ধরে নিন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের কার্যকলাপের সাথে যদি আপনাকে বিধান চন্দ্র রায়ের শাসনকালের তুলনা করতে হতো, তাহলে কি আপনি বলতে পারতেন যে তৃণমূল শাসন আসলে ডাক্তার বাবুর শাসনেরই নব্য ও উন্নত সংস্করণ?


পয়লা জুলাই পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকদের কাছে চিরকালই একটি বিশেষ দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থেকেছে রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম ও মৃত্যু দিবসের কারণে। যদিও তাঁর সমসাময়িক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর উত্থান এই কংগ্রেসি নেতার ইমেজ কে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বিগত দশ বছরে, তবুও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে এই দিনটি ঘটা করে পালন তো হবেই। 

সকাল বেলায় উঠেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিধান চন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আপনার পাড়ার পৌর প্রতিনিধি, পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর পোস্ট যখন আপনি দেখবেন তখনই মনে হবে “পশ্চিমবঙ্গের রূপকার” বিধান চন্দ্র রায়ের কী অসীম মাহাত্ম্য। যাঁদের বয়স বর্তমানে চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে, তাঁরাও স্মৃতি চারণ করবেন প্রবীণদের থেকে শোনা সোনালী সেই দিনের গল্প। বিধান চন্দ্র রায় বেঁচে থাকলে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা নাকি অন্য রকম হতো, ইত্যাদি। 

এরই মধ্যে, রবিবার, ৩০শে জুন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক টুইট করেছিলেন একটি ভিডিও যেখানে দেখা গেছে তাজেমুল ওরফে ‘জেসিবি’ নামক এক তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত সমাজ বিরোধী, চোপড়ায় এক যুগল কে জনসমক্ষে গাছের ডাল দিয়ে মারছে, লাথি মারছে আর লোকজন সেটা দেখছে, উপভোগ করছে ও ভিডিও রেকর্ড করছে।

সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট এই দুষ্কৃতী রেকর্ডিং চলাকালীন এই ভাবে দুই জন প্রাপ্ত বয়স্ক কে জন সমক্ষে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে কারণ তার বোধহয় জানা আছে যে এর পরিণামে শাস্তি সে পাবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের একটি অঞ্চলে, যেখানে ন্যায় ও সংবিধানের শাসন থাকার কথা, সে আফগানিস্তানের তালিবান বা উত্তর প্রদেশের হিন্দুত্ব দুষ্কৃতীদের মতন তান্ডব করার সুযোগ পেল। 

সিপিআই (এম) নেতা জ্যোতি বসুর সাথে রাজনৈতিক ভাবে বিধান চন্দ্র রায়ের সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকলেও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল না আর তারই ফলস্বরূপ অনেক বাম সমর্থক মনে করেন যে সেই শাসন কাল থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের শাসন কাল অনেক আলাদা। তাঁরা মনে করেন যে বন্দোপাধ্যায়ের শাসনকাল হলো দুষ্কৃতী আর লুম্পেনদের শাসনকাল, চোর ও ডাকাতদের রাজত্বের কাল। বিধান চন্দ্র রায় কে সেই জায়গায় তাঁরা হয়তো সততার প্রতীক হিসাবে দেখেন। 

বিধান চন্দ্র রায়ের ব্যাপারে কংগ্রেসের দৃষ্টিকোণের সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের দৃষ্টিকোণের কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। হয়তো বা আদি কংগ্রেস, যার অবস্থা এখন তাল পুকুর কিন্তু ঘটি ডোবে না, বিধান চন্দ্র রায়কে পশ্চিমবঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী মনে করে, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সেই শিরোপা বন্দোপাধ্যায় বাদে আর কারুর মাথায় দিতে নারাজ। তবুও তাঁরাও মনে করেন যে বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে যাকে নরেন্দ্র মোদী বলেন ‘সুনার বাংলা’, তাই হয়তো ছিল। 

কিন্তু আদতে বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে কী ছিল?

পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বিধান চন্দ্র রায় 

সুভাষ চন্দ্র বোসের দাদা এবং কংগ্রেস নেতা শরৎ বোস ও  অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ বাংলার যে চুক্তি করেন তাকে পিছন থেকে নয়, বরং মুসলিম লীগের সাথে হাত মিলিয়ে বুকের উপর ছুরি মারে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা। এর ফলে হিন্দু ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান—বর্তমানে বাংলাদেশ—গঠিত হয়। আর লাভবান কে হন? বৃহৎ গুজরাটি-মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা, যারা আতংকিত ছিলেন যে বাংলা আলাদা স্বাধীন দেশ হলে তাদের কল কারখানাগুলো হাত ছাড়া হবে। 

তো এই শ্রেণীর স্বার্থে যখন জওহরলাল নেহরু তাঁর আদর্শগত বিরোধী মুখার্জীর সাথে হাত মেলাতে পারেন, তখন তিনি কি সত্যিই কোনো বাংলা প্রেমী কে নবগঠিত রাজ্যের শীর্ষ আসনে বসাতে পারতেন?

বিধান চন্দ্র রায়ের বাঙালি প্রীতির কথা বলতে গেলেই সামনে আসে মানভূম কে বিহারের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার কথা। 

যার কারণে আজ যা পুরুলিয়া হিসাবে পরিচিত সেখানকার জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় হিন্দি। তাঁদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে ও এর ফলে ১৯৪৮ সালের ১৪ই জুন মানভূমে প্রতিষ্ঠিত হয় লোকসেবক সঙ্ঘ যা গায়ের জোরে হিন্দি চাপানোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। বিধান চন্দ্র রায় থাকেন নিরুত্তাপ। কারণ বিহারে জন্মানো এই তথাকথিত বঙ্গ দরদী নেতা বল্লভভাই প্যাটেল ও নেহরুর হিন্দি ভাষী দেশ গড়ার প্রকল্পের কারিগর। 

অনেক দমনপীড়ন সহ্য করে, নানা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার হয়েও যদিও বা মানভূম আন্দোলন ১৯৫৫ সালে সরকার কে বাধ্য করে পুরুলিয়া কে পশ্চিমবঙ্গের অংশ করতে, তবুও হিন্দি সাম্রাজ্যের চক্রান্তের কারণেই বঙ্গের নানা অংশ তৎকালীন বিহার ও অধুনা ঝাড়খণ্ডে থেকে যায়। কিন্তু বিধান চন্দ্র রায় কি চুপ থাকেন?

১৯৫৬ সালে বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ পশ্চিমবঙ্গ কে বিহারের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা সামনে আনেন। দুই রাজ্য একত্র হওয়ার পরে বাংলা নামক আর কোনো বস্তু অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনাও ছিল না কারণ এই প্রস্তাবে ছিল দেব নগরী লিপিতে বাংলা শিক্ষার কথা। 

এই চক্রান্তের প্রতিবাদে মানভূম আন্দোলনের চালিকা শক্তি লোকসেবক সঙ্ঘ ১৯৫৬ সালের ২০শে এপ্রিল পাকবিড়রা গ্রাম থেকে কলকাতার উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু করে। এই পদযাত্রা চারদিকে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, কংগ্রেসি নেতা উপনির্বাচনে হেরে যায়। ফলে ভীত হন বিধান চন্দ্র রায়ও। এই পদযাত্রা তৎকালীন বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছানো মাত্রই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে বেশি দিন নিজের জেদ ধরে রাখতে পারেননি বিধান চন্দ্র রায়। অবশেষে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ কে বিহারের মধ্যে বিলুপ্ত করার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। 

এর আগে পর্যন্ত বেসরকারি ও সরকারি যে সকল শিল্পে লগ্নি টানা ও নতুন শিল্পাঞ্চল—কল্যাণী থেকে দুর্গাপুর—তৈরি করার প্রকল্প হাতে নেন বিধান চন্দ্র রায়, তার পিছনে ছিল পশ্চিমবঙ্গের শ্রম ও সম্পদ কে মাড়োয়ারি ও গুজারটি পুঁজির কাছে, দিল্লীর কাছে জিম্মি রাখার পরিকল্পনা। 

ধীরে ধীরে এই সমস্ত শিল্পাঞ্চলে বাঙালির সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। 

উদ্বাস্তুদের মধ্যে উচ্চ জাতিদের পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দিলেও, নমঃশুদ্র সম্প্রদায়কে তিনি অচ্ছুৎ মনে করে পার্সেল করে দেন দণ্ডকারণ্যে। যেখানে বসবাস করার জন্যে উপযোগী কোনো উপকরণ ছিল না, পরিবেশ ছিল না। কিন্তু সল্ট লেক থেকে শুরু করে নানা পরিকল্পিত নগরী গড়ে তিনিই কিন্তু উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত কে আয়েশে থাকার বন্দোবস্ত করে দেন। 

আইনের শাসন ও গণতন্ত্র 

বিধান চন্দ্র রায়ের প্রসঙ্গে বলতে গেলে অনেকেরই মনে হয় তাঁর আমলে রাজ্যে সুশাসন চলতো। সংবাদ মাধ্যম থেকে কংগ্রেসি, এমনকি হিন্দুত্ববাদী প্রচার মাধ্যমও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কথায় কথায় অনেক বামপন্থীও তাঁর আমলের আইনের শাসনের প্রশংসা করে থাকেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই ছিল?

বিধান চন্দ্র রায়ের আমলেই শহরের অপরাধ জগৎ কাঁপিয়ে বেড়ায় গোপাল মুখোপাধ্যায় (গোপাল পাঁঠা), ভানু বোস ও কৃষ্ণচন্দ্র দত্তের (ফাটা কেষ্ট) মতন গুন্ডারা। মাথায় হাত রায় বাবুর। ফলে অনেকে ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলে যায়নি কী ভাবে বৌবাজার কেন্দ্রে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোঃ ইসমাইলের কাছে নির্বাচনের গণনায় পিছিয়ে পড়া বিধান চন্দ্র রায় কে কারচুপি করে জেতাতে হুডখোলা জিপে চেপে এসে গণনা কেন্দ্রের দখল নেয় পাঁঠা আর বোস। পরের দিন জানা যায় বিধান চন্দ্র রায় নাকি ৫০০ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন ইসমাইল কে। 

এ ছাড়াও পাঁঠা আর বোসদের বাহিনী সারা দিন রায়ের বাড়ির বাইরে উপস্থিত থাকতো। কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা মিছিল করলে তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করতে। লাঠি-গুলিতে অবশ্য রায় সাহেবেরও কোনো আপত্তি ছিল না। 

১৯৪৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার পরেই কমিউনিস্ট-বিরোধী দমন পীড়ন তীব্র করেন মাড়োয়ারি-গুজরাটি ও নেহরু-প্যাটেলের প্রিয় বিধান চন্দ্র রায়। ১৯৪৯ সালের ২৭শে এপ্রিল, বৌবাজার স্ট্রিট অঞ্চলে তাঁর পুলিশ এক মহিলা মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল লতিকা সেন, অমিয়া দত্ত, গীতা সরকার, প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায় ও যমুনা দাসকে!

কলকাতায় ট্রাম ভাড়া বাড়ার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের আন্দোলনে দমন পীড়ন থেকে শুরু করে মনুমেন্টের নিচে সাংবাদিকদের পুলিশ দিয়ে বেধড়ক প্রহার, সবই তাঁর আমলে। 

আর এতেও যদি মনে হয়ে থাকে যে “এমনটা তো হয়েই থাকে”, তাহলে স্মৃতিতে থাক কী ভাবে ১৯৫৯ সালে কলকাতা শহরের বুকে দুর্ভীক্ষ-ক্লিষ্ট কৃষকদের মিছিলে, যে মিছিলের প্রতিনিধিরা শহরের মানুষের থেকে একটু ভাতের ফ্যান চাইছিলো খাওয়ার জন্যে, হামলা করে বিধান চন্দ্র রায়ের পুলিশ। রাস্তার উপর পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৮৯ জন নিরস্ত্র, অনাহারে ভোগা কৃষকদের। একেবারে ক্ষুধা মুক্তির মোক্ষম দাওয়াই। 

এই গণতন্ত্র আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিধান চন্দ্র রায়, যাঁর সিংহাসনের এক দিকে ছিল রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ আর অন্য দিকে মার্কিন সেনার থেকে যুদ্ধের পরে কেনা কোল্ট রিভলবার হাতে নিয়ে পাঁঠা আর বোসের মতন গুন্ডারা। 

বর্তমান ও বিধান চন্দ্র রায় 

বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে যে নৈরাজ্য, যে অত্যাচার সাধারণ গরিব মানুষ সহ্য করছেন, যে ভাবে রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুঠ হচ্ছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, যে ভাবে বাম দলগুলোর গণআন্দোলন কে লুম্পেন বাহিনী আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ও অবাধে গোটা রাজ্যের অর্থনীতির সাথে সাথে এর রাজনীতি ও সমাজের উপর মাড়োয়ারি-গুজরাটিদের প্রতিপত্তি কে প্রতিষ্ঠিত করতে দেওয়া হচ্ছে বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তাতে কী ভাবে মনে হতে পারে যে বিধান চন্দ্র রায়ের শাসন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে পশ্চিমবঙ্গ?

যে রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বঙ্গবাসী জনগণ কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে, যে রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দাঙ্গা, হিংসা ও গুন্ডাদের তান্ডবের মধ্যে, যে রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটে জিততে হয়েছে গুন্ডা ব্যবহার করে, রিগিং করে, সেই রাজ্যে বর্তমানে কী ভাবে আইনের শাসন আর গণতন্ত্রের আশা করা যায়? বিধান চন্দ্র রায়ের দেখানো পথেই এগিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ। আর এটাই চিন্তার বিষয়। 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla