ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার কারণে স্পষ্টতই বিশ্ব জুড়ে পশ্চিমা শক্তিগুলো ধাক্কা খাচ্ছে। একদিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে মিছিল করার উপর, ফিলিস্তিনি পতাকা ব্যবহারের উপর বা ফিলিস্তিনিদের সাথে সহমর্মিতা বা সংহতি জানানোর জন্যে শাস্তি দিচ্ছে নিজের দেশের নাগরিকদের, নিজেদের তথাকথিত “উদারনৈতিক গণতন্ত্র”-কে কাঁচকলা দেখিয়ে, অন্যদিকে তারা জায়নবাদী শক্তির দ্বারা পরিচালিত গণহত্যার পক্ষে নিত্য নতুন যুক্তি হাজির করছে।
এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ইজরায়েল সফরের পরে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে গিয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি, ফিলিস্তিনি কতৃত্বের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ও জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ দ্বিতীয়ের সাথে বৈঠক করার পরিকল্পনা করলেও, একদা মার্কিন ঘনিষ্ঠ জর্ডান সেই বৈঠক বাতিল করে দেয়। ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা শক্তির খাতির কেউই করতে চাইছে না।
সৌদি আরবের মতন মার্কিন-ঘনিষ্ঠ আরব দেশও গণরোষ এড়াতে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে, জায়নবাদী গণহত্যার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে একদা যুযুধান সৌদি আরব ও ইরান, পশ্চিমাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে, আরও কাছাকাছি এল বলে মনে করা হচ্ছে।
আরব বিশ্বে মিশর, বাহরাইন, সংযুক্ত আমিরশাহী ও মরোক্কো ছাড়া কোনো দেশের সাথেই জায়নবাদী ইজরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আর এই দেশগুলোও মার্কিন চাপে পড়ে একদা ইজরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলেও, বর্তমানে তারা ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার কারণে বিপাকে পড়ে পশ্চিমাদের ফর্মুলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। আর এর ফলে এই ভূরাজনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কে লাভবান হচ্ছে?
ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার ঘটনায় যত বেশি করে মার্কিনী ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলো তেল আবিবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে ততই আরব বিশ্বে ও একদিক থেকে দেখতে গেলে সামগ্রিক দক্ষিণ গোলার্ধে জনগণের মধ্যে পশ্চিমা-বিরোধী অনুভূতি তীব্র হয়েছে। আর এর ফলে আরও বেশি করে এই অঞ্চলের জনগণকে ও তাঁদের মাধ্যমে তাঁদের সরকারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে রুশ ও চীন।
বিশ্ব জুড়ে দ্বিতীয় শীত যুদ্ধে যে পশ্চিমারা রুশ ও চীনের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে নেমেছে সে কথা নতুন করে বলার কোনো দরকার নেই। কিন্তু ইউক্রেনের নয়া-নাৎসি বাহিনী কে বিতাড়িত করতে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন যে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করেছেন, তার ফলে বিশ্ব জনমত কে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খায় পশ্চিমারা।
দক্ষিণ গোলার্ধের বেশির ভাগ দেশই রুশ-বিরোধী শিবিরে যোগ দিতে অস্বীকার করে ও বহুপাক্ষিকতার নীতি অবলম্বন করে নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থ কে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজেদের কূটনৈতিক কার্যক্রম চালায় তারা। তারা পশ্চিমা ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করে, ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা কে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়।
এরই মধ্যে খবর হল যে মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকায় তার প্রভাব অনেক বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয় রাশিয়া। চীন তো বেল্ট-রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প ব্যবহার করে ইতিমধ্যে আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। ফলে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া কে একঘরে করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় বাইডেন প্রশাসনের।
অন্যদিকে ১৯৪৯ সালে মার্কিন মদদপুষ্ট সামরিক শাসক চিয়াং কাইশেকের তৎকালীন ফর্মোসা—বর্তমান তাইওয়ান—পলায়নের পরে চীন এই দ্বীপপুঞ্জের উপর নিজের ন্যায্য অধিকার হারায়। বর্তমানে চীন তাইওয়ান কে ফিরে পেতে সচেষ্ট হয়েছে দেখেই মার্কিন সামরিক কার্যকলাপ দক্ষিণ চীন সাগরে শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতে চীন দমে যায়নি বরং আরও দৃঢ়তার সাথে নিজ ভূমি ফেরত নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
এহেন পরিস্থিতিতে যদিও বাইডেন প্রশাসন ভেবেছিল যে বিশ্বের তাবড় সব দেশগুলোর উপর জোর খাটিয়ে চীন কে একঘরে করে দেবে, চীনের আর্থিক-সামরিক শক্তির কারণে দক্ষিণ গোলার্ধের বেশিরভাগ দেশই বেজিং এর সাথে সুসম্পর্ক রাখতে সচেষ্ট হয়। এর ফলে ধাক্কা খায় পশ্চিমাদের প্রকল্প।
কিন্তু এই ঘটনাগুলোর থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে মার্কিনী ও পশ্চিমারা বর্তমানে পড়েছে। ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার সমর্থনে দাঁড়িয়ে তারা শুধু মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকায় নিজেদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেনি, তারা নিজের দেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকেও নিজেদের বিরুদ্ধে করে ফেলেছে।
ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার ঘটনায় বরং নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েও যে ভাবে চীন ও রাশিয়া সংযুক্ত রাষ্ট্রে ও অন্যান্য জায়গায় নানা ভাবে একটি জরুরী ভিত্তিতে অস্ত্রবিরতি ও শত্রুতা বন্ধ করে অবিলম্বে গাজার নিরীহ নাগরিকদের গণহত্যা বন্ধের প্রস্তাবনা এনেছে ও দাবি তুলেছে, সেটা আরব জনগণের কাছে ও দক্ষিণ গোলার্ধের জনগণের কাছে খুবই বেশি গ্রহণযোগ্য হিসাবে দেখা দিয়েছে।
ফলে, ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইজরায়েলি হামলার সমর্থনে দাঁড়িয়ে, ও তেল আবিব কে এই গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার রসদ জুটিয়ে মার্কিনী ও পশ্চিমা শক্তিগুলো যেমন এই ঘটনার মাধ্যমে বিশ্বের এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিজেদের কবর নিজেরা খুঁড়েছে, তেমনি এই ঘটনাবলী ও গণহত্যার প্রতি পশ্চিমাদের নির্লজ্জ সমর্থনের কারণে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় আরও বেশি করে বহুমেরুর বিশ্ব গঠনের প্রাসঙ্গিকতা দেখা দিয়েছে।