড়ির উপর আক্রমণের ছবি ও বিবরণ) সহ অভিযোগপত্র দিলেও, ও সেই চিঠির প্রতিলিপি মুখ্যমন্ত্রী, গৃহ সচিব, মানবাধিকার কমিশন, জেলা শাসক, প্রভৃতিকে পাঠালেও, কোনো সুরাহা হয়নি। পুলিশী মদদ পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের দাপট দিন দিন বেড়েই গেছে আর সাধারণ গ্রামবাসীদের এই সন্ত্রাসের আবহাওয়ায় ভয়ে চুপ করে থাকতে হয়েছে।
দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় পড়ে থাকলেও খাঁনের বাড়ি যাওয়ার দীর্ঘদিনের বাসনা ছিল ও বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের থেকে সমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়ে তিনি নিজের বাড়ি ফিরে যান ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু করেন অঞ্চলের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা নার্সিং হোম আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার নাম করে জনগণের ঘাড় ভেঙে বিরাট অঙ্কের টাকা নেওয়ার বিরুদ্ধে। সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে রুগীদের শোষণ করার বিরুদ্ধে জনমত গড়ার কাজ করেন আনিস খাঁন এবং সাথে সাথে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চারও থাকেন।
এহেন ইতিহাস ও ঘটনাবলীর ফলে আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনায় সন্দেহের কাঠগড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসকেই দাঁড় করানো হয়েছে, যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও আপাদমস্তক ব্রাক্ষণত্ববাদী তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ মুসলিম চেহারা, কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম (ববি) এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশও দিয়েছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে বন্দোপাধ্যায় বলেন, “আনিসের ব্যাপারে সরকার নিরপেক্ষ তদন্ত করবে। এটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। দোষীদের ছেড়ে দেওয়া হবে না। জীবন ফিরিয়ে দিতে পারব না। সেটা তো আমার হাতে নেই। তবে পরিবার আমাদের উপর আস্থা রাখুক। এর কোনও ক্ষমা নেই।” তিনি আরও বলেন যে খাঁন নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের সাথেও যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। “আনিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ভাল ছিল। যাঁরা এখন টেলিভিশনে দর্শন দিতে গিয়েছেন তাঁরা জানেন না আনিস আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি আমাদের সাহায্যও করেছিলেন।”
কিন্তু যদি আনিস খাঁন তৃণমূল কংগ্রেস কে সহায়তা করে থাকেন তাহলে কেন তাঁর বাড়িতে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব হামলা করছিলেন এক বছর আগে? কেন তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বন্দোপাধ্যায়ের পুলিশ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর মধ্যে নানা ধরণের ঘটনার ফলে আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদও তুঙ্গে উঠেছে।
আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা নিয়ে পুলিশের ভূমিকা
সিট গঠনের আগে, রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী হিসাবে বন্দোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যে এই ঘটনার তদন্ত হাওড়ার পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) সৌম্য রায় করবেন। কিন্তু যেহেতু রায়ের স্ত্রী অরুন্ধতী (লাভলী) মৈত্র তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক, যে কারণে তাঁকে নির্বাচনের সময়ে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তাই তাঁর নেতৃত্বে হওয়া তদন্ত কী করে “নিরপেক্ষতার” মুখোশ ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন গণআন্দোলনের ময়দানে আনিস খাঁনের সঙ্গীরা।
এর পরে চাপে পড়ে সিট গঠন করেন বন্দোপাধ্যায়, যদিও সেই সিটে নাকি পুলিশও থাকবে। অন্যদিকে রায় দাবি করেন যে খাঁনের নামে নাকি শিশুদের যৌন শোষণের ধারায় (পকসো) মামলা ছিল। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা কে জানিয়েছেন যে খাঁনের নামে বাগনান আর আমতা থানায় মামলা ছিল আর তার মধ্যে আমতা থানায় পকসো ধারায় মামলা ছিল ও সমনও গেছিল তাঁর বাড়িতে। খাঁনের গণআন্দোলনের সহকর্মীরা এই অভিযোগ খণ্ডন করেছেন ও বলেছেন এই ভাবে রায়ের নেতৃত্বাধীন পুলিশ তদন্তের গতিমুখ ঘুরিয়ে দিতে চাইছে দোষীদের আড়াল করতে।
এর সাথে সাথে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে আনিস খাঁনের হত্যার অভিযোগ দায়ের করা কে কেন্দ্র করে। যদিও প্রথমে খাঁনের ভাগ্নি মুস্কান খাঁনের নামে একটি অভিযোগ পত্র জমা দেওয়া হয় হত্যাকাণ্ডের পরে, যাতে খাঁনের ২০২১ সালে লেখা চিঠির উল্লেখ যেমন ছিল তেমনি বাড়িতে তৃণমূল কংগ্রেসের হামলার কথাও ছিল। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এর পরে স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা থানায় যায় বলে অভিযোগ, এবং তাঁরা সেখানে গিয়ে জোর করে সালেম খাঁন কে অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের নামে অভিযোগ করতে বলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের নাম আর তাঁর উপর আগের হামলার ও হুমকির কথা বাদ দেওয়ার পরে পুলিশ অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে।
পুলিশের এইরূপ দলদাসের মতন ব্যবহার করার ঘটনা ছাড়াও একটি ব্যাপারে সবাই উদ্বেগে আছে আর তা হল খাঁনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। অভিযোগ উঠেছে যে খাঁনের বাড়ির লোকের সামনে ময়নাতদন্ত করা হয়নি আর তার কোনো ভিডিও বানানোও হয়নি। এর পরে কানাঘুষা দক্ষিণ খাঁন পাড়ার বাসিন্দারা শোনেন যে ময়নাতদন্তে নাকি খাঁনের মুখে মদের গন্ধ পাওয়া গেছে। এই নিয়ে সেখানে আরও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
বলা হচ্ছে এই অঞ্চলের ময়নাতদন্তে বারবার শাসকদলের লোকেদের আড়াল করার নাকি বন্দোবস্ত করা হয়ে থাকে। গ্রামবাসী ও খাঁনের সহযোদ্ধাদের সন্দেহ যে কায়দা করে খাঁন মদ খেয়ে মাতলামি করছিল বলে পুলিশ তাঁর বাড়িতে তাঁকে ধরতে গেলে সে পালাতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ছাদ থেকে পড়ে যায়, এহেন গল্প পুলিশ নিজেদের লোকেদের বাঁচাতে ফাঁদতে পারে। যদিও এখনো পর্যন্ত আমতা থানা স্বীকার করেনি যে উর্দিধারীরা সেই রাতে খাঁনের বাড়িতে গেছিল তারা পুলিশের লোক।
তৃণমূল কংগ্রেসের ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে নানা মহলের মোহ
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের কোনায় কোনায় বিজেপি যখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছে, তখন সেই বিজেপি কে খাল কেটে কুমির আনার মতন যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে এনেছিল, সেই দল কে “লেসার ইভিল” বা কম পাপী চিহ্নিত করে “নো ভোট টু বিজেপি” বা বিজেপি কে একটাও ভোট নয় বলে একটি আন্দোলন রাজ্যে শুরু হয় ২০২০ সালের শেষ থেকে যা এপ্রিল ২০২১-এর মধ্যে ব্যাপক একটা রূপ ধারণ করে। যদিও এই “নো ভোট টু বিজেপি” একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল ও বিজেপির বিরোধী কে সেই প্রশ্নটির প্রসঙ্গে একটি সুবিধাবাদী অবস্থান নেয়, তাদের ঘাড়ে চেপেই তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ব্যাপক গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষের ভোট পেয়ে যায় বিজেপির জূজূ দেখিয়ে।
২০০৭ সালে কলকাতার এক মাড়োয়ারি পুঁজিপতির মেয়ের সাথে প্রেম করে বিয়ে করার কারণে মুসলিম কম্পিউটার শিক্ষক রিজওয়ানূর রহমান কে পুলিশের আর বামফ্রন্টের মাথায় বসা সিপিআই (এম) নেতৃত্বের সহযোগিতায় হত্যা করে মেয়ের পরিবার বলে অভিযোগ ওঠে। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্র হয় আর বন্দোপাধ্যায় এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুসলিম ভোটের মেরুকরণ করে ক্ষমতায় আসেন ২০১১ সালে।
দীর্ঘ ১১ বছরের শাসনের পরেও, যে রহমানের লাশের উপর রাজনীতি করে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই রহমানের কেসে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) চার্জশিট জমা পড়লেও, আজ অবধি কোনো অভিযুক্ত শাস্তি পাননি। রহমানের ভাই কে নির্বাচনে টিকিট দিয়ে, পরিবার কে চুপ করিয়ে বন্দোপাধ্যায় চিরকালের মতন রহমান কে কবরে পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনার থেকে। আর আজ বিজেপির জূজূ দেখিয়ে, একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী অভাব কে কাজে লাগিয়ে বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে সেই একই ফর্মুলা ব্যবহার করে আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা কে চাপা দিয়ে দেবেন না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
যদিও অনেক তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী ও গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের সমর্থক সাজা লোকেরা আনিস খাঁনের হত্যার বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু যে ভাবে উত্তর প্রদেশ বা দিল্লী শহরে এই রকম ঘটনা ঘটলে তাঁরা বিজেপির সরকার কে দায় করেন, তেমনি এই রাজ্যের ক্ষেত্রে বন্দোপাধ্যায় কে করছেন না। অনেকে এই ঘটনার সাথে উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের ফ্যাসিবাদী শাসনে ঘটিত নিরপরাধ মুসলিমদের হত্যার তুলনা করলেও একবারের জন্যেও বলছেন না যে যেহেতু বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের গৃহ মন্ত্রী তাই এই রাজ্যের মধ্যে একটি ছাত্র নেতার হত্যার দায় তাঁকেই নিতে হবে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই কলকাতা শহরে চাকরির দাবিতে সিপিআই (এম) এর যুব সংগঠনের হয়ে মিছিলে আসা মঈদুল ইসলাম মিদ্দা কে যখন পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছিল রাজপথে, তার দায়ও মুখ্যমন্ত্রীর। কিছুদিন আগেই যখন দেউচা পচামিতে আদিবাসীদের জমি দখল করে কয়লা খনি গড়ার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তখন তাঁদের উপর দমন পীড়নের দায়ও বন্দোপাধ্যায়ের। তেমনি তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে “যোগাযোগ” থাকলেও, যেহেতু তিনি লিখিত ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন ও নিজের প্রাণহানির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তাই আনিস খানের হত্যার দায়ও বন্দোপাধ্যায়ের সরকার কে নিতে হবে যতদিন পর্যন্ত না তথ্য ও প্রমাণ দিয়ে সরকার আদালতে প্রমাণ করতে পারে যে এই অপরাধের সাথে শাসক দল বা পুলিশ জড়িত নয়।
এত সত্ত্বেও যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে মোহ রেখে তারপরে আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় করছেন, তাঁরা একপ্রকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক ধৃষ্টতা করছেন।
সামনের পথ কী?
আনিস খাঁনের হত্যার তদন্তের জন্যে সিট গঠন হলেও এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া, দোষীদের আইন অনুসারে শাস্তি হওয়া ও মৃতের পরিবারের ন্যায় পাওয়ার সম্ভাবনা ভীষণই দুর্বল। তবুও সরকারের কথার উপর ভরসা না করেই অনেক ছাত্র সংগঠন আন্দোলনের পথে নেমেছেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পথে নেমেছেন ন্যায়ের দাবিতে ও ছোট্ট সারদা গ্রামের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আজ জাতীয় খবর হয়ে গেছে।
তবুও এই দেশের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে শক্তিশালী অপরাধীর বিরুদ্ধে দুর্বলের করা অভিযোগ শাসন ব্যবস্থার ভিতর কোনোদিনই টিকে থাকে না আর শেষ পর্যন্ত ন্যায় অধরাই থেকে যায়। বর্তমানে আনিস খাঁনের হত্যার পরে তাঁর বাবা-মা যে লম্বা সফর শুরু করলেন তা অনেক লম্বা আর কষ্টদায়ক। শেষ পর্যন্ত কে কে আনিস খাঁন আর তাঁর মতন অনেকের জন্যে পথে থাকবে সেটা যেমন দেখার তেমনি এটাও দেখার যে অন্যায়ের রোলার চালিয়ে কতদিন অবধি শাসক দলের লোকেরা খানের মতন প্রাণগুলো কে স্তব্ধ করে দিতে পারে। আনিস খাঁনের হত্যার ঘটনা হয়তো কোনো নতুন যুগের সূচনা করলো না কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় কে ও আপামর কর্মহীন যুবদের আজ এই হত্যাকাণ্ড দেখালো কী ভাবে তাঁদের কে আমের আঁটির মতন ব্যবহার করে শাসকেরা খরচের খাতায় আজ ফেলে দিতে চায়।
আনিস খাঁনের হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত তখনই সম্ভব যখন ছাত্র আন্দোলন ও নানা গণআন্দোলন সরকার কে এই বিষয়ে ক্রমাগত চাপে রাখতে পারবে। শুধু সিট গঠনের প্রস্তাব শুনেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে আনিস খাঁনের হত্যার তদন্ত কোনোদিনই সম্ভব হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল যে এই আন্দোলন কে কতদিন পর্যন্ত গণসংগঠনগুলো বা ছাত্র সংগঠনগুলো চালিয়ে রেখে, সরকারি সন্ত্রাস কে রুখে, ন্যায়ের দাবি তুলতে পারবেন?