নাড়িট সীমানা গড়া থেকে বাইকে দশ মিনিট যেতে আনিস খাঁনের গ্রাম, সারদা দক্ষিণ খাঁন পাড়া। ঢালাও পিচের ভাঙাচোরা রাস্তা, দুই পাশে বড় জমির ছোট-মাঝারি গাছপালার মধ্যে দিয়েই খাঁনের গ্রামে পৌঁছে গেছে। রাতের বেলা খুব একটা আলো পাওয়া যায় না এখানে, বাইক বা গাড়ির হেডলাইটেই রাস্তা বুঝে চলতে হয়। আনিস খাঁনের গ্রামে ঢোকার মুখেই পুলিশের ভ্যান এবং জলপাই উর্দির সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। যারা নজর রাখছে কে আসছে, কে যাচ্ছে গ্রামে।
গ্রামবাসীদের অনেকের মতে, পুলিশের বুকে গোপন ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। তাই অন্ধকার হলেই নাড়িট সীমানা গড়া থেকে কোনো টোটো বা ভ্যান চালকও আসতে চাইছে না এখানে চট করে। আনিস খাঁনের গ্রামে ঢুকে ওদের বাড়ি যেতে হয় দুই পাশে পুকুরের মাঝখানে উঁচু-নিচু আড়াই হাতের রাস্তা ধরে। মুখেই তাজপুর ক্লাব যার পাশেই খাঁনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরে কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে আলো লাগিয়ে গেছে।
এই ক্লাবের দিকে উঠে, ডান হাতের রাস্তা ধরে চলে এগোলেই আনিস খাঁনের ইটের গাঁথনি করা ন্যাড়া ছাদ আর বারান্দার তিনতলা বাড়ি, আর ঠিক ঐ ক্লাবের পাশের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গেলেই তাজপুর কালিতলা যেখানে বিধায়ক সুকান্ত পালের বাড়ি। যার সাথে ধৃত এক সিভিক ভলেন্টিয়ারের ছবি সামনে এসেছে। বিধায়ক পালের ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগের থেকেই নাকি রাগ ছিল আনিস খাঁনের উপর, ওই গ্রামের একমাত্র উঁচু গলার বিরোধী কণ্ঠস্বর বলে। অভিযোগ উঠেছে যে এই বিধায়কের নেতৃত্বেই নাকি গত বিধানসভা ভোটের পর খাঁনের বাড়িতে হামলা হয় এবং পাড়ার রক্তদান শিবির ও লকডাউনে বাচ্চাদের বিনা পয়সায় পড়ানোর কাজকর্ম বন্ধ করতে বাধ্য হন খাঁন।
আনিস খাঁনের পরিবার সহ গ্রামের অনেক মানুষ ইতিমধ্যেই এই বিধায়ক পাল, পঞ্চায়েত প্রধান হাসু খাঁন, উপপ্রধান মালেক খাঁন, আর হাওড়া (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার সৌম্য রায়ের গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন। প্রধান হাসু খাঁন, যিনি আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)], তারপরে কংগ্রেস ও বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেন, তাঁর সাথে আনিস খাঁনের প্রথম ঝামেলার সূত্রপাত হয়েছিল তিন বছর আগে, একটি বাড়ির জমি দখল কে কেন্দ্র করে। তা ছাড়াও, হাসু খাঁ আনিস খাঁনকে খুনের হুমকি দেন, যা গ্রামে তিনি ক্যামেরা সামনেই বিনা ভয়ে উঁচু গলায় বলেছেন।
তাই আনিস খাঁনের বাড়ির লোকের মতে নিচু তলার পুলিশ কর্মীদের চাপ দিয়ে এই ঘটনা রাজ্য সরকার ধামাচাপা দিতে চাইছে। আনিস খাঁনের উপর চড়াও হয়ে তাঁকে খুনের হুমকি দিয়েছিল তৃণমূলের নেতারা, কোনো নিচু তলার সিভিক ভলান্টিয়ার কিংবা হোমগার্ড নয়। এই নিয়ে অবশ্য ধৃত হোমগার্ড কাশীনাথ বেড়ার স্ত্রী আনিস খাঁনের পরিবারের পক্ষ নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) কে দিয়ে ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
আনিস খাঁনের হত্যাকাণ্ডে যে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস জড়িত থাকতে পারে, আর এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, তার একটা আভাস এই গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে। গ্রামবাসীদের একাংশ জানাচ্ছেন যে ঘটনার দিন রাতে জলসার ওখানেও আনিস খাঁনের উপরে দুই জন সিভিক ভলান্টিয়ার চড়াও হয় ও তাঁকে উদ্দেশ্য করে আজেবাজে কথা বলতে থাকে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ যে আমতা থানার সমস্ত সিভিক ভলান্টিয়াররা সক্রিয় ভাবে আগে থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাথে যুক্ত। আগে তাঁদের অনেকেই নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে নানা ধরণের কাজ করেছে আর এখন নাকি উর্দি পরে, শাসক দলের নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় গুন্ডামিও করে থাকেন।
ঘটনাচক্রে পুলিশ সুপার রায় হলেন এক তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক লাভলী (অরুন্ধতী) মৈত্রের স্বামী। তাঁর সাথে কথিত আনিস খাঁনের বাবা সালেম খাঁনের ঘটনার পরের কথোপকথনের রেকর্ডিং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায়, বেকায়দায় পড়ে রাজ্য সরকার কে তাঁকে ছুটিতে পাঠাতে হয়েছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আনিস খাঁনের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্যে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করেছেন, গ্রামবাসীরা এই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কারণ আমতা থানা আর পুলিশ সুপার রায়ের ভূমিকা কে তাঁরা প্রশ্ন করছেন। গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ তাঁরা নাকি সেই রাতে একই রকমের একটি পুলিশ দল কে বিধায়ক পালের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলেন।
গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রেখেছে ২০০-র বেশি আসন পেয়ে, যার মধ্যে বাগনান এবং আমতা বিধানসভা কেন্দ্রও আছে। অভিযোগ উঠেছে যে বিধায়ক পালের নাকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সাথে সক্রিয় যোগাযোগ আছে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের শিখন্ডী আরএসএস বিধানসভা ভোটের পরই তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার বিজয় কে স্বাগত জানায় আর জানায় যে আরএসএস-এর লোকেরা নাকি যে কোনো ভোট পার্টিতেই থাকতে পারে।
গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন পদ্ধতিতে অনেক রদবদল লক্ষণীয়। একদিকে বেসরকারিকরণের ফলে, লকডাউনের ফলে, কাজ হারিয়ে মানুষ যখন হন্য হয়ে রুজিরুটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন রাজ্য সরকার কর্ম সংস্থানের নামে, হাতে গোনা কিছু তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার বা হোমগার্ডের মতন অস্থায়ী চাকরি ধরিয়ে দিচ্ছে। অভিযোগ যে এই চাকরি পেতেও তৃণমূল কংগ্রেসের ঝাণ্ডা ধরা ছাড়াও বিপুল টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে কর্মপ্রার্থীদের। পুলিশের হাতে খুন হাওয়া লোকের পরিবারকেও সরকারি চাকরি নামে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ারের চাকরির টোপ দিচ্ছে।
আনিস খাঁনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের অভিযোগ যে তাঁর হত্যার পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি গত বিধানসভা ভোটের পরই রাজ্যের শাসক দল নাকি করেছিল এবং শুধু খাঁনই নয়, এইরকম ভাবে আরও অনেককেই খুন হতে হচ্ছে। খাঁনের সহকর্মীদের অভিযোগ যে শুধু হত্যাতেই রাজ্যের শাসক দলের সোয়াস্তি নেই, তারা এখন নাকি অপহরণের একটা দল বানিয়ে রাতের অন্ধকারে গুম করছে শ্রমজীবী মানুষের রুজিরুটির অধিকার নিয়ে কথা বলা রাজনৈতিক কর্মীদের। দুই-তিন দিন তাঁদের হাপিস করে দিয়ে তারপরে তাঁদের নামে মিথ্যে কেস সাজিয়ে, ধারার পর ধারা লাগিয়ে হাজত বন্দী করছে, যেমন – শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে মানুষকে সংগঠিত করা বোলপুরের টিপু সুলতানের ঘটনা, বীরভূমে কয়লাখনি গড়ার বিরুদ্ধে লড়াকু রাজনৈতিক কর্মীদের ঘটনা, জয়নগর বকুলতলার জীবন মন্ডল হাটের ঘটনা, প্রভৃতি।
আজ এদিকে জনতার অভিযোগ যে আনিস খাঁনের গ্রামে ছাত্র যুবদের শিক্ষার সুযোগ বা রুজিরুটির সুযোগ থাক বা না থাক, তাদের আছে পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের ছোট গুণ্ডা থেকে পরে উর্দিধারী বড় গুন্ডা হাওয়ার সুযোগ! আর আরেক দিকে আছে এই সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ, যা তাদের গ্রামের ছেলে আনিস খাঁন তাদের কে দেখিয়ে গেছে।
একমাত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই তারা পারেন তাদের ন্যায্য কাজের অধিকার আদায় করে আনিস খাঁনের লড়াই গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে এবং রাজ্যের শাসকদলের গুণ্ডাগিরি বন্ধ করতে, যাতে আর কোনো ছেলে কে আনিস খাঁনের মতন মরতে না হয়। প্রতিটা পরিবারের সন্তান যেন তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা সহ পরিবার নিয়ে রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমোতে পারে। তবে ভাল ঘটনা হল বর্তমানে আনিস খাঁনের ছোট ভাগ্নে ভাগ্নিরা দেখছেন যে কী ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাণনাশের হুমকির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন।
ইতিমধ্যেই হাইকোর্টের তৈরী এসআইটির নতুন দলের পুরানো ভাবে তদন্ত চালানোর প্রক্রিয়ায় গতকাল টিআই প্যারেডের পর পুলিশ আনিস খাঁনের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে এবং শনিবার, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভোররাতে পুলিশ তাঁর বডি চুরি করতে এসে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে ফিরে গিয়ে, আগামী সোমবার, ২৮শে ফেব্রুয়ারি আনিস খাঁনের দেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের কথা জানিয়েছে হত্যার ঠিক ১১ দিন বাদে।
রাজ্যের মানুষকে আজ পুলিশ যতটা বন্দী করছে তার থেকেও বেশি গ্রাম থেকে শহরে মানুষ শাসকদলের সন্ত্রাস কে ঘিরে ফেলছেন বলে আন্দোলনরত মানুষ দাবি করছেন। শাসকদলের সমস্ত গুণ্ডামির সামনে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ছেন জনগণ। আনিস খাঁনের হত্যার পর সারদা দক্ষিণ খাঁন পাড়া পুরো রাজ্যকে আজ তা দেখিয়ে দিচ্ছে।