Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the wp-hide-security-enhancer domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the wpau-yt-channel domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the blog-designer-pack domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114
হাওড়ায় দাঙ্গা – কী ভাবে ইসলাম-বিদ্বেষী প্রচার গোপন করলো আসল ঘটনা কে | পিপলস রিভিউ বাংলা - People's Review Bangla

দেশ জুড়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-এর (আরএসএস) হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন এবং মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারের পশ্চিমবঙ্গের উপর প্রভাব দেখা গেল শুক্রুবার, ১০ই জুন ২০২২-এ, যখন রাজ্যবাসী জানলেন যে হাওড়া জেলার ধুলাগড়, অঙ্কুরহাটি, রাণীহাটি, পাঁচলা ও উলুবেড়িয়া সংলগ্ন অন্যান্য এলাকা গুলিতে নাকি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে! হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আর তাদের পেটোয়া সংবাদ মাধ্যমের প্রচারে রাজ্যের মানুষ কে জানানো হয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা নাকি হাওড়ায় দাঙ্গা করছে, “তান্ডব” করে বেড়াচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) থেকে সাসপেন্ড হওয়া প্রাক্তন মুখপাত্র নুপুর শর্মার (আরএসএস সক্রিয় কর্মী) শাস্তির দাবিতে। প্রসঙ্গতঃ ইসলাম ধর্মের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কটূক্তি করেন শর্মা। 

সত্যি কি হাওড়ায় দাঙ্গা করেছে মুসলিমরা? আন্দোলনের নামে “তান্ডব” করেছে তারা নাকি এইরকম অপপ্রচার কে হাতিয়ার করেই বিজেপির মতন রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক মুনাফা লুঠ করার চেষ্টা চালাচ্ছে? সর্বোপরী মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে “হিন্দু খতরে মে হে”- মার্কা ট্যাগ লাইন সেঁটে দিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভেতরকার ধর্মীয় সত্ত্বা জাগিয়ে তুলে মুসলিম গণহত্যার ছক সাজানো হচ্ছে না তো? ঠিক আগেও যেমনটা হয়ে এসেছে, আরএসএস-বিজেপির নেতৃত্বে সারা দেশ জুড়ে? তাই অগত্যা আমরা বেড়িয়ে পড়লাম পিপলস রিভিউ-র (বাংলা) পক্ষ থেকে, তৃণমূলস্তরে গিয়ে, তদন্ত করে, আসল তথ্য বের করে আনতে।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এটা জানার যে একটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনতা—যাঁরা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিপীড়িত— ঠিক কতটা “তান্ডব” (সরকারী পরিভাষায়) করে, হাওড়ায় দাঙ্গা করে নিজেদের আরো বিপদ ডেকে আনার চেষ্টা করছে তা সেই অঞ্চলে গিয়ে, দেখে শুনে পিপলস রিভিউ-র (বাংলা) পাঠকদের সঠিক বার্তাটা পৌঁছে দিতে।

আমরা চলে এলাম অঙ্কুরহাটি পেরিয়ে ধুলাগড়। সেখানে দেখা গেল একটা পরোটার দোকানে ফরিদ (চাচা) ও সুমন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন, আর তাঁদের ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে একটা ট্রাফিক গার্ড পোস্ট, যার কাঁচ ভেঙে নীচে পড়ে আছে। ফরিদ আর সুমনের কাছে শুনলাম সেই পোস্টের কাঁচ বিক্ষোভের দিন ভাঙা হয়েছে, ভেঙেছে বিক্ষোভকারী জনতা। শর্মার শাস্তির দাবিতে  বিক্ষোভের সময়ে বিক্ষোভকারী মুসলিমদের উপর পুলিশ ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র‌্যাফ)-এর লাঠি চালানোর পরের মুহূর্তে ক্ষুব্ধ জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে সরকারি সম্পত্তি ভেঙেছে। 

ফরিদ আর সুমন প্রায় একই সুরে আর একই ভাষায় বললেন যে এটা কোন ধর্ম কিংবা জাতের কারণে হয়নি, সেইদিন মানুষ রাগ দেখিয়েছে পুলিশের হুজ্জুতির বিরুদ্ধে। ফরিদ আর সুমন জানালেন শুক্রুবারের পরে, শনিবার, ১১ জুনের ঐ বিক্ষোভ সমাবেশে সেখানে প্রায় দেড়-দুই হাজার মানুষের জমায়েত হয়েছিল, যার মধ্যে হিন্দুও ছিল অনেক। তাঁরাও মুসলিমদের সাথে ঐ বিক্ষোভে যোগ দেন শর্মার গ্রেফতারির দাবিতে।

সেখান থেকে আরও একটু সোজা এগিয়েই ধুলাগড় মার্কেট, টোলট্যাক্স গেট। সেই গেটের ভাঙা কাঁচ এখনো পড়ে আছে রাস্তাতেই। সামনেই একটা ভ্যান স্ট্যান্ড। পরিচয় হল কিছু ভ্যান চালকদের সাথে। তাঁদের মধ্যে থেকে দুই জন কথা বলতে এগিয়ে এলেন আমাদের সাথে। একজনের নাম সেলিম আর একজনের নাম সনৎ। তাঁদের  মুখ থেকে জানতে পারলাম ১১ জুনের এই বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল সকাল ১১টার থেকে। সেই সমাবেশ শেষ হয়েছিল ঐদিন সন্ধ্যা ৬ টা’র দিকে। অবশ্য সেলিম ও সনৎ ও জানালেন যে জাত-ধর্ম নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। বললেন, বিক্ষোভের কারণ ছিল দেশ জুড়ে মুসলিমদের উপর নেমে আসা অত্যাচার এবং নবীর নামে বিজেপি নেত্রীর কটুক্তির প্রতিবাদ। তবুও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দিকে তেড়ে-ফুঁড়ে আসে বিক্ষোভ হটাতে।

আশে-পাশে দেওয়ালে সেসব পোস্টার এখনো দেখা যাচ্ছে। সেদিনের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছিল। পরে পুলিশ আর র‌্যাফ লাঠি চার্জ করাতেই এসব ভাঙচুর হয়েছে। সনৎ বললেন, সেলিমের আত্মীয় খোকন’কে শিবতলা বাজারে চার-পাঁচজন মিলে বেলা ১১.৩০-১২টা নাগাদ ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে মারধর করে। এই খোকনের বাম হাত ভেঙে গেছে ও মাথা ফেটে গেছে সেদিনের মার খেয়ে। খোকন এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।সেই ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা ছড়ায় কিন্তু পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ছিল। 

কিন্ত এই শিবতলা বাজার কোথায় তবে? ধুলাগড় মার্কেটের বিপরীতের রাস্তা টপকে বাম দিকে দুই পা এগিয়ে, ডান হাতের গলিতে। সেই গলির সামনে একটি অটো স্ট্যান্ড রয়েছে, তবে এখানে কেউ কিছু বলতে নারাজ। সবারই মুখে মুখে দুটো কথা ঘুরছে– সেদিন ছিলাম না আর শিবতলা বাজার বন্ধ, সেখানে নাকি প্রচুর পুলিশ ও র‌্যাফ মোতায়েন রয়েছে। এখান থেকেই নাকি অনেক  বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে ১২-১৩ তারিখে। অভিযোগ যে গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশ মানুষই হয় স্কুল-কলেজের ছাত্র আর না হয় দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষজন, যাঁদের ঘরে বেশির ভাগ দিনই নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

বন্ধ শিবতলা বাজারের গলিতে ঢোকার দুই মিনিটের মধ্যেই দেখি প্রায় সাত-আটটা পুলিশের কালো কাঁচ লাগানো স্করপিও বেরিয়ে গেল হুড়হুড় করে। একটু আগে এগিয়ে দেখি সত্যিই প্রচুর পুলিশ ও র‌্যাফ জওয়ান টহল দিচ্ছে এবং কিছু সাধারণ মানুষ বাইক ও অটোতে পথে যাতায়াত করছেন। পথচারী কেউই নেই। অনেক ভ্যান ও অটো যেতেও চাইছে না ওই দিকে। আরও একটু হেঁটে গিয়ে পেলাম এক ছাতুর দোকানের হিন্দিভাষী মালিককে। তাঁর দোকানের ঠিক বিপরীতে রয়েছে একটি মন্দির, যার গায়ে একটুও আঁচড় লাগেনি এত কিছুর পরে। 

সেই ছাতুর দোকানদার (নাম বলতে নারাজ) জানালেন সেই মন্দির নাকি এই দুই দিন, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে, পাড়ার ছেলেরা পাহারা দিয়েছে। বাজারে ঐ খোকনের মার খাওয়ার ঘটনার পর থেকেই, অর্থাৎ ১১ জুনের দুপুর বেলার থেকেই, যাতে হিন্দুদের ধর্মীয় স্থান মন্দির কে আঘাত করে কেউ যেন সেই অঞ্চলে দাঙ্গা না বাঁধাতে পারে। খুবই কাতর মুখে, এই হিন্দিভাষী ছাতুর দোকানদার জানালেন যে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশেই থাকে, কিন্তু তবুও সেই দিন মুসলিম যুবক খোকনকে অমন করে বাজারে কেন মারা হলো তা তিনি জানেন না। খোকন নাকি এমনিতে ভাল ছেলে। খোকনকে মারার পর থেকেই কেমন করে যেন বদলে গেল পরিস্থিতি। তারপরেই পাড়ার সমস্ত ছেলেরা ঐ অঞ্চলের মন্দিরগুলিতে মিলেমিশে পাহারা দিয়েছে। যে মন্দিরের ছবিও নাকি টিভিতে ভাইরাল হয়েছে সেটা ধুলাগড়ের আগের অঙ্কুরহাটির জাগ্রত মন্দির, সেটাও মুসলিম যুবকরা পাহারা দিয়েছে হাতে হাত রেখে।

মুসলিম যুবকেরা রক্ষা করছেন হিন্দু মন্দির

আবার ফিরে এলাম ধুলাগড় মেন রোডে (টোলগেটের সামনে), পাঁচলা যাব বলে। ওখান থেকে রাণীহাটি টেম্পো, তারপর রাণীহাটি থেকে পাঁচলা যাওয়া যাবে। ধুলাগড়ের টেম্পো লাইনে কোন টেম্পো আগে যাবে সেই নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছিল চালকদের মধ্যে। এর কারণ তিনদিন ধরে তাঁদের রোজগার বন্ধ ছিল। এই বাকবিতণ্ডার মধ্যে হঠাৎ এক প্রৌঢ়া এসে টেম্পো চালকদের বললেন, “বাবা তোরা আর ঝামেলা করিস না, দেখছিস না কী চলছে চারিদিকে”! – ওখানকার পরিস্থিতি সবটা দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারলাম হাওয়া কেমন গরম রয়েছে, যার ফলে ওখানকার সাধারণ মানুষের মনে জটিল আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। সত্যিই তো! কোনো খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ কি ঝামেলা চেয়েছিল? এমন ঝামেলা কি গরিব মানুষ চায় যার ফলে তাঁরই রুজিরুটি’র জায়গা বন্ধ হয়ে যাবে?

টেম্পোয় বিপরীতে বসে সুকুমার। তার সাথে যেচেই কথা বললাম। জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? তিনি অকপটে বললেন “দেখেননি ভারতের বিরুদ্ধে ৫৮টা দেশ মিলে বয়কটের ডাক দিয়েছে? শোনেননি বিজেপি নেত্রীর নোংরা মন্তব্য মুসলিমদের নবীকে নিয়ে?” সেই শুনে তাঁর পাশে বসা, মাথায় সিঁদুর পরিহিতা এক সহযাত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, “আমাদের মতন গরিবদের পুরোপুরি মেরে ফেলার জন্য সব উঠে পরে লেগেছে”। তিনি কোথায় যাবেন জানতে চাওয়ায় বললেন, তাঁর নাকি রাণীহাটি বাজারে একটি ফলের দোকান আছে। 

এইসব কথা বার্তা চলতে-চলতেই ২০ মিনিটের মধ্যে চলে এল রাণীহাটি। সেখানে নেমে তারপর পাঁচলা যাওয়ার টেম্পোয় উঠলাম। প্রায় মিনিট পনেরো পর পাঁচলা নেমে দেখি র‌্যাফ আর পুলিশ রাস্তার প্রতিটি মোড়ে লাঠি হাতে বসে, প্রায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেই বললেই চলে। এরপর হাঁটা পথে গেলাম সেখান থেকে কালিতলা – এই জায়গায় দেবতনু ভট্টাচার্যের উগ্রপন্থী ‘হিন্দু সংহতি-র’ খুব বড় সংগঠন রয়েছে। আসে পাশে সব হিন্দু সংহতির “ওঁ” লেখা পতাকাও ঝুলছে। সেখানেও কিছু পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে।

এরপরেই সেই জায়গা মনসাতলা। এখানেই দোকান-পাট ভাঙচুর হয়েছে, এমনকি আগুনও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ১২ই জুন। এখানে রাস্তার মোড়ে পান-বিড়ির দোকান খোলা রয়েছে, কিন্তু অঞ্চলের ভেতরের ক্ষুদ্র ব্যবসাদারদের দোকান সমস্ত তছনছ হয়ে গেছে। এখানেও সমস্ত গলির মোড় থেকে দোকানপাটে লাগানো রয়েছে হিন্দু সংহতি ও বিজেপির পতাকা। এই অঞ্চলগুলো সবটাই হাওড়া গ্রামীণের মধ্যে পড়ছে। সেখানে এক টেম্পো চালককে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? তাঁর নাম সঞ্জয়। তিনি জানালেন ঐখানেই রবিবার, ১২ই জুন, আসল ঝামেলা হয়েছে। ওই পুরো অঞ্চলটিই নাকি আরএসএস-র ঘাঁটি। ১১ই জুন ধুলাগড়ে’র বিক্ষোভ সমাবেশের পর ১২ই জুন ঐ অঞ্চলের ব্যবসায়ী সমিতির সমস্ত দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল (হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে)। বহু বাড়িতে ঢিল মেরে বাইরের দরজা-কাঁচ ভেঙে ফেলা হয়েছে। কে করেছে এসব জিজ্ঞাসা করায়, সঞ্জয় জানালেন “সে বলতে পারবো না দাদা”। দেখে যতদূর মনে হয়েছে ঐ অঞ্চলে বর্তমানে সবথেকে বেশি পুলিশ ও র‌্যাফ রয়েছে। সঞ্জয়ের থেকেই জানলাম, কাপড় ব্যবসায়ী মহিদুল ও তাঁর ফুলের দোকানদার হিন্দু বন্ধু হিরুর বন্ধুত্বের যে খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে “হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির” বার্তা নিয়ে তা এই মনসাতলা অঞ্চলেরই।

ওখানে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে, ফের টেম্পো ধরলাম উলুবেড়িয়া পৌরসভা আসবার জন্য। এর আগেই পড়লো উলুবেড়িয়া ইএসআই- সেখানেও ভারী মাত্রায় পুলিশ আর র‌্যাফ মোতায়েন রয়েছে। অঞ্চলে এক সাথে তিনজন কে দেখলেই রে-রে করে তেড়ে আসছে লাঠি হাতে পুলিশ বা র‌্যাফ জওয়ান। অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি আছে যে। ইন্টারনেট যথারীতি বন্ধ। উলুবেড়িয়া পৌরসভায় কিছু চা ও পান-বিড়ির দোকানদারদের মধ্যে তিনজনের সাথে কথা বলে জানলাম সেখানে কিছু হয়নি। যা হয়েছে ৬ নং জাতীয় সড়কের বিক্ষোভে আর তার থেকে একটু আগে, গরুহাটায়, টায়ার জ্বালিয়ে পরের দিন বিজেপি বিক্ষোভ দেখিয়েছে। 

বিজেপির রাগের কারণ এই ৬ নং জাতীয় সড়কেই বিজেপির পার্টি অফিস ভাঙা হয়। সেখানকার লোকেরাই বলছেন খবরের চ্যানেলে অনেক ভুল প্রচার করছে, এখানে পুরো ঝামেলা হিন্দু-মুসলিমের নয়। এটা পুরোটাই প্রথমে কেন্দ্র ও পরে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, সাধারণ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কিছু হয়নি। কিন্ত ১২ জুনের থেকে এটাকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বানাবার চেষ্টা চলছে কিছু রাজনৈতিক নেতাদের মতলবে।

হাওড়ায় দাঙ্গা নিয়ে যে ভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচার পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা ভারতে যে ভাবে হল, তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে এর পিছনে নিশ্চয় কোনো গূঢ় মতলব রয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল নিশ্চয় হাওড়ার মুসলিমদের বিক্ষোভ কে হাওড়ায় দাঙ্গা বলে চালাতে সাহায্য করে নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূর্ণ করছে। 

তথাকথিত হাওড়ায় দাঙ্গা এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জনের বেশি গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশ এই নিয়ে বেশি তথ্য দেয়নি। তবে আমাদের অনুসন্ধান যে মুখ্য বিষয়গুলোর হদিস পাওয়া গেল তা নিম্নে বর্ণনা করা আছে:

১) এই ঘটনার সূত্রপাত কোনো আঞ্চলিক সাধারণ হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বগত কারণে একদমই নয়।

২) হাওড়ায় দাঙ্গা তৈরি করার পিছনে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তৃণমূল কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য সরকারের একটি উল্লেখ্য যোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আরএসএস আর হিন্দু সংহতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, তাঁদের প্রচার যন্ত্র কে ধ্বংস না করে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, যিনি মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও আঞ্চলিক স্তরে আরএসএস-র ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সংগঠন গুলিকে শাখা প্রশাখা বিস্তার করার সুযোগ করে দিচ্ছেন, এই ঘটনা কে মুসলিমদের দাঙ্গা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন

৩) বন্দোপাধ্যায় চাইলেই, অনেক আগেই তিনি নুপূর শর্মা’র বক্তব্যের বিরোধিতা করে এই বিক্ষোভ সংগঠিত হতেই দিতেন না। এই রাজ্যের পুলিশের কাছে শর্মার নামে অনেক আগের থেকেই “ফেক নিউজ” ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ইন্ধন দেওয়ার, উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ লিপিবদ্ধ আছে। তবুও এতদিনে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ এই ভাবে আইন কে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদীদের জেলে ভরতে গেলে বন্দোপাধ্যায় কে আরএসএস-র বিরুদ্ধে যেতে হতো, যার ক্ষমতা বর্তমানে তাঁর নেই। বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মতনই উনি চেয়েছেন রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস ঢাকতে বাজারে ধর্মীয় জিগির চাগিয়ে তুলতে।

৪) রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট কে সামনে রেখে এই বিক্ষোভে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি করে, বিজেপিকে প্রধান বিরোধী বানাতে তৎপর হয়েছেন। বাম শক্তি পঞ্চায়েত স্তর থেকে দুর্বল হয়ে গেলে রাজ্যের রাজনীতিতে যে ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি, আরএসএস-র দুটি সংগঠন, করে কম্মে খাবে, তার জন্যে এই তথাকথিত “হাওড়ায় দাঙ্গার” কথা প্রচার হওয়া দরকারি ছিল।

৫) সংখ্যাগুরু হিন্দু জনগণ আরএসএস-বিজেপির ঘৃণ্য হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের রাজনীতির বিষের প্রভাব, ধীরে ধীরে, অনেক জায়গায় উপলব্ধি করতে পারছেন কারণ ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের—পেট্রল-ডিজেল থেকে শুরু করে সর্ষের তেল আর খাদ্য বস্তুর—আকাশ-ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল-কলেজের ফলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত গরিব শিশুদের অবস্থা দেখে, ও অন্যান্য কারণে তাঁদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার। এর থেকে তাঁরা পরিত্রাণ চান, যা বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস এক সাথে রুখছে।

৬) সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণ শুধু কেন্দ্র নয়, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও সুর চড়াচ্ছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার মুসলিমদের বোকা বানিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অক্ষ কে শক্তিশালী করছে আর আরএসএস ও বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি কে এই ভাবে “হাওড়ায় দাঙ্গা” গল্প বলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজে ইন্ধন যোগাচ্ছে।

৭) এই বিক্ষোভ সমাবেশে মুসলিম মৌলবাদের কোনো দেখা নেই। মুসলিমরাই হিন্দুদের মন্দিরে একটা আঁচড় পড়তে দেননি, উল্টে নিজেরা হাতে হাত রেখে রক্ষা করেছেন সেই ধর্মস্থান। যে কোনো মৌলবাদী শক্তি সবসময় রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট হয়। তাদের প্রথম আক্রমণই হবে অন্য ধর্মের ধর্মীয় স্থলে, যেমন বিজেপি এখন জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে সেই গত শতকের আটের দশকের ফর্মুলা ব্যবহার করে। হিন্দুদের উপাসনাস্থলে বা বাড়িতে হামলা না করে, “হাওড়ায় দাঙ্গার” অভিযুক্ত মুসলিমেরা হিন্দু ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁদের ভালবাসা ব্যক্ত করেন।

শুধু তথাকথিত “হাওড়ায় দাঙ্গা” নয়, বরং সাম্প্রতিক কালে ঘটে চলা ঘটনাগুলি কী দেখায়? সত্যি কি আন্দোলনের নামে মুসলিমেরা “তান্ডব” করেছেন নাকি এটা ইচ্ছাকৃত তৈরী করা ও প্রচার মাধ্যম গুলিতে দেখানো হচ্ছে যাতে অতি সহজেই “মৌলবাদী- জেহাদী” তকমা লাগিয়ে মুসলিমদের কালিমালিপ্ত করা হয়? আসলে এই বিষ দিয়েই সমাজে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের শিখর গেথে, মুসলিম বিদ্বেষ তৈরী করে, বর্তমানের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, রুজিরুটির থেকে মানুষের নজর সরিয়ে, ভবিষ্যতে আরএসএস-র হিন্দুরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা সম্পন্ন করবার প্রচেষ্টা রয়েছে?

“হাওড়ায় দাঙ্গা” নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির নাটক আর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী মিডিয়ার সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর প্রচেষ্টা দেখে বঙ্গবাসী কী ভাবে এই পরিস্থিতিতে পক্ষ বাছবেন? একটি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিপীড়িত হয়, শোষিত আর বঞ্চিত হয়, তাহলে কি সেই সম্প্রদায়, বন্দোপাধ্যায়ের শাসানি অবজ্ঞা করে নিজের থেকে “হাওড়া দাঙ্গা” করার মতন স্পর্ধা দেখাবে? কী কারণে একটি মুসলিম পরিবার নিজেদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনবে? আর তার চেয়েও বড় কথা হল, এই রাজনৈতিক খেলায় লাভের গুড় কোন পিঁপড়ে খাবে?

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla