পুতিনের ভারত সফর কেন মোদীর উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে?
বৃহস্পতিবার, ৪ঠা ডিসেম্বর, সন্ধ্যায় ভারত সফরে নয়া দিল্লী পৌঁছালেন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পরে এটাই পুতিনের প্রথম ভারত সফর। আর তাই এর দিকে শুধু ভারত না, তাকিয়ে আছে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতি বছরের মতন এই বারেও ভারত-রুশ শিখর সম্মেলন হবে, আর তাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে প্রথাগত ভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করা নিয়ে প্রতিবারের মতন এবারেও আলোচনা করবেন পুতিন।
পুতিনের ভারত সফরের শুরুতেই তাঁকে মহা আড়ম্বরে স্বাগত জানান মোদী। বিমানবন্দর থেকে সোজা তাঁর বাসভবনে রুশ রাষ্ট্রপতিকে ব্যক্তিগত নৈশ্য ভোজের জন্যে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান মোদী। সেখানে দুই নেতার মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
তাঁর ভারত সফরের আগেই ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেস্কভ ২রা ডিসেম্বর নয়া দিল্লীর ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে তিনি ভারত-রুশ দ্বিপাক্ষিক রণনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে মস্কোর মতামত ব্যক্ত করেন।
তিনি ভারতের সাথে সামরিক, প্রযুক্তিগত, ও পারমাণবিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আশ্বাস দেন তবে কোনো স্পষ্ট পথ দেখান না।
যদিও নভেম্বরের শুরুতেই মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা সংগঠনের (এসসিও) সরকার প্রধানদের পরিষদের বৈঠকে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যোগ দেন, এবং ভারত-রুশ সম্পর্ক নিয়ে রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন, মোদী সরকার কিন্তু বর্তমানে পুতিনের ভারত সফর নিয়ে উদ্বেগেই রয়েছে।
কূটনীতির তৈলাক্ত বাঁশ
পুতিন ভারত সফরে আসার কথা এই বছরের মে মাসে ঘোষণা করেন। কিন্তু তখন ভারত এই নিয়ে উচ্ছাসিত হলেও বর্তমানে মোদী সরকারের কপালে ভাঁজ পড়েছে। এর কারণ হলো তেলের কূটনীতি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার থেকে ভারতের সস্তায় জ্বালানি তেল কেনার কারণে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের উপর ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ভিত্তি শুল্ক ২৫% হওয়ায়, মোট ৫০% শুল্কের বোঝা চেপেছে ভারতের পণ্যের উপর।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার, তাই এই অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা ভারতীয় রপ্তানিমূলক শিল্পগুলোর জন্যে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলোর জন্যে ব্যাপক সঙ্কট তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটিই দাবি—ভারত রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি বন্ধ করুক।
ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। কিন্তু আবার যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মানলে রাশিয়ার সাথে সামগ্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যেমন অবনতি হতে পারে, তেমনি দেশীয় রাজনীতিতে মোদী মুশকিলে পড়তে পারেন।
এর আরও বড় কারণ হলো এর ফলে মোদীর শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। বিরোধীরা মোদী কে ট্রাম্পের হুমকির মুখে দেশের সার্বভৌমত্বকে বন্ধক রাখার অভিযোগ তুলতে পারে।
এ ছাড়াও এর আগে, মে মাসে তিনিই মধ্যস্থতা করে ভারত-পাকিস্তানের সাড়ে তিন দিনের সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধ করিয়েছিলেন বলে ট্রাম্প দাবি করেন। যদিও মোদী সরকার ভারতের অপারেশন সিঁদুর বন্ধ করার পিছনে মার্কিন চাপ থাকার কথা অস্বীকার করে, পাকিস্তান ট্রাম্পের দাবিকে সঠিক বলে ঘোষণা করেছে। ফলে এই বিষয়ে মোদী সরকার যথারীতি চাপে থেকেছে নিজের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি রক্ষা করার তাগিদে।
এখন ট্রাম্পের চাপে তেল কেনা হ্রাস করলেও একেবারে বন্ধ করে দেওয়া মোদী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে অতি ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য দেখিয়ে পশ্চিমাদের ক্ষুন্ন করাও মোদী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এর কারণ জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে ও ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাকে প্রধান অতিথি করা হতে পারে বলেও সাউথ ব্লকে তীব্র আলোচনা চলছে।
কিন্তু রাশিয়াকে দূরে ঠেলে দেওয়াও মোদীর পক্ষে সম্ভব নয়। এর কারণ দুটি দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রায় আট দশক পুরানো। ১৯৭১ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি বিদ্যমান। যদিও মোদী সরকারে আসার পর থেকে ভারতের রাশিয়ার উপর সামরিক নির্ভরতা কমিয়েছেন, এবং ইজরায়েলের থেকে অস্ত্র আমদানি বাড়িয়ে ভারতীয় সামরিক সরঞ্জামের উপর রাশিয়ার এক ধরণের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কে খর্ব করেছেন, তবুও নয়া দিল্লী সামরিক দিক থেকে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল।
রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অপারেশন সিঁদুরের সময় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে বলে মোদী সরকার দাবিও করেছে। কিন্তু এই সম্পর্কের কারণে ভারতের উপর ট্রাম্পের শাস্তিমূলক শুল্ক চাপানোয় যে ক্ষতি হবে তা নির্মূল হবে না যদি না নয়া দিল্লী মস্কোর থেকে তেল কেনা বন্ধ করে কিংবা রুশ-ইউক্রেন শান্তি চুক্তি কার্যকর হয়।
পুতিন ভারত সফরে আসার আগে কূটনৈতিক সমস্যা
২০২৪ সালে নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হওয়ার পরে মোদী জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিতে ইতালি যান। ওখান থেকে ফিরে, চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর সাথে সাক্ষাৎ এড়িয়ে যেতে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত এসসিও শিখর সম্মেলনে তিনি যোগ দেননি সেই বছর।
কিন্তু তার পরেই তিনি রাশিয়ায় যান পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান এই বার্তা দিতে যে তিনি রাশিয়াকে বয়কট করছেন না। কিন্তু এই সফর পশ্চিমাদের চটিয়ে দেয় এবং তাদের তোষণ করতে ও ভারসাম্য দেখতে মোদী পোল্যান্ডের পাশাপাশি ইউক্রেন সফর করেন।
তিনি বিশ্বের এমন একজন বিরল সরকার প্রধান, যিনি ২০২৪ সালে পুতিন, ভ্লাদিমির জেলেনস্কি, ও জো বাইডেন কে আলিঙ্গন করেছিলেন।
যদিও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী সামরিক অক্ষ কোয়াডের অংশীদার, তবুও ভারতের শিল্প মহলের যোগানের সঙ্কট কাটাতে তাঁকে তাঁর সরকারের ২০২০ সাল থেকে নেওয়া চীনের থেকে আমদানির উপর নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার সিদ্ধান্ত যখন নিতে হয়েছে, তখন তিনিই আবার পুতিনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন চীন-ভারত সম্পর্ক কে পুনরায় স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে।
এর ফলে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস গোষ্ঠীর সম্মেলনে ২০১৯ সালের পর প্রথমবার মুখোমুখি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মোদী ও শি। এর ফলেই কিন্তু ২০২৫ সালের অগাস্ট মাসে যখন ট্রাম্প তাঁর শাস্তিমূলক অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা ভারতের উপর চাপিয়ে দেন, তখন রাশিয়ার পরোক্ষ উৎসাহ দানেই মোদী এসসিও শিখর সম্মেলনের জন্যে চীন যাত্রা করতে প্রস্তুত হন।
যদিও চীনে এসসিও সম্মেলনের দৃশ্য দেখিয়ে রুশ সংবাদ মাধ্যম দাবি করে যে ভারতও পশ্চিমাদের ত্যাগ করে রুশ-চীন মৈত্রী জোটের অংশীদার হয়েছে, মোদী কিন্তু বারবার পশ্চিমাদের অন্য বার্তা দিয়েছেন।
চীনে যাওয়ার আগেই তিনি জাপান সফর করেন ও সেখানে চীন-বিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের রণনীতির সপক্ষে দাঁড়ান। যদিও চীনে তিনি এসসিও-র ইরানের উপর ইজরায়েল-মার্কিন হামলার নিন্দা করা প্রস্তাবে সই করেন, এর পরেই কিন্তু তিনি সামাজিক মাধ্যমে বারবার মার্কিন রাষ্ট্রপতির স্তুতি গাইতে শুরু করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতিও তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন কিন্তু শুল্ক পরিহার করেননি।
ভারতের বিদেশ নীতিতে গত দেড় দশকে যে ভাবে পশ্চিমা নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার ফলে নয়া দিল্লীকে যে করেই হোক যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ থাকতে হবে। রাশিয়ার সাথে মৈত্রী থাকলেও, চীন-বিরোধী যুদ্ধ জোটে ভারত শরিক থাকতে বাধ্য যুক্তরাষ্ট্র-তোষণ নীতির কারণে। এর ফলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের থেকে বাইডেন আমলে আধুনিক এফ-৩৫ ইঞ্জিন নির্মাণের বরাত পায়। কলকাতায় চিপ তৈরির কারখানার বরাতও কোয়াডের থেকে পায়।
বর্তমানে যখন রুশ সংসদ দুমায় ভারত-রুশ যৌথ সামরিক সহযোগিতার চুক্তি পাশ হয়ে গেছে এবং তাঁর বাসভবনে নৈশ্য ভোজের মাঝে পুতিনের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় মোদী ব্যস্ত, তখনই কিন্তু তাঁর বাণিজ্য মন্ত্রী পীযুষ গোয়াল এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন লকহিড মার্টিনের কর্তাদের সাথে তাঁর বৈঠকের ছবি। লকহিড মার্টিনের সাথে বৈঠকের ছবি ইঙ্গিত করছে ভারত যে কোনো ভাবেই মার্কিন এফ-৩৫ প্রযুক্তি চায় ভারতে উৎপাদনের জন্যে এবং শাস্তিমূলক শুল্ক থেকে নিজেকে বাঁচানোর এটাই একটি উপায় বলে গণ্য করছে নয়া দিল্লী।
মস্কোর সাথে সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের সাথে সাথে এই সব সম্ভাবনার ভেস্তে যাওয়ার যে ঝুঁকি থাকে, তা নিয়ে নয়া দিল্লী অবগত থাকলেও, এই ঝুঁকি সে কোনো ভাবেই কাঁধ থেকে নামাতে পারছে না।
পুতিন ভারত সফরে এলে কি বাড়বে ভারতের সমস্যা
যদিও পুতিন ভারত সফরে আসার আগেই ভারত বারবার ব্যক্ত করেছে যে রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কোনো ভাবেই ট্রাম্পের হুকুমে পরিবর্তিত হবে না, বাস্তবে নয়া দিল্লী কিন্তু যে কোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মেরামত করতে ও একটি বাস্তব সম্মত বাণিজ্য চুক্তি করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
যেহেতু ট্রাম্প একজন অস্থির মতির রাষ্ট্র নায়ক বলে তাঁর সমালোচকেরা বলে থাকেন, ফলে তাঁর প্রশাসনের সাথে দরকষাকষি করতে ভারতকে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হলো যে ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্র সব চেয়ে বড় রপ্তানির বাজার যেখানে নয়া দিল্লী মুনাফা অর্জন করে।
২০২৪ সালেই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যে লাভ হয়েছে ৪,৫৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থ হাতছাড়া হওয়া ভারতের কাছে শুধু আর্থিক না বরং রণনৈতিক ক্ষতিও।
ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎকার করতে মোদী যখন যুক্তরাষ্ট্রে যান, সেখানে তিনি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কে ২০৩০ এর মধ্যে দ্বিগুন করার কথা বলেন।
ফলে একদিকে ভারতের কাছে চাপ হলো যুক্তরাষ্ট্র কে তোষণ করা অন্যদিকে পুতিনের সাথে মোদীর সখ্যতার ছবি এমন সময় তুলে ধরা যখন ইউক্রেন সংঘাত তীব্র হয়েছে ও পশ্চিমা শক্তিগুলো জেলেনস্কির সরকার কে অধিক মাত্রায় অস্ত্র ও অর্থ সরবাহ করছে।
এমন সময় পুতিন যদি ভারত সফরে আসেন, তার ফলে যে শুধু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রভাব পড়বে তাই নয়, বরং পশ্চিমা শক্তিগুলির, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের, সাথেও সম্পর্ক খারাপ থাকার বড় সম্ভাবনা থেকে যায়।
এই দোটানার মধ্যেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রক এখন বিভক্ত। আর এর মধ্যেই রাশিয়া ভারতের সাথে সম্পর্ক কে আরও উন্নত করে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

