বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলার সংবাদ মাধ্যম ও কিছু ক্ষেত্রে তথাকথিত দিল্লী-ভিত্তিক “জাতীয় সংবাদ মাধ্যম” পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর মডেল অর্পিতা মুখার্জীর শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) কতৃক গ্রেফতার হওয়া ও মুখার্জীর বাড়ির থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে মেতে আছে ও তার সাথে জেলে বন্দী দুই জন কী খাচ্ছেন আর কী করছেন তার ফিরিস্তি দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল হঠাৎ এই দুর্নীতির তদন্ত নিয়ে, যাতে সর্বভারতীয় দুর্নীতিগুলোর তুলনায় খুবই সামান্য কিছু টাকার হদিস পাওয়া গেছে, সবাই এমনি করে মেতে উঠলো কেন?
এমন নয় পশ্চিমবঙ্গে এর আগে দুর্নীতি হয়নি। সে কংগ্রেস জমানা হোক বা ৩৪ বছরের বাম শাসনকাল, দুর্নীতি চিরকালই এই ব্যবস্থার সাথে সহবাস করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির উপর থেকে চাদর তুলে তাকে বুক বাজিয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরেছে আর একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করেছে। অতএব তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান থেকে কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা এই ১১ বছরে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছেন আর তার সাথে বখরা নিয়ে দলের কোন্দলও বাইরে বেরিয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গ যেমন বাম আমলের বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি, জমি কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বিনা পয়সায় বৃহৎ পুঁজিপতিদের বহু ফসলী জমি তুলে দেওয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতা বহন করে পশ্চিমবঙ্গে সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি দিয়ে যাত্রা শুরু করে মমতা বন্দোপাধ্যায়-নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ইঁট-বালির সিন্ডিকেট থেকে শিক্ষক নিয়োগ সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্ডিয়ার ২০১৯ এর দুর্নীতির উপর সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ কে মন্দের ভাল স্থানে রাখা হয়েছিল সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে। পশ্চিমবঙ্গের সমীক্ষায় ভাগ নেওয়া ৪৬% মানুষ স্বীকার করেন যে তাঁদের এই রাজ্যে সরকারি পরিষেবা পেতে বা সাহায্যের জন্যে ঘুষ দিতে হয়েছে। তবে সেই নিরিখে ভারতের অন্যান্য রাজ্য যেমন উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার, ঝাড়খন্ড, রাজস্থান, তামিল নাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ আর তেলেঙ্গানা অনেক উপরে স্থান অধিগ্রহণ করেছিল কারণ সেখানে ৬০% বা তার বেশি লোকেদের সরকারি কাজ করাতে ঘুষ দিতে হয়েছে।
স্টাটিস্টিকার তথ্য অনুসারে যখন ২০২০ সালে মহারাষ্ট্রে ৬৬৪টি আর গুজরাটে ১৯৯টি দুর্নীতির অভিযোগ নথিভুক্ত হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ নথিভুক্ত হয় ১১টি। এ ছাড়াও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুর্নীতি মুক্ত সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতির পরেও হওয়া রাফাল জেট দুর্নীতি (প্রায় ৫৮,০০০ কোটি টাকা), পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি বা এবিজি শিপিং দুর্নীতি (২২,৮০০ কোটি টাকা) নিয়ে কোনো ধরণের ধরপাকড় আজও হয়নি।
চট্টোপাধ্যায় কে দোষী সাব্যস্ত করা আদালতের কাজ, কিন্তু অর্থ পাচার নিবারণ আইন (পিএমএলএ) এর অধীনে কেউ গ্রেফতার হলে তাঁকে বিনা বিচারে জেলে পঁচতে হবে সুপ্রিম কোর্টের নতুন আদেশ অনুসারে। তার চেয়েও বড় কথা অভিযুক্ত কে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে, ইডি কে তাঁকে দোষী প্রমাণ করতে হবে না।
কিন্তু এর মধ্যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখার্জীর শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ও নগদ প্রায় ২৮ কোটি টাকা উদ্ধার হওয়া নিয়ে ইডি’র বয়ানের ভিত্তিতে যে ভাবে হৈচৈ শুরু হয়েছে তাতে অনেক গুলো প্রশ্ন জাগে, বিশেষ করে যখন এই তদন্ত কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে হচ্ছে।
১. নগদ টাকা
২০১৫ সাল নাগাদ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি হয় ও অভিযোগ ওঠে টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় টাকা নিয়ে হেরফের করে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনার থেকে দায়মুক্ত হতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি কী ভাবে ২০১৬ সালের নভেম্বরে হওয়া মোদীর কুখ্যাত নোট বন্দীর পরেও সেই ঘুষের টাকা নগদে বাঁচিয়ে রাখলেন আর তার উপর নোট পরিবর্তনও করে ফেললেন? কথা তো ছিল যে নোট বন্দীর ফলে বাতিল হওয়া ৫০০ টাকা আর ১,০০০ টাকার নোট বদলানোর মধ্যে দিয়ে দুর্নীতিতে যুক্ত লোকেদের বিজেপি সরকার চিহ্নিত করবে ও গ্রেফতার করবে। তাহলে তখন চট্টোপাধ্যায় বা মুখার্জী কেন তদন্তকারী সংগঠনগুলোর নজরে পড়েননি?
২. টাকা কোথায় রাখা ছিল?
ইডি জানিয়েছে যে অর্পিতা মুখার্জীর বাড়ির আলমারির থেকে নগদ টাকা উদ্ধার হয়। সেই আলমারি কত বড় ছিল যে তাতে ২৮ কোটি টাকা নগদ রাখা সম্ভব ছিল, যে টাকা নিয়ে যেতে প্রচুর ট্রাঙ্ক নিয়ে যেতে হয় ইডিকে? আর ইডি জানল কী করে যে কতগুলো ট্রাঙ্ক নিয়ে গেলে মুখার্জীর বাড়ির থেকে টাকা আনা সম্ভব হবে? এত টাকা নগদে রেখে চট্টোপাধ্যায় বা মুখার্জীর কী লাভ হল? তাঁরা অভিজ্ঞ দুর্নীতিবাজদের মতন এই টাকা কোথাও লগ্নি করে রাখেননি কেন?
৩. সরকার ও দল থেকে বহিস্কার
দুর্নীতির অভিযোগে আগেও তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতা, এমন কি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ও, অভিযুক্ত হয়েছেন ও সেই ক্ষেত্রে দল তো তাঁদের চটজলদি বহিস্কার করেনি। কিন্তু চট্টোপাধ্যায়ের মতন বর্ষীয়ান নেতাকে হঠাৎ দুর্নীতির দায়ে জেল খাটা প্রাক্তন সাংবাদিক কুনাল ঘোষ কে দিয়ে কেন তড়িঘড়ি বহিস্কার করাতে হল? এর পিছনে কি তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো গোপন পরিকল্পনা আছে না কি এটা একটা কৌশল যাতে চট্টোপাধ্যায় আদালত কে দেখাতে পারেন যে তিনি প্রভাবশালী নন ও জামিনে মুক্ত হতে পারেন?
৪. শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কি চাপা পড়ে গেল?
যে ভাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় কে একাই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনায় দায়ী করে, সংবাদ মাধ্যমের বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া গেল, তাতে করে কি এই দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ তদন্তে ছেদ টেনে শুধু একটি ব্যক্তি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দোষ দিয়ে মূল ব্যবস্থার দোষ কে ঢেকে দেওয়া গেল না? যদি চট্টোপাধ্যায় একাই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকেন তাহলে কি বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর দল বা সরকারের অন্য কেষ্টবিস্টুরা সেই কথা জানতেন না? আর জানলে তাঁরা চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি কেন? কী ভাবে চট্টোপাধ্যায় কে তাঁরা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখেন? আর যদি চট্টোপাধ্যায় একাই এই দুর্নীতির সাথে না যুক্ত থাকেন, তাহলে ইডি বা আদালত কি অন্যদের পিছনেও লাগবে? আরও অনেকে গ্রেফতার হবেন?
শিক্ষণীয় কী?
সারদা থেকে শিক্ষক দুর্নীতি, সব কিছুতেই সবার উপরে তৃণমূল কংগ্রেসের নাম। পাড়ার প্রোমোটারি সিন্ডিকেট থেকে গরুপাচার আর কয়লা পাচারেও তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে অভিযোগের তীর। আজ শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ায় জনগণের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের লাভা তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছে। অন্যদিকে তাঁকেই পিএমএলএ আইনের শিকলে বাঁধা হয়েছে।
কিন্তু ঘটনা হল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টি না। বর্তমানে যখন নয়া উদারনীতিক অর্থনীতির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেকে ন্যূনতম জনকল্যাণের কর্মকান্ডের থেকে গুটিয়ে নিয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পৌর পরিষেবা থেকে টেলিফোন, ডাক, রেল, বিমান, ব্যাঙ্ক, সবই বেসরকারিকরণ করে বৃহৎ পুঁজি কে মুনাফার পাহাড় গড়তে সাহায্য করছে, তখন জনগণের কর্মসংস্থানের সংকোচন হয়েছে। তাঁদের রোজগার চলে গেছে।
এহেন পরিস্থিতিতে একটি স্কুল মাস্টারের চাকরি অনেক লোভনীয় কারণ গ্রাম বাংলার আর শহরের অনেক কর্মহীন যুবদের কাছে এটাই জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় কারণ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ আর কৃষির থেকে কোনো উপার্জন করা আর সম্ভব নয়। ফলে এই কিছু চাকরির পদের জন্যে যেমন একদিকে তীব্র প্রতিযোগিতা হয় পরীক্ষার হলে, তেমনি সবার চেষ্টা থাকে যে করেই হোক নিজের জন্যে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা।
এর ফলে, চাকরির কৃত্রিম সঙ্কটের বাজারে সেই আমলাতন্ত্র আর রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতির সাহায্যে ফুলে ফেঁপে ওঠে যারা নিজেদের উদ্যোগে এমন সব নীতি গ্রহণ করেছে যার ফলে নয়া উদারনীতিক অর্থনীতি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পেরেছে। তাই একদিকে এরাই চাকরির সুযোগ শেষ করে চলেছে আর অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব নিয়ে, চাকরি প্রার্থীদের থেকে অর্থ নিয়ে নিজেদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করেছে।
তবে চট্টোপাধ্যায় কে নিয়ে যে হৈচৈ, মুখার্জীর সাথে তাঁর তথাকথিত সম্পর্ক নিয়ে যে মশলাদার খবর ছেড়ে মানুষ কে উত্তেজিত করেছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো, তার সিকি ভাগও তারা বিজেপির দুর্নীতিগুলো নিয়ে করবে না। কারণ পার্থ কে কোরবানির পাঁঠা বানিয়ে, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কে ধামা চাপা দিয়ে, অনেক কিছুই ঢেকে দেওয়া যায়, যা নিয়ে পরে আর কেউই প্রশ্ন করবে না। কিন্তু সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, যে ইডি আর অন্য সকল তদন্তকারী সংস্থা কে ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের দুর্নীতির তদন্ত করছে, তাদের কাউকে কি সাহস করে বিজেপির আমলে হওয়া কোনো দুর্নীতির তদন্ত করাবেন মোদী?