প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র সরকারের অন্যান্য ভয়াবহ জনবিরোধী আইনের চেয়েও বহুগুণ ভয়াবহ নয়া তিনটি কৃষি আইন––কৃষকদের উৎপাদনের ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার এবং সুবিধা) আইন, ২০২০, ও কৃষকদের (সশক্তকরণ ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও কৃষি পরিষেবা চুক্তি-র আইন, ২০২০, আর অত্যবশকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০। মৃত্যু মিছিল ডেকে আনার আইন এইগুলি। অনেকেই বোধ হয় জানেন না, পর্যাপ্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মজুতদারি ও কালোবাজারি করে ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলার ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের বশংবদ ভারতীয় মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক ফড়েরা। এর পরেও ভারতে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এর পিছনেও ছিল কালোবাজারি আর রাজনৈতিক ফড়েদের কারসাজি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটেনি, দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছে খাদ্য শস্যের কালোবাজারি, মজুতদারি আর মুনাফাবাজি।
মোদীর এই নতুন কৃষি আইনের ফলে চুক্তিচাষের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেটরা বড় বড় কৃষিজোতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের শর্তে উৎপাদন করাবে। মধ্যসত্ত্ব বজায় রেখেই তারা বদলে দেবে দেশের কৃষি উৎপাদনের একটা বড় অংশের অভিমুখ। ভারতে এখনও কৃষি উৎপাদনের প্রধান লক্ষ্য বা অভিমুখ হল ১৪০ কোটি মানুষের খাদ্য যোগানোই। চুক্তিচাষের মাধ্যমে এই লক্ষ্যের অনেকটাই বদলে যাবে, লক্ষ্য হবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বড় বড় শহরের ধনীদের চাহিদা মেটানো আর বৃহৎ শিল্পের কাঁচামাল যোগানের স্বার্থে বাণিজ্যিক ফসলের উৎপাদন।
এর ফলে সাধারণ খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাবে। এর ফলে যোগানের সঙ্কটের সাথেই বাড়বে খাদ্যশস্যের দাম। বিপরীতে সাধারণ মানুষের রোজগার কমে যাচ্ছে। কারণ, সংকটগ্রস্ত বিশ্ব একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি অতিমাত্রায় যান্ত্রিকীকরণ ও উচ্চ প্রযুক্তিকরণের ফলে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। সর্বোচ্চ মুনাফা কামানোর জন্য যে শ্রম লুন্ঠন শুরু হয়েছে তার ফলেও রোজগার কমে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো মুৎসুদ্দি আর বিদেশী বৃহৎ পুঁজির মালিকদের হাতে সঁপে দেওয়া হচ্ছে। ছাঁটাই হচ্ছে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। কৃষিতে কর্পোরেটরা ঢোকার ফলে কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে। ফলে বেকার হবেন ক্ষেত মজুরদের অনেকেই। আবার অবাধ মজুতদারির আইন তৈরি হওয়ার ফলে ফাটকাবাজি বেড়ে যাবে ভয়াবহভাবে। মজুতদারদের এমনিতেই এই আইনে সরকার খাদ্যশস্যের দাম বছরে ৫০% বৃদ্ধির অধিকার দিয়েছে। মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এর মাধ্যমে রেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। ফলে বিঘ্নিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। সুতরাং নেমে আসবে “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর”। কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখবে আগামী “ডিজিটাল” ভারত, যদি না এই আইন বাতিল করতে বাধ্য করা হয় সরকারকে।
এই ভয়াবহ জনবিরোধী আইন কেন তৈরি করল মোদী সরকার? ইতিমধ্যেই জানা গেছে ২০১৯ সালে দিল্লীতে আয়োজিত কৃষি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা। সেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন বিল গেটস। হাজির ছিল মেলিন্ডা অ্যান্ড বিল গেটস ফাউন্ডেশন, মার্কিন ডলারে চলা এফএও, মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা এবং আরো অনেক ব্যক্তি ও সংস্থার প্রতিনিধিরা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) সচিব মোদী-র এই নয়া কৃষি আইনগুলোকে সমর্থন করেছেন। বলা বাহুল্য, এদেশের কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে পেপসিকোলা, কারগিল, মনস্যান্টো, সিনজেন্টা প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আমলে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ম্যাকিনসের সুপারিশের কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়ই। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলেও চুক্তিচাষের ব্যবস্থা হয়েছে। ভারত আগেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) কৃষি কে বন্দক দেওয়ার দাসখত দিয়েছে । যার অর্থ, ভারতের সর্বক্ষত্রে বিদেশী পুঁজির অবাধ প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়ে গেছে। এটা হয়েছিল কংগ্রেস শাসনে। সুতরাং এই কৃষি আইন তৈরির পিছনে কারা আছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, বিদেশী পুঁজির স্বার্থে আইন প্রণয়ন করার অর্থ কী? অর্থ একটাই–– ভারতের রাজনীতি ও প্রশাসনে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির নিয়ন্ত্রণ। তাই নয় কি?
ভারতের অর্থনীতি বিদেশি পুঁজির অবাধ নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াকে প্রবলভাবে সমর্থন করছে এদেশের পুঁজির মালিকরা। এর থেকে ভারতের অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রবল নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ হয় না কি?
এই কৃষি আইন কৃষিতে দাসব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে। ব্যবসায়ী পক্ষ চুক্তিভঙ্গ করলে আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারবেন না কৃষকরা। তাঁরা অভিযোগ জানাতে পারবেন এডিএম বা জেলা কালেক্টরকে। সেখানে সমাধান না হলে বড় জোর কেন্দ্রীয় কৃষি দফতরের সচিবের কাছে যাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থার সমান্তরাল একটা মালিককেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে এই আইন কার্যকরী হলে। এটা সম্পূর্ণরূপে সংবিধান-বিরোধী। আইনসভাই এক্ষেত্রে আইন ও সংবিধান ভাঙছে। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে।
আমলারা বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থায়। দুর্নীতিগ্রস্ত, চরম সুবিধাভোগী, উচ্চাভিলাষী, ধনী আমলারা কাদের স্বার্থে বিচারের রায় দিতে পারেন? নিশ্চয়ই তাঁদের শ্রেণী-চরিত্র অনুযায়ী ব্যবসায়ী কুলের পক্ষেই তাঁরা রায় দেবেন।
সুপ্রিম কোর্ট আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার জন্য চারজনের যে কমিটি খাড়া করেছে (যদিও উক্ত কমিটির একজন ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন), সেই কমিটির মধ্যে জনৈক ‘কৃষকনেতা’ বহু বছর ধরে ভারতের কৃষিতে বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশের পক্ষে ওকালতি করে আসছেন। তিনি একজন জমিদার। তাঁর পূর্ব-পুরুষরাও জমিদার ছিলেন। এর থেকে প্রমাণ হয় না কি ভারতের কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক শক্তির উপর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির নিয়ন্ত্রণ? শুধু তাই নয়। সামন্ত জমিদারদের নিয়ে মোদী-র ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) কৃষক সংগঠন কৃষি আইনের প্রবল সমর্থক। এরাই এই নয়া কৃষি আইন লাগু করার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ।
গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ও ভারতের অর্থনীতি-রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের পর্দা টেনে খুলে নগ্ন করে দিয়েছে চলমান কৃষক আন্দোলন। তাই এই তিনটি আইনকে বাতিল করাতেই হবে আন্দোলনকে আরও দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য করে, না হলে বাঁচার রাস্তা নেই কৃষক-অকৃষক সাধারণ ভারতবাসীর।