Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the wpau-yt-channel domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the blog-designer-pack domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114
কর্ণাটকের হিজাব বিতর্কঃ মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার অধিকারের জন্যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই | পিপলস রিভিউ বাংলা - People's Review Bangla

দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উপকূলবর্তী জেলা উডুপির সরকারি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা কলেজ (পিইউ কলেজ) থেকে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ডিসেম্বর ২০২১-এ, তা আজ গোটা দেশে এবং বিদেশেও আলোচ্য। মুসলিম ছাত্রীদের তাঁদের প্রতি হওয়া বৈষম্যের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আজ শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আর বিরোধীদের মধ্যে সংঘাতের নতুন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দিয়েছে। কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক যেমন একদিকে মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিকে তুলে ধরেছে তেমনি, অন্যদিকে, এই আন্দোলন কে ব্যবহার করে ইসলামী মৌলবাদ হিজাব কে নারীর “নিজস্ব পছন্দ” হিসাবে চিহ্নিত করে এর পিছনে থাকা পুরুষতন্ত্রের বজ্রআঁটুনি কে আড়াল করে দিচ্ছে। 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কী ভাবে শুরু হল? 

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কর্ণাটকের স্কুল-কলেজগুলো দীর্ঘ এক বছর বাদে ধাপে ধাপে খোলা শুরু হয় করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকার পরে। এই সময়ে উডুপির সরকারি মহিলা পিইউ কলেজও খোলে এবং ছাত্রীরা ক্লাসে ফেরেন। এই কলেজে স্নাতক স্তরের সাথে সাথে উচ্চ মাধ্যমিকেরও ক্লাস, অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীরাও এই কলেজে ভর্তি হন মাধ্যমিকের পরে। এই ছাত্রীদের জন্যে সেখানে ইউনিফর্ম নির্ধারণ করা আছে। এই পিইউ কলেজে প্রায় ১,০০০ ছাত্রী পড়েন যার মধ্যে ৯৫ জন মুসলিম। 

ক্লাস শুরু হওয়ার পরে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ১৯ জন মুসলিম ছাত্রীও ক্লাস করতে কলেজে আসেন এবং তাঁদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন হিজাব পরিহিতা। খবরে প্রকাশ, পূর্বে কলেজ খোলা থাকাকালীন তাঁরা কোনোদিন হিজাব পরে ক্লাসে আসেননি। তাঁদের শিক্ষক যখন তাঁদের বলেন যে হিজাব পরে ক্লাস করার অনুমতি নেই, তখন এই ছাত্রীরা প্রতিবাদ করেন। শিক্ষক বিষয়টা কলেজের অধ্যক্ষের দৃষ্টিগোচর করেন আর অধ্যক্ষ এই ছাত্রীদের জানান যে আগের মতনই বিনা হিজাবে ক্লাস করতে হবে, কারণ হিজাব পরে ক্লাস করার অনুমতি নেই।  

এই কথা শুনে এই ছয়জন ছাত্রী জানান যে গত বার তাঁরা এই জন্যে হিজাব পরেননি কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন কলেজে হিজাব পরা যায় না এবং সেই মর্মে তাঁদের অভিভাবকেরা কলেজ কে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পরে যখন তাঁরা জেনেছেন সেই রকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেই কারণ তাঁদের আগের ব্যাচের ছাত্রীরাও হিজাব পরেই ক্লাস করতেন, তখন থেকে তাঁরাও হিজাব পরে ক্লাস করা শুরু করেছেন। অধ্যক্ষ এই সব শুনেও তাঁদের ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দেননি এবং সেই ছাত্রীরা যখন এই রকম বিদ্বেষ মূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন, তখন অধ্যক্ষ গোটা কলেজ ক্যাম্পাসেই হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে দেন এবং তার ফলে এই ছাত্রীদের কলেজ চত্বরেই ঢোকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। 

প্রতিদিন নিয়ম করে ক্লাসের সময়ে কলেজে আসার পরেও, শুধু মাথার একটি ওড়নার জন্যে তাঁদের কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয় না, দিনের পর দিন। এই ভাবে প্রবেশ বন্ধের পিছনে যে কর্ণাটক ও ভারতের শাসক দল বিজেপি ও তার পিতৃতুল্য সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) ইন্ধন আছে তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। 

জানুয়ারী ২০২২-এ এই প্রতিবাদের খবরটি ও ছাত্রীদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখার ছবি গোটা উডুপি জেলা ও উপকূলবর্তী কর্ণাটকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে নানা পিইউ কলেজে আর স্কুলে বিজেপির নেতৃত্ব হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে দেয়। তার পরে নানা জায়গায় হিন্দু ছাত্রদের ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচারের মাধ্যমে উত্তেজিত করা শুরু করে আরএসএস ও বিজেপি। মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে কলেজে ঢুকলে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরাও গেরুয়া শাল গায়ে ক্লাস করতে যাবে বলা হয়। যদিও ইসলামের হিজাবের মতন জামা কাপড়ের উপর গেরুয়া শাল গায়ে দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কোনো রেওয়াজ কোনো কালেই হিন্দুদের মধ্যে ছিল না। 

ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিতর্ক তীব্র হয়ে ওঠে আর কর্ণাটকের নানা জেলায় কলেজে কলেজে ছাত্রীদের হিজাব পরার কারণে হেনস্থা করা হয়। পথে নামে নানা মুসলিম সংগঠন। আর মুসলিমদের একটি পরিচয়-ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখে তাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের মেরুকরণ করার কাজ শুরু করে আরএসএস আর বিজেপি। যে বিজেপির নেতারা গায়ে গেরুয়া বসন পরে, সন্ন্যাসী সেজে সংসদে যান, উত্তর প্রদেশের মতন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন, আর শিক্ষার গেরুয়াকরণ করতে থাকেন নির্লজ্জের মতন, সেই বিজেপি হঠাৎ “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গন ধর্মনিরপেক্ষ” বলে উল্টো সুর গাইতে শুরু করে।  

যে দেশের প্রতিটি সরকারি স্কুলেই হিন্দু শ্লোক পাঠ করা হয় সকালের প্রার্থনায়, যেখানে স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পূজা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা কে কাঁচকলা দেখিয়ে, সেই দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শাসকদল হঠাৎ ধর্মীয় পরিচয়হীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা শুরু করেন ছয়জন মুসলিম ছাত্রী নিজেদের মাথায় ওড়না দিয়ে ক্লাস করতে চাওয়ায়। 

এই ঘটনার ফাঁকে, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই কর্ণাটক শিক্ষা আইন, ১৯৮৩, এর ১৩৩(২) ধারা কে তুলে ধরে বলেন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম ব্যাতিত আর কিছুই পরা যাবে না। কর্ণাটকের শিক্ষামন্ত্রী নাগেশ বিসি সরকারি মহিলা পিইউ কলেজ কতৃপক্ষের পক্ষে দাঁড়ান আর বলেন যে হিজাব যেহেতু ইউনিফর্মের অংশ নয় তাই তা ক্লাসে পরা যাবে না। এর সাথে সাথেই সরকার গেরুয়া শাল গায়ে দিয়ে ক্লাস করার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে “নিরপেক্ষতার” ভাণ করতে। যেহেতু হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীদের গেরুয়া শাল গায়ে দিয়ে ক্লাস করতে যাওয়ার রেওয়াজ কোনোদিনই ছিল না, তাই তাঁরা এক বাক্যে সরকারি নির্দেশ মেনে নেন, কিন্তু মুসলিম ছাত্রীরা এই নির্দেশ মানতে চাননি। 

আন্দোলনরত মুসলিম ছাত্রীরা কর্ণাটক হাই কোর্টের কাছে বিচার চাইতে গেলে কোর্ট সেই মামলার রায় দিতে চায়নি। বরং কোর্ট একটি অন্তর্বর্তী আদেশে বলেছে যে ধর্মীয় কোনো চিহ্ন গায়ে দিয়ে এই মামলার রায় না আসা পর্যন্ত ক্লাস করা যাবে না। যদিও ছাত্রীরা সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে মামলা করেন, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত বলটি কর্ণাটক হাইকোর্টের কোর্টে ছুড়ে দিয়ে এই বিষয়ে নাক গলাতে অস্বীকার করেছে। 

যদিও কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক চলাকালীন বোম্মাই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন, কর্ণাটক হাই কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশ আসার পরে তিনি ঘোষণা করেন যে সোমবার, ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে সকল স্কুল-কলেজ আবার খুলবে ও ছাত্র-ছাত্রীরা যেন আদালতের নির্দেশ মেনে ক্লাস করতে আসেন। এর ফলে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা গেরুয়া শাল ছাড়া ক্লাস করার অধিকার পেলেও, হিজাব পরিহিতা মুসলিম ছাত্রীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কী ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে সাহায্য করলো? 

দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সঙ্কট আর ক্রম বৃদ্ধিমান বেকারত্বের জ্বালায়, মূল্যবৃদ্ধির চাপে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া জাতিগুলো (ওবিসি), সমাজচ্যুত ‘অচ্ছুত’ দলিত সম্প্রদায় আর আদিবাসীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রয়েছেন। সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিস্টান আর শিখেরা তো বিজেপির বিরোধিতা করেই চলেছেন।  

দেশের উত্তরে কৃষক আন্দোলনের চাপে, উত্তর প্রদেশ আর বিহারে চাকরি প্রার্থী যুবদের আন্দোলনের চাপে, শ্রমিক ও কর্মচারীদের নতুন শ্রম আইন আর বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলেও মোদী সরকার প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। উত্তর প্রদেশ সহ পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তাই অনর্গল প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কে সাম্প্রদায়িক উস্কানির সাহায্য নিতে হচ্ছে। 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কে মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষার সমান অধিকারের দাবির থেকে খুবই সুচারু ভাবে পরিচয়-ভিত্তিক আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করালো রাজ্যের সঙ্কটগ্রস্ত বিজেপি সরকার। বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিজের গদি হারাতে বসা বোম্মাইয়ের কাছে কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক এনে দিল এক সোনালী সুযোগ। 

প্রথমতঃ এই ইস্যুটি কে ইসলাম বিদ্বেষী মসলা মাখিয়ে প্রচার করা শুরু করে আরএসএস। এই প্রচার যুদ্ধে আরএসএস এর পক্ষে দাঁড়ায় দিল্লী-নয়ডা-স্থিত বিজেপির সব স্তাবক মূলধারার সংবাদ মাধ্যম সংস্থাগুলো। এর ফলে দেশের আপামর হিন্দু জনগণ কে বোঝানোর চেষ্টা হতে থাকলো যে মুসলিম ছাত্রীরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তৈরি ইউনিফর্ম না পরে শুধুই ধর্মীয় পোশাক পরে স্কুল-কলেজে আসতে চান। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মধ্যে সুপ্ত ইসলাম বিদ্বেষ কে খোঁচা দিয়ে উত্তর প্রদেশ আর বাকি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যেই ধর্মীয় মেরুকরণ কে আরও তীব্র করলো বিজেপি কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কে ব্যবহার করে। 

দ্বিতীয়তঃ কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক ব্যবহার করে আরএসএস অপ্রাপ্তবয়স্ক হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীদের মন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী প্রচারের মাধ্যমে বিষিয়ে দিয়েছে। নিজেদের সংগ্রামরত মুসলিম সহপাঠিনীদের প্রতি সংহতি দেখিয়ে তাঁদের সমান শিক্ষার অধিকারের দাবিতে লড়াই না করে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা গলায় গেরুয়া শাল জড়িয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে তাঁদের বিরোধিতা করছেন। একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে কী ভাবে অসংখ্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ছাত্র আর যুবদের দল একটি বোরখাধারী ছাত্রীকে——যাঁর নাম মুস্কান খান——ঘিরে ধরে “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিয়ে তাঁকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল। সেই মেয়েটি রুখে দাঁড়িয়ে “আল্লাহু আকবার” বলায় সেই ছাত্ররা আরও ক্ষেপে যায়। শিবমোগা জেলায় একটি কলেজে গেরুয়া শাল পরিহিত ছাত্ররা “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিয়ে আরএসএস-এর গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় জাহির করে। এই ঘটনার থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে কী মারাত্মক ভাবে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে এই ছাত্রদের অভিভাবকেরাও তাঁদের সন্তানদের ফ্যাসিস্ট দস্যু হয়ে যাওয়ায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছেন না। 

তৃতীয়তঃ কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কে ব্যবহার করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মুসলিম ছাত্রীদের একঘরে করে দেওয়ার প্রচেষ্টা রাজ্যের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় শুরু হয়েছে। যেহেতু বেশির ভাগ গরিব আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিম মহিলা কে সমাজের নিয়মে, বাড়ির আদেশে, ধর্মীয় আচারের কারণে হিজাব বা বোরখা পরতে হয়, তাই যদি তাঁদের হিজাব ছাড়া কলেজে আসতে হয় তাহলে কট্টর পুরুষতান্ত্রিক মুসলিম সমাজের প্রচুর ছাত্রীর জীবনে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। তাঁদের স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা পড়বেন গভীর সঙ্কটে, আর সেটাই বিজেপির চাই। ২০১১ সালের জনগণনার হিসাবে মুসলিমেরা জনসংখ্যার ১৫% হলেও, উডুপিতে তাঁরা জনসংখ্যার ৯.৫৬% এবং সমগ্র মুসলিম সমাজের সাক্ষরতার হার উডুপিতে তখন ৮০.৬৫% হলেও মুসলিম নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৭৮.৮৩%। অতএব, এর অনেক কম সংখ্যাই উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারে, আর সেই ক্ষেত্রে সরকার যদি পোশাকের কারণে মুসলিম নারীদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়, তাহলে তাঁদের জীবন কে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে। 

আরএসএস আর বিজেপি ঘৃণা চাষ করছে উডুপির মাটিতে 

দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ কর্ণাটক জুড়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীরা “লাভ জেহাদ” এর গল্প ফেঁদে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেমন হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল অংশ কে আর ওবিসি-দলিতদের ক্ষেপিয়েছে, তেমনি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় প্রচার বন্ধ করতে সন্ত্রাসের সাহায্য নিয়েছে। মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে যে আন্দোলন উডুপিতে গড়ে উঠেছে, তাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা সংবাদ, কুৎসিত অপপ্রচার, প্রভৃতির সাহায্যে বিজেপি আর আরএসএস সেখানে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার উস্কানি দিচ্ছে। 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক যে পিইউ কলেজ থেকে শুরু হয়েছে সেই কলেজের মাথায় আছেন উডুপির বিজেপি বিধায়ক কে রঘুপথী ভট্ট। তিনি এই বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন ও ছাত্রীদের হিজাব পরার বিরোধিতা করেছেন। উডুপি কলেজ উন্নতিকরণ কমিটির সহসভাপতি যশপাল সুবর্ণ হলেন বিজেপির ওবিসি মোর্চার নেতা। তিনি বলেছেন “ওদের (প্রতিবাদী ছাত্রীদের) পড়াশুনা করার কোনো ইচ্ছা নেই, ওরা দেশের উন্নয়ন কে সহ্য করতে পারে না… আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল হিন্দু রাষ্ট্র।” এহেন হিন্দু রাষ্ট্রের লক্ষ্যে বিজেপি আজ উডুপি ও উপকূলবর্তী কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রীদের এই হিজাব পরাকে কেন্দ্র করে তাঁদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।  

এর কারণ হল আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের দর্শন ব্রাক্ষণত্বের দর্শনের ভিত্তিতে সাবর্ণ জাতির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় ও ওবিসি, দলিত, আদিবাসীদের তাদের গোলামে পরিণত করতে চায়। এই হিন্দু রাষ্ট্রে মুসলিম, খ্রিস্টান আর শিখদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের স্থান জুটবে এবং সবাই কে এই ব্যবস্থার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখতে হবে।  

এহেন হিন্দু রাষ্ট্রে যদি মুসলিম নারীরা শিক্ষিত হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ান, নিজেদের অধিকারের জন্যে আওয়াজ তোলেন, তাহলে আরএসএস আর বিজেপির পক্ষে তাঁরা বিপজ্জনক হয়ে উঠবেন। যদিও মুসলিম নারীদের জন্যে মোদী আর বিজেপির নেতারা মাঝে মাঝেই কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেন তাঁদের ইসলামিক পিতৃতন্ত্রের শিকার বলে ঘোষণা করে——যদিও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা ভাগলপুর, মুম্বাই, গুজরাট, মুজ্জফরনগর, প্রভৃতি মুসলিম গণহত্যার সময়ে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীরা মুসলিম নারীদের গণধর্ষণ করে, তাঁদের পেট কেটে ভ্রুণ বের করে মেরে ফেলে তাঁদের, তখন এই নেতারা চুপ থাকেন——নানা রকমের গল্প শোনান, সেই মুসলিম নারীদের নিজেদের অধিকার দাবি করার দৃশ্য হিন্দুত্ববাদীদের চোখের বালি হয়ে যায়।  

ফলে এই দেশেইি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা সংগঠিত একটি আট বছরের মেয়ে আসিফা বানোর গণধর্ষণ আর হত্যার ঘটনায় বিজেপি নেতারা জাতীয় পতাকা হাতে অপরাধীদের সমর্থনে মিছিল করেন। তাঁদের নেতারা মুসলিম মহিলাদের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার কথা বলেন, সেই হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম মহিলাদের ইন্টারনেটে নিলাম করার জন্যে ওয়েবসাইট বানায়। এহেন হিন্দুত্ববাদীরা যে এই ছয়টি মেয়েকে ছেড়ে কথা বলবে না সে কথা বলাই বাহুল্য।  

খবরে প্রকাশ যে এই ছয়টি মেয়ের ভর্তির ফর্মের স্ক্যান করা ফটো হোয়াটস্যাপ দিয়ে গোটা উডুপিতে ছড়িয়ে দিয়েছে আরএসএস আর বিজেপির লোকেরা। তারা এই প্রতিবাদী ছাত্রীদের বাড়ির অভিভাবকদের ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। যদিও মেয়েগুলি অকুতোভয় হয়ে নিজেদের দাবিতে আন্দোলন করছেন, আরএসএস আর বিজেপি তাঁদের বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কে ক্ষেপিয়ে তুলে আরও বেশি বিষিয়ে দিচ্ছে পরিবেশ কে। আর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো সংগঠিত শক্তি দক্ষিণ কর্ণাটকে এই মুহূর্তে অনুপস্থিত। 

কী ভাবে বিরোধীরা কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক নিয়ে বিজেপির ফাঁদে পা দিয়েছে? 

আরএসএস আর বিজেপি মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে হিজাব পরা কে কেন্দ্র করে। যে ছয়জন ছাত্রী এই লড়াই শুরু করেছেন নিজেদের অধিকারের জন্যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতার দাবিতে, তাঁদের এড়িয়ে বিরোধী দলগুলো——যেমন “নরম” হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস পার্টি, সর্বভারতীয় মজলিস‑ই‑ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (মিম), ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া (সিএফআই), প্রভৃতি——সবাই মুসলিম পরিচয়ের রাজনীতিতে জোর দিচ্ছে। 

একদিকে হিজাব একটি নারীর অধিকার, ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ইত্যাদী বলে পুরুষতন্ত্রের প্রতীকটিকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে আর অন্যদিকে সমগ্র আন্দোলনটি কে একটি হিন্দু বনাম মুসলিম দ্বন্দ্বে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নানা ধরণের মুসলিম মৌলবাদী শক্তি আর বিরোধী দলগুলো কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কে মুসলিম নারীর শিক্ষার অধিকারের লড়াইয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুই হিজাব পরার আর হিজাব কেন ভাল সেই বিতর্কে পরিণত করেছে। এর ফলে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের পাতা ফাঁদে তারা ব্যাপক মুসলিম জনগণ কে ফেলে দিয়েছে। 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক নিয়ে মিম, সিএফআই, প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী সালাফি সংগঠনের সুবিধাবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রচার কে ব্যবহার করে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা হিন্দু সমাজ কে, বিশেষ করে হিন্দু নারীদের কে, মুসলিম পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কত খারাপ আর হিন্দু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কত ভাল এর তুল্যমূল্য বিচার করাচ্ছে। যদিও ঘটনা হল হিন্দু রাষ্ট্রে, ব্রাক্ষণতন্ত্রের শাসনে, কোনো হিন্দু নারীরও আর পুরুষের সমান অধিকার থাকবে না, তবুও সেটা গোপন করে আরএসএস ও বিজেপি শুধু মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হওয়ার গতি বদলে দিতে চাইছে নির্বাচনের মরশুমে। 

যদিও দক্ষিণপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলো হিজাব কে মহিমান্বিত করে একটি মুসলিম নারীর ইসলামিক পরিচয়ের ভিত্তি বলে, তারা কখনোই মুসলিম ছাত্রদের ফেজ টুপি পরে ক্লাস করতে যাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে না বা মুসলিম পুরুষদের ঘরের বাইরে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কাজে যেতে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে বলে না। ধর্মীয় পরিচয়ের পতাকা নিজেদের পোশাকের মাধ্যমে শুধুই মুসলিম নারীদের বহন করতে বলা হয়। আর এর ফলে মুসলিম নারীদের আরও বেশি করে রক্ষণশীল বেড়ার ভিতর নিজেদের গন্ডিবদ্ধ করে রাখতে হয়। 

সামনের পথ কী? 

কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক হল মুসলিম ছাত্রীদের সমান শিক্ষার অধিকারের লড়াই। ভারতবর্ষে বা বিশ্বের কোনো দেশে একটি নারী কী পরবে আর কী পরবে না তা ঠিক করার অধিকার সেই নারী ব্যাতিত আর কারুর থাকা উচিত নয়। জোর করে কাউকে হিজাব পরতে বলা যেমন পুরুষতান্ত্রিক শোষণের অঙ্গ তেমনি জোর করে কারুর হিজাব খুলে নেওয়া হল সেই নারীর শ্লীলতাহানি করার নামান্তর। আজ বিজেপি গোটা কর্ণাটকে, এবং এর পরে গোটা ভারতে, মুসলিম ছাত্রীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যাতে তাঁদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়। মুসলিম ছাত্রীদের পক্ষে, বিশেষ করে উডুপির সরকারি মহিলা পিইউ কলেজের গরিব আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিম বাড়ির রক্ষণশীল মহলে বড় হওয়া ছাত্রীদের পক্ষে, হিজাব ছাড়া যেহেতু বাড়ির থেকে বের হওয়াই সম্ভব না, সেহেতু তাঁদের যে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনা হিজাবে আসা হবে না সে কথা সহজেই বোধগম্য হয়। 

মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষার সমান অধিকারের লড়াই এই জন্যে জরুরী কারণ একমাত্র শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই তাঁরা সশক্তিকরণের পথে হাঁটতে পারবেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভাবে গড়তে পারবেন। সেই পথে যদি আরএসএস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে দ্বায়িত্ব মুসলিম দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলোর নয়, বরং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক হিন্দুদের যে তাঁরা যেন পথে নেমে এই মুসলিম ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ান, সংহতি ব্যক্ত করেন ও তাঁদের লড়াই কে জোরদার করেন। 

আশার ব্যাপার হল বহু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক নিয়ে পথে নেমেছেন। তাঁরা প্রতিবাদ করছেন এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের। অন্যদিকে অনেক দলিত ছাত্ররা গলায় নীল শাল জড়িয়ে, “জয় ভীম” স্লোগান তুলে ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সংহতির বার্তা নিয়ে। আজ এই ভাবে আরও সব ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল আর গণতান্ত্রিক-ফ্যাসিবিরোধী শক্তির এগিয়ে আসা উচিত। 

যে দেশে কর্পোরেটদের মুনাফার পাহাড় গড়তে দেওয়ার স্বার্থে মোদী সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ ব্যবহার করে সমস্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কে ধ্বংস করে বেসরকারি ক্ষেত্রের রমরমা ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে, সেই দেশে বিজেপি যে কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক কে কেন্দ্র করে মুসলিম ছাত্রীদের জীবন ধ্বংস করতে চাইছে সে কথা সহজলভ্য। কিন্তু আজ কি বিজেপি কে ফ্রি-হ্যান্ড দেওয়া উচিত? কোনো ধরনের ছাড় কি বিজেপি বা আরএসএস কে দেওয়া উচিত? 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla