Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the wpau-yt-channel domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the blog-designer-pack domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114
বঙ্গ ভঙ্গ: চাওয়া আর না পাওয়ার একটি উপাখ্যান  | পিপলস রিভিউ বাংলা - People's Review Bangla

দেখতে দেখতে দুয়ারে আবার একটা স্বাধীনতা দিবস। আবার পাড়ায়-পাড়ায় তারস্বরে মাইকে হিন্দি দেশপ্রেমের গান বাজবে। মানুষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে সারা দিয়ে বাড়ির ছাদে তেরঙ্গা পতাকা ওড়াবেন। অনেক মোটরসাইকেল আর অটো রিক্সাতেও দেখা যাবে পতাকা। আর এই পতাকা উত্তোলনের মাঝে অনেকেই স্মরণ করবেন যে ১৪ই-১৫ই অগাস্ট ১৯৪৭ শুধুই স্বাধীনতা দিবস ছিল না, ছিল বাঙালির অস্তিত্ব কে বিপন্ন করার লক্ষ্যে করা বঙ্গ ভঙ্গ দিবসও। 

বাঙালি সহ বঙ্গের নানা জাতির মানুষের উপর একটা বড় কোপ ছিল এই বঙ্গ ভঙ্গ। ১৯৪৭ এর বঙ্গ ভঙ্গের আগে, ১৯০৫ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার এই কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল, তখন পূর্ব বঙ্গে নিজেদের জমিদারী ও আর্থ-সামাজিক প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে সাবর্ণ বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন এই সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট মানুষেরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের অন্যতম। 

১৯০৫ সালের বঙ্গ ভঙ্গ কে রোধ করার জন্যে গড়ে ওঠে চরমপন্থী আন্দোলন। সশস্ত্র সংগ্রাম করে ব্রিটিশ শাসকদের পরাজিত করার লক্ষ্যে ব্রতী হন ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের অসংখ্য যুব। অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়, যে লড়াইয়ে প্রাণ দেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল চাকী থেকে শুরু করে কানাইলাল দত্ত বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতন বিপ্লবীরা। আর এই অনুশীলন ও যুগান্তর এর মতন সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সংগ্রাম পরবর্তীতে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীন, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত, এবং মাস্টারদা সূর্য সেন নানা লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যান। 

যে বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসকের বঙ্গ ভঙ্গ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গেছিল ও নিজের জীবনের পরোয়া না করে ক্রমাগত লড়াই করেছিল, যে সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ভারতে প্রথম মার্কসবাদের প্রসার ও প্রয়োগ শুরু করেছিল, সেই সম্প্রদায় কেন ১৯৪৭ সালের বঙ্গ ভঙ্গ মেনে নিল? কেন যে বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় একদিন বঙ্গ ভঙ্গের বিরুদ্ধে রাখি বন্ধন অনুষ্ঠিত করেছিল, হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গ কে নিজের আর পূর্ব বঙ্গ কে পর করে নিল?

ধর্মীয় মেরুকরণ

বঙ্গ ভঙ্গ নিয়ে সাবর্ণ ভদ্রলোকের এই ১৮০-ডিগ্রী উল্টো অবস্থানের কারণ অবশ্যই তৎকালীন সময়ে হিন্দু মহাসভা ও মুসলীম লীগের করা ধর্মীয় মেরুকরণ। এই মেরুকরণের ভিত্তিটা কিন্তু গড়ে দিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চালিত তেভাগা আন্দোলন। মূলত পূর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক যেমন ছিলেন মুসলিম, তেমনি সেখানকার জমিদারদের সিংহ ভাগই ছিলেন সাবর্ণ ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের। 

ফলে যখন সাবর্ণ জমিদারদের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গে মূলত মুসলিম কৃষকদের সামন্তবাদ-বিরোধী আন্দোলন তীব্র হল, কৃষকের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জন্মালো, তখন সেই ক্ষোভ কে বিপথে চালিত করতে যেমন মুসলিম লীগ ধর্মীয় বিদ্বেষ কে কাজে লাগলো, তেমনি জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ ও অত্যাচার কে খাটো করে দেখিয়ে হিন্দু মহাসভা হিন্দু কৃষকদের ও শহুরে ভদ্রলোকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ তীব্র করতে সক্ষম হল।

এই মেরুকরণের জন্যেই ১৯৪৬ সালের কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করা হয়। ১৬ই অগাস্ট ১৯৪৬-এ মুসলিম লীগের “ডাইরেক্ট অ্যাকশন”-এর ডাক ঘিরে অশান্তি তীব্র হয়। অগাস্ট ১৯৪৬-এ “গ্রেটার ক্যালকাটা কিলিং” অনুষ্ঠিত হয়, যাতে কয়েক হাজার হিন্দু ও মুসলিম কে চার দিনের মধ্যে হত্যা করা হয়। নোয়াখালীর দাঙ্গায় অসংখ্য মানুষ কে হত্যা করা হয়। আর দুই পক্ষই নিজেকে আক্রান্ত ও অন্য পক্ষকে আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করতে থাকে। পরস্পরের প্রতি, নিজের প্রতিবেশীর প্রতি ভরসা কম হতে থাকলো এবং এর ফলে সামাজিক একটা গভীর ফাটল তৈরি হয়। 

সেই সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে কোনঠাসা মোহনদাস গান্ধী এই হত্যালীলা বন্ধ করতে অনশন করেন। মুসলিম লীগেরই প্রধানমন্ত্রী হুসেইন সুহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় এই দাঙ্গাকে শেষ পর্যন্ত দমন করা সম্ভব হয়। তবে এই দাঙ্গার ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে অবিশ্বাস জন্ম নেয় তা বঙ্গ ভঙ্গ করতে সাহায্য করে এবং চিরকালের মতন একটি বৈরিতামূলক সম্পর্কের জন্ম দেয়। 

হিন্দু না মুসলিম কে করেছিল বঙ্গ ভঙ্গ কে সমর্থন?

এই মেরুকরণ থাকার পরেও কিন্তু সেই সময়ে বঙ্গ ভঙ্গের রেফারেন্ডামের বেশির ভাগ মুসলিম বাঙালি নির্বাচক মন্ডলীর সদস্য বিরোধিতা করেন। কিন্তু বঙ্গ ভঙ্গের দাবিতে অটল থাকা হিন্দু মহাসভার প্রভাবাধীন বাঙালি হিন্দু প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব কে সমর্থন করেন। সেই সময়ে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, যাঁর সাম্প্রদায়িক নীতির ও ব্রিটিশ প্রেমের কট্টর বিরোধিতা এমনকি সুভাষ চন্দ্র বসুও করেছিলেন, গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে আর্জি জানান যে ভারত ভাগ হোক আর না হোক বাংলা যেন ভাগ হয়ই। 

মূলত মুখার্জীর নেতৃত্বেই হিন্দু মহাসভার সাথে সাথে কংগ্রেসের একটি বড় সাবর্ণ অংশ বঙ্গ ভঙ্গের পক্ষে দাঁড়ায়। তারা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ভয়াবহ ঘটনাগুলোর উল্লেখ করে ও নানা ধরণের মিথ্যা প্রচার করে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ও ভীতি ভীষণ ভাবে প্রোথিত করেন। 

মুখার্জীর হিন্দু মহাসভা, যা মূলত উত্তর ভারতীয় মাড়োয়ারি ও বেনিয়াদের সংগঠন ছিল, কোনো ভাবেই গঙ্গার পাড়ের মাড়োয়ারি শিল্পাঞ্চল গুলো, চটকল গুলো বা অন্যান্য ব্যবসা বাঙালিদের হাতে ছাড়তে রাজি ছিল না ও তার জন্যে এই সংগঠন দেদার পয়সা খরচ করে বড় ধরণের খুনোখুনি থেকে শুরু করে ক্রমাগত ইসলামবিদ্বেষী প্রচার চালাতেও তৈরি ছিল।

বঙ্গ ভঙ্গের বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ বাংলা 

এই মেরুকরণের বিরুদ্ধেও কিন্তু সেদিন এক নতুন ধারার দাবি উঠেছিল, যার প্রণেতা ছিলেন সুহরাওয়ার্দী ও কংগ্রেসের শরৎ চন্দ্র বোস। 

১৯৪৭ সালের ২৭শে এপ্রিল দিল্লীতে মাউন্টব্যাটেনের কাছে সুহরাওয়ার্দী ও বোস প্রস্তাব দেন “ঐক্যবদ্ধ বাংলা” গড়ার। তাঁদের প্রস্তাবে বলা হয় যে বাংলার একটি নিজস্ব অস্তিত্ব ও সত্ত্বা আছে, আছে একটি ভাষা ও অভিন্ন সংস্কৃতি। তাঁরা বলেন যে বাংলা নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগেও বজায় রেখেছিল এবং ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন দেশ হিসাবে থাকলে বাংলা অনেক বিকশিত ও উন্নত একটি দেশ হবে।

সুহরাওয়ার্দী বলেন, “আসুন এক মুহূর্ত থেমে ভাবি যে বাংলা কি হতে পারে ঐক্যবদ্ধ থাকলে। এটি একটি মহান দেশ হবে, প্রকৃতপক্ষে ভারতে সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশটি তার জনগণকে একটি উচ্চ জীবনযাত্রার মান দিতে সক্ষম হবে, যেখানে মহান জনগণ তাদের মর্যাদার পূর্ণ উচ্চতায় উঠতে সক্ষম হবেন, এমন একটি ভূমি যা সত্যই প্রাচুর্য্যে ভরা হবে; এটি হবে কৃষিতে সমৃদ্ধ, শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এবং সময়ের সাথে সাথে এটি হবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র। বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এইগুলো কোনো স্বপ্ন, কোনো কল্পনা থাকবে না।”

সুহরাওয়ার্দী ও বোসের এই প্রস্তাবে তখন সায় দেন অনেক মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতারা। যেমন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, “বাংলা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, … আমার আনন্দিত হওয়া উচিত। কলকাতা ছাড়া বাংলার কী ব্যবহার (পাকিস্তানের জন্যে?); তাদের ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন থাকতে দেওয়া অনেক ভাল; আমি নিশ্চিত যে তারা আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে থাকবে”। 

মুসলিম লীগের অন্য নেতাদের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী ফজলুর হক, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, ও লীগের বাংলা সম্পাদক আবুল হাশিম সহ অনেকেই এই ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রস্তাব কে সমর্থন করেন। এর সাথেই কংগ্রেসের কিরণ শঙ্কর রায় ও সত্য রঞ্জন বক্সী এই দাবিকে সমর্থন করেন। 

কিন্তু এই ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রস্তাব কে নাকচ করেন মুখার্জী কারণ তাতে তার সংগঠনে অর্থ দান করা মাড়োয়ারি-বেনিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। অন্যদিকে সেই একই বেনিয়া শ্রেণীর আতঙ্ক কে লাঘব করতে ঐক্যবদ্ধ বাংলার দাবিকে নাকচ করেন জওহরলাল নেহরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেল। দুই জনই অবাঙালি, তথাপি সেই উত্তর ভারতীয় ও গুজরাটি পুঁজির পক্ষের লোক। ফলে বড় লাট মাউন্টব্যাটেন আর কোনো ভাবেই এই প্রস্তাব কে নিয়ে উৎসাহ দেখাননি। 

ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ ভঙ্গ 

নেহরু, প্যাটেল, মুখার্জী ও জিন্নাহ কে সন্তুষ্ট করতে সেদিন র‍্যাডক্লিফ লাইন মেনে বঙ্গ ভঙ্গ হল। লক্ষ লক্ষ মানুষ কে ভিটে মাটি ছেড়ে দিল্লী ও লন্ডনের বানিয়ে দেওয়া সীমান্ত দিয়ে অন্য ভূমিতে, নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যে চলে যেতে হল, নিজের বাঙালি পরিচয় কে ভুলে। 

এর পরে যদিও বাঙালি মুসলিমেরা জিন্নাহ-র—আদতে হিন্দু মহাসভার নেতা ভিনায়ক সাভারকারের—দ্বিজাতির তত্ত্ব ও ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্ব কে নাকচ করে অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতি গঠনের পথ ধরেন ও সশস্ত্র সংগ্রাম করে পাকিস্তান থেকে নিজেদের স্বাধীন করেন, তবুও পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু রয়ে যায় সেই তিমিরেই, যেখানে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কে শেখানো হয় যে অভিন্ন ধর্ম হল একটি দেশের, একটি জাতির ভিত্তি। 

ফলে নানা ধরণের প্রগতিশীলতার ছাপ রেখে যাওয়া সাবর্ণ বাঙালি ভদ্রলোক ও উদ্বাস্তু নমঃশুদ্র জাতি কে হিন্দুত্বের ফাঁদে পড়তে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়না। বাম ও প্রগতিশীল সাজা বাঙালি সাবর্ণ হিন্দুদের ও জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর থেকে শুরু করে যোগেন মন্ডলের নেতৃত্বেও তীব্র লড়াই করা নমঃশুদ্রদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ কে সহজেই উন্মুক্ত করে দিতে পারে উত্তর ভারতীয় ও গুজরাটি বেনিয়াদের দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের চূড়ামণি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)।

তাই বর্তমানে অসমে অসংখ্য নমঃশূদ্র বাঙালিদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনলেও ও নানা ভাবে উদ্বাস্তু বাঙালিকে বেনাগরিক করে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পশ্চিমবঙ্গে আর ত্রিপুরায় বঙ্গ ভঙ্গের জন্যে দায়ী মুখার্জীর বিজেপি নির্বাচনে ব্যাপক ভাবে সাফল্য লাভ করছে। আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্র—যা আসলে উত্তর ভারতীয় ও গুজরাটি সাবর্ণ পুঁজিপতিদের একচেটিয়া শোষণ ও শাসনের ব্যবস্থা—গড়ার দাবিও আজ এই সম্প্রদায়ের মানুষ তুলছেন কারণ তাঁরা বাংলা বলা ও আমিষ খাওয়া বাঙালি মুসলিমদের থেকে বেশি করে হিন্দি বলা ও নিরামিষ খাওয়া উত্তর ভারতীয় সাবর্ণদের নিজের আপন ভাবতে শিখেছে। 

বঙ্গ ভঙ্গ – কমিউনিস্টদের ব্যর্থতা 

গত শতকের চারের দশকের শেষ দিকে যখন বঙ্গ ভঙ্গ করার তোড়জোড় করছে ধর্মীয় উন্মাদনায় মত্ত দলগুলো ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষাকারী কিছু নেতা, তখন একটি নাস্তিক ও প্রগতিশীল শক্তি হিসাবে এই ষড়যন্ত্র কে রুখে দেওয়ার যে দায়িত্ব কমিউনিস্টদের ছিল, বিশেষ করে বঙ্গের কমিউনিস্টদের, সেটা কিন্তু কোনো ভাবেই পালন করা হয়নি। 

নিজের জাতিকে বাঁচানোর চিন্তা না করে, কমিউনিস্ট পার্টির মূলত সাবর্ণ ভদ্রলোক নেতৃত্ব কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক নীতিকে একপ্রকার চুপ করে মেনেই ক্ষান্ত ছিল এবং কিছু প্রচারপত্র ও সম্পাদকীয় লেখা ছাড়া তাঁরা কোনো আন্দোলনে জড়াননি। বরং দলের মারাঠা নেতৃত্বের আদেশের অপেক্ষায় বসে থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিসর্জন দেন।

সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির দুই জন সদস্য প্রাদেশিক সভায় ছিলেন – জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ। কিন্তু তাঁরাও এই চক্রান্ত কে রুখতে কোনো বড় আন্দোলনের পথ ধরেননি। যে বাংলার গ্রামে গ্রামে তেভাগা আন্দোলন কমিউনিস্টরা গড়ে তুলেছিলেন, কারখানায় গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, তাও ব্রিটিশ শাসকের রক্তচক্ষু কে উপেক্ষা করে, সেই কমিউনিস্টরা কিন্তু লীগ ও মহাসভার সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ও বিভাজনমূলক রাজনীতি কে রুখতে এই শ্রেণীগুলো কে ঐক্যবদ্ধ করে কোনো প্রতিরোধে যাননি। বরং উদ্বাস্তুদের নিয়ে কলোনি তৈরি ও তাঁদের থাকার জায়গার জন্যে আন্দোলনে জড়িয়ে পরে বঙ্গ ভঙ্গ কে স্বীকৃতি দেন। 

যদিও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস বলে চীন যুদ্ধের পরে, ১৯৬৪ সালে প্রথমবার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) ভাগ হয় ও তার থেকে সিপিআই (মার্কসবাদী) বা সিপিআই (এম) বেরিয়ে আসে, ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পরে, ১৯৪৮ সালে প্রথমবার সিপিআই দুই ভাগ হয় ও পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। এই গায়ের জোরে, ধর্মীয় উন্মাদনার ভিত্তিতে দেশ ভাগের বিরোধিতা যেমন কমিউনিস্টরা করেননি, তেমনি জাতি-ভিত্তিতে স্বতন্ত্র দেশ গড়ার দাবিও তাঁরা তোলেননি। 

১৯৪৫-৪৬ সাল ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যে খুবই জরুরী একটি সময় ছিল। এই সময়ে এই উপমহাদেশের মানুষের বিদ্রোহী সত্ত্বা জেগে ওঠে। বোম্বাই শহরের ধর্মঘটে, নৌবিদ্রোহের যোদ্ধাদের সমর্থনে, আজাদ হিন্দ ফৌজের গ্রেফতার হওয়া সৈন্যদের মুক্তির দাবিতে, তেভাগা ও তেলেঙ্গানার লড়াইয়ে তখন দেশ উত্তাল। এই সময়ে যদি পিসি যোশী, যিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক, একবার দেশজোড়া বিদ্রোহের ডাক দিতেন তাহলে ব্রিটিশ শাসন ছুড়ে ফেলতে ঔপনিবেশিক ভারতের বিভিন্ন জনগণের বেশি দেরি হত না। কিন্তু তখন সিপিআই নেতৃত্ব নিশ্চুপ থাকে। আর দেশভাগের নীরব সাক্ষী থাকে। 

অথচ এই পরিস্থিতির পরে, যখন দেশের জনগণ ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছেন ভেবে আনন্দে উত্তাল, তখন ভেঙে যাওয়া সিপিআই নেতৃত্ব স্বাধীনতা কে ঝুটা বলেন ও মানুষ কে বিদ্রোহ করতে ডাক দেন। অবশ্যই সেই অতি-বাম রাজনীতির মাশুল গুনতে হয়েছিল সিপিআই কে নিষিদ্ধ হয়ে। 

বঙ্গ ভঙ্গ – আক্ষেপ ও আশা 

বঙ্গ ভঙ্গের পরে কোনো দিকের বাঙালিই বেশি সুখে থাকেনি। নিজের ভাষার জন্যে বাঙালিকে পূর্ব পাকিস্তানে গুলি খেতে হয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যদিও বাঙালি মুসলিম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, বাঙালি হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েও প্রতিরোধে সামিল না হয়ে ইন্ডিয়ায় পালানো কে শ্রেয় মনে করেন। লক্ষ-লক্ষ প্রাণের বদলে স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বাধীনতার দুধের স্বাদ ঘোলে মিটেছে। 

ভারতের হিন্দিভাষী শাসকেরা শুরুর থেকেই যে ভাবে সংবিধান কে ব্যবহার করে অতি মাত্রায় কেন্দ্রিকতার উপর জোর দিয়েছিলেন তার ফলে রাজ্যগুলির সঙ্ঘ হওয়ার জায়গায় ভারত রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে দিল্লী-কেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেখানে প্রতিনিয়ত অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলোর ক্ষমতা ও আর্থিক স্বতন্ত্রতা কে বিপন্ন হতে হয়েছে। যুক্ত রাজ্যের চিন্তাধারাটাই আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে সকল জাতির স্বাধীন দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশ শুধুই বাংলা সম্প্রসারণবাদ কে ইন্ধন জুগিয়েছে সংখ্যালঘু জনজাতিগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কে বিপন্ন করতে। 

চরম আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বৈরাচার ও ধর্মীয় মৌলবাদের ঘাঁটি হয়েছে বাংলাদেশ। সেখানকার সরকারের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কে খর্ব করেছে ভারতের সম্প্রসারণবাদ। বাংলাদেশের শাসক বর্গ এখন যেমন নয়া দিল্লীর ইশারায় ওঠা বসা করে, তেমনি আর্থিক ভাবে, বিশেষত পোশাকের রপ্তানিমূলক ব্যবসার কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। 

অন্যদিকে যে সব লক্ষ-লক্ষ বাঙালি নমঃশুদ্র বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছিলেন মুক্তি যুদ্ধের আগে ও পরে, তাঁরা আজও ভারতের নাগরিকত্ব না পেয়ে বেআইনী অভিবাসী চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে দিন কাটান। অসমে নিজ দেশে অধিকাংশ বাঙালি উদ্বাস্তু নাগরিকত্ব হারিয়ে ডিটেনশন কেন্দ্রে বন্দী হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন। 

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালির অবস্থাও তথৈবচ। ১৯৪৭ সাল থেকে যে ভাবে ধীরে ধীরে হিন্দি ভাষার সম্প্রসারণ দিল্লীর শাসক শ্রেণী শুরু করেন তার ফলে বর্তমানে হিন্দির প্রভাব ও দৌরাত্ব দুই চরম বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এককালে অসমে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বাঙালিরা বরাক উপত্যকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অনেক তরতাজা প্রাণ। অথচ সেখানেই আজ হিন্দির দাপটের কারণে বাঙালি নিজের ভাষা আর অস্তিত্ব কে ভুলতে বসেছে। ঠিক সে ভাবেই পশ্চিমবঙ্গেও আজ বাংলার উপর হিন্দির আগ্রাসন তীব্র হয়েছে এবং তার সাথে সাথে বাংলাদেশে বেড়েছে আরবী আগ্রাসন ও সালাফীবাদের প্রসার। 

বঙ্গ ভঙ্গ বাঙালির জন্যে এবং সমগ্র বঙ্গের মানুষের জন্যে যে দুর্দশা নিয়ে এসেছিল তা আজও বহাল রয়েছে। বঙ্গ ভঙ্গ কে ঘিরে বাঙালি  হিন্দু ও মুসলিম যে আশা করেছিলেন, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ও যে কষ্ট নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন বা যে জন্যে রক্ত বইয়েছিলেন, ভিটে মাটি খুইয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই সব আশা ও স্বপ্ন আজ কোথাও হারিয়ে গেছে। আর বঙ্গ ভঙ্গ রেখে গেছে বাঙালির কাছে হারিয়ে যেতে থাকা গৌরবের ইতিহাস আর না পূরণ হওয়া অনেক আকঙ্ক্ষা।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla