মুস্কান খান একজন বোরখা পরিহিতা বছর কুড়ির মুসলমান কলেজ ছাত্রী। সে হয়ত ছোটবেলার থেকেই ভারতকে, তার সংস্কৃতিকে, খানিক অন্যভাবেই চিনে এসেছে। যেখানে প্রতিদিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঠেলেঠুলে নিজের জায়গাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যা এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে এমন কিছু নতুন বিষয় নয়। এই কথা ধরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিও-টির প্রেক্ষাপট কর্ণাটকের একটি কলেজ চত্বর, যেখানে একটি বোরখা পরা মুসলমান ছাত্রীর দিকে এক দঙ্গল গেরুয়া ওড়না জড়ানো উদ্যত যুবকেরা “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিতে দিতে ধেয়ে আসে়। এরপরে ঠিক যা ঘটল তা নাগরিকদের খানিক স্তম্ভিত করে তুলল। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকগুলির দিকে মুঠো হাত ছুঁড়ে ‘আল্লা-হু-আকবর’ বলে চিৎকার করতে থাকল। ভিডিওটিতে দেখা যায় শীর্ণকায় মেয়েটির চোখে যেন ভয়ঙ্কর রাগ। এই ঘটনার পর স্তম্ভিত নাগরিকদের একাংশ যখন মেয়েটির অদম্য সাহসে মোহিত তখন আর এক দল স্বাভাবিক নিয়মেই আলোচনায় খানিক বিতর্কের মাল মশলা ঢালল। “আল্লা-হু-আকবর কি জয় শ্রী রামকে ঠেকাতে পারে?”, এই মুহূর্তে এই প্রশ্ন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমাদের বুঝে নেওয়া প্রয়োজন এই ‘হিজাব ইজ আওয়ার রাইট’——হিজাব আমাদের অধিকার——এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট-টা ঠিক কী। কর্ণাটকের উডুপির সরকারি মহিলা প্রি ইউনিভার্সিটি কলেজে ছয় জন ছিজাব পরিহিতা মুসলমান ছাত্রীকে গত ডিসেম্বর মাসে ক্লাস করতে বাঁধা দেওয়া হয়ে। এই ঘটনার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ‘হিজাব ইজ আওয়ার রাইট’ এই হ্যাশটাগে প্রতিবাদ শুরু হয়। ঘটনাটির পর পরই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-সমর্থিত কিছু ছাত্রকে দেখা যায় গলায় গেরুয়া ওড়না জড়িয়ে হিজাব নিষিদ্ধ করবার দাবি তুলতে। অন্যদিকে দলিত ছাত্রদের একাংশকে নীল ওড়না জড়িয়ে মুসলিম ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতেও দেখা যায়। আর এইসবের মাঝেই ঘটে যায় মুস্কানের ঘটনা।
ভারতের সংবিধানের ১৯ (১) (ক) ধারা নিজের ধর্মচারণ করবার অধিকার সমস্ত ভারতবাসীর আছে, অর্থাৎ সেই ধর্মের চিহ্ন হিসাবে কোনো পোশাক পরার অধিকারও সবার আছে। যদিও এই সংবিধান বা সংবিধান স্বীকৃত অধিকারের দফারফা এর আগেও একাধিকবার একাধিক সরকারের দ্বারাই হয়েছে। তবে এখন প্রশ্ন মুস্কানের “জয় শ্রী রাম” স্লোগানের বিরুদ্ধে আল্লা হু আকবর ধ্বনি আমাদের ঠিক কী বার্তা দেয়?
“জয় শ্রী রাম” কোন ধর্মীয় স্লোগান নয়; এটি সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক স্লোগান। দেশ থেকে সংখ্যালঘু তাড়ানোর এবং তাঁদের ধর্মাচরণের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করবার হাতিয়ার এই স্লোগান। দেশে যে কোন দাঙ্গা বা দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরির কালে আরএসএস-এর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলিকে এই স্লোগান তুলতে দেখা যায়। দেশে যতগুলো মব-লিঞ্চিন এর ঘটনার সাক্ষী আমরা থেকেছি, প্রায় প্রত্যেকটিতেই এই স্লোগান আমাদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। এই স্লোগানকে সমাজে যতই স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চলুক, এই স্লোগানের উৎস-র দিকে নজর দিলে স্পষ্ট হয়ে যাবে এই স্লোগানের মূল উদ্দেশ্য।
“জয় শ্রী রাম” স্লোগানের উৎস সম্পর্কে দ্বিমত থাকলেও যা জানা যায়, একদলের মত অনুযায়ী, ১৯৯০-১৯৯২ নাগাদ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যে রাম মন্দির আন্দোলন শুরু করে সেই সময় থেকেই এই “জয় শ্রী রাম” স্লোগানের ব্যবহার দেখা যায়। আর এক দলের মতে, গত শতাব্দীর আটের দশকে রামানন্দ সাগর যে রামায়ণ টেলিভিশন সিরিয়াল শুরু করেছিলেন, সেখানে প্রথম হনুমানকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিতে দেখা যায়। অনেকেই এই স্লোগানকে ধর্মীয় স্লোগান বলে আড়াল করবার চেষ্টা করে, তবে এর ইতিহাস বলে, এই স্লোগান তার জন্মলগ্ন থেকে ধর্মযুদ্ধ উস্কে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই একই কায়দায় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং অন্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলোও এই স্লোগানকে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াবার অস্ত্র হিসাবেই ব্যবহার করে।
হিন্দি-ভাষী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ‘রাম রাম’ বা ‘জ্যায় সিয়া রাম’ এর মতো শুভেচ্ছা প্রচলিত। কারুর সাথে সাক্ষাৎ হলে বা আলাপের সময় এই কথা বলতে শোনা যেত। এবং এই ‘রাম রাম’ বা ‘জ্যায় সিয়া রামের’ সাথে “জয় শ্রী রামের” একটা মৌলিক ফারাক আছে। এবং এই ফারাকটা বিস্তর। একটা নিছক আলাপচারিতার অংশ এবং অন্যটি ধর্মযুদ্ধ উস্কে দেওয়ার হাতিয়ার। ঝাড়খণ্ডে একটি সাইকেল চুরির অভিযোগে তাবরেজ আনসারি নামে একটি মুসলিম যুবককে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা জোর করে “জয় শ্রী রাম” বলতে বাধ্য করায়, তখনই প্রমাণিত হয় এই স্লোগানের উদ্দেশ্য। তাই আজ যখন এই স্লোগানের পাল্টা মুস্কান “আল্লা হু আকবর” বলল, তখন সেটা আর কেবল একটি ধর্মীয় স্লোগানে আটকে রইল না, কোথাও গিয়ে মেয়েটি এই উপমহাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘুদের সহবস্থান করবার যে অধিকার, নিজের ধর্মাচরণ করবার যে অধিকার, সেটা কোথাও গোটা দেশবাসীর কানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করল। হিজাব ভুল না ঠিক এই বিতর্ককে ছাপিয়ে আরো জরুরী একটি প্রশ্নের সামনাসামনি করে দিল আমাদের।