আনন্দ যখন হেলমেটের থেকে মাস্ক নামিয়ে হাওয়ার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কে খিস্তি খেউর করছিল তখন একদিকে আমি হতবাক আর অন্য দিকে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। চিন্তার কারণ আমরা যানজটে অবরুদ্ধ জাতীয় সড়ক ৪৪-এ উল্টোদিক দিয়ে সিংহু বর্ডারে যাচ্ছিলাম আর রাস্তার ডানপাশের কানা দিয়ে, পাথরের উপর আর কাদার উপর ভেল্কির মতন মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল আনন্দ। ও একটা অনলাইন ট্যাক্সি এপের হয়ে মোটরসাইকেল ভাড়া খাটায়। একটু পিছলে গেলেই সটান বাইক সহ নীচে পড়তাম দুজনেই।
তবে হতবাক হয়েছিলাম আনন্দ কে মোদী-কে গালাগাল করতে দেখে। কারণ ওর মোটরসাইকেলের হেডলাইটের উপর রাগী মুখের হনুমান এর গ্রাফিক্সের উপর বড় করে লেখা “জ্যায় সিরি রাম” আর ডান হাতের কব্জিতে অনেকগুলো রঙিন সুতা বাঁধা। আমি ভেবেছিলাম এ নির্ঘাত মোদী ভক্ত, “ভিরাট হিন্দু”-দের একজন। তবে ভুল ভাঙলো অর্ধেক পথ গিয়ে।
যানজট থেকে আনন্দ মোদী কে গালাগাল করা শুরু করলেও তাঁকে আমি একটু পরে, আবার রাস্তার সঠিক দিকে বাইক আসার পরে, জিজ্ঞাসা করলাম যে কেন সে ক্ষেপে রয়েছে? ওর কথায় দিল্লীর সীমান্তে অবস্থিত সিংহু বর্ডার হয়ে হরিয়ানা যাওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় নিয়মিত যানজট লেগে রয়েছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের আন্দোলন অবস্থানের ফলে করা ব্যারিকেডের কারণে। এর ফলে ও যেমন ভাড়া পায় না বেশি এই রুটে, তেমনি আন্দোলনকারী কৃষকদের অনেকেরই ঠান্ডায় মৃত্যু সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।
মোদী নাকি “মন কী বাত” বলে প্রবচন দিতে ভালবাসেন, মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখতে না। এমনই অভিযোগ করলেন আনন্দ। আমি যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম আর আমি একজন “জনতার” সাংবাদিক জানার পরে সে অনুরোধ করে এই বক্তব্য গুলো যেন আমি মানুষ কে বলি। আমার গন্তব্য, দিল্লীর সিংহু বর্ডারে কৃষকদের অবস্থান তখনো প্রায় এক কিলোমিটার দূরে।
কথা ছিল দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র টিকরি বর্ডারে গিয়ে কৃষকদের সাথে আর তাঁদের নেতাদের সাথে কথা বলবো, জানার চেষ্টা করবো তাঁদের কী পরিকল্পনা। বিশেষ করে জানার চেষ্টা করবো এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকেরা কী ভাবে দেখছেন আর কী করতে চাইছেন তাঁরা প্রজাতন্ত্র দিবসে। এর আগেও ২৬শে নভেম্বর ২০২০ থেকে দিল্লীর সীমান্তে আন্দোলনকারী কৃষক অবস্থান শুরু হতেই বাহাদুরগড়ের কাছে টিকরি বর্ডার আর উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া গাজীপুর বর্ডারে গিয়ে সচক্ষে দেখেছি অবস্থা।
তবে এইবার টিকরি বর্ডারের পথেই, মেট্রো ট্রেনেই কল আসলো পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠকদের। “শুনুন ভাই, আপনি যদি নেতৃত্বের কথা শুনতে চান আর বেশি কৃষক চান তাহলে সিংহু বর্ডারে আসুন। পরে যাবেন টিকরি।” সটাং ট্রেন চেঞ্জ করে আমি চললাম সিংহু বর্ডারের দিকে। দিল্লীর জাহাঙ্গীরপুরী মেট্রো স্টেশনই সিংহু বর্ডারের সবচেয়ে কাছের মেট্রো স্টেশন। ওখান থেকে বাসে প্রায় এক ঘন্টা আর ট্যাক্সি বা অন্য যানবাহনে প্রায় আধঘন্টায় পৌঁছানো যায় কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু সিংহু বর্ডারে। তো শেষে একটি মোটরসাইকেল ট্যাক্সি জোটানো সম্ভব হয় আর আলাপ হলো আনন্দের সাথে।
মিনিট ২০-২৫ এর পথ প্রায় ৪০ মিনিট লাগলেও আন্দাজ পেলাম কেমন করে হরিয়ানা-লাগোয়া এই অঞ্চলে মানুষের রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসছে। আনন্দ-র পরিবর্তন, তাঁর জোরালো মোদী-বিরোধিতা আর চারিদিকে কৃষকদের সমর্থনের যে জোয়ার দেখা দিচ্ছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল আমি সত্যিই এক “নতুন ভারতবর্ষে” এসেছি। এই “নতুন ভারত”-এ মোদী-র ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি-র) পা ফেলার জায়গা নেই।
প্রায় ৩২টি কৃষক সংগঠনের নেতৃত্বে ২০২০ সালের জুন-জুলাই মাস থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর রাজস্থানে মোদী সরকারের কৃষি সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে “আত্মনির্ভর ভারত” প্রকল্পের অধীনে “২০ লক্ষ কোটি” টাকার তথাকথিত ঐতিহাসিক “উদ্ধার প্যাকেজ” ঘোষণার মঞ্চ থেকে মে ২০২০-তে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীথারামন প্রথম জানান দেন কৃষি সংস্কারের কথা। জানান দেওয়া হয় যে এবার কর্পোরেটদের ব্যাপক ছাড় দেওয়া হবে কৃষিতে। সংবিধানের যৌথ তালিকায় থাকা কৃষিতে রাজ্যের ভূমিকা খর্ব করে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করতে উঠে পড়ে লাগে মোদী সরকার।
যেখান থেকে ইচ্ছে কৃষি পণ্য কিনে যেখানে-সেখানে বিক্রি করার, রপ্তানি করার বা মজুত করার যেমন অধিকার কর্পোরেটদের ফড়েরা পাবে, ঠিক তেমনি তারা দাদন দিয়ে চাষ করাবার সেই পুরানো নীল চাষের ফর্মুলা কে ব্যবহার করে সর্বনাশা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত চুক্তি চাষ ব্যবস্থা চালু করার অধিকারও পাবে। এর ফলে কোটি কোটি কৃষকের জীবনে অন্ধকার নেমে আসার উপক্রম হয়। যে সীমিত কিছু রাজ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (এমএসপি)-তে সরকারি মান্ডিতে ফসল বেচার সুযোগ ছিল, সেগুলো কে ফড়েদের অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দিয়ে খতম করার প্রচেষ্টা চালায় বিজেপি। এমনিতেই কৃষির খরচ উর্দ্ধগামী আর ফসলের দাম পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকেরা কোন ভাবেই তাঁদের ভবিষ্যতের উপর কুড়াল মারতে চাননা। তাই তাঁরা চূড়ান্ত ভাবে এই আইনগুলির বিরোধিতা করা শুরু করেন।
সেই সময়ে, ২০২০ সালের জুন মাসে, তিনটি অর্ডিন্যান্স ব্যবহার করে মোদী সরকার কৃষির উপর কর্পোরেটদের লুঠতরাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। এই অর্ডিন্যান্সগুলোয় কৃষি ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয় দেশী ও বিদেশী পুঁজি কে। কৃষকদের দাদন চাষের ফাঁদে ফেলে তাঁদের জমি কেড়ে নিয়ে তাঁদের সেই জমিতেই বেগার খাটাবার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। সেই একই সময়ে মোদী আর বিজেপি-র ভাঁড়ারে সর্বাধিক চাঁদা দেওয়া মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর মালিক মুকেশ আম্বানির ধন তর তর করে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যখন দেশের মানুষ না খেয়ে মরছেন লকডাউনের ফলে, কর্মহীনতার কারণে, ফসলের দাম না পাওয়ায়, হেঁটে হেঁটে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে নিজেদের গ্রামে ফেরার পথে, ঠিক তখনই আম্বানি বিশ্বের নবম ধনী ব্যক্তির থেকে এক লাফে ষষ্ঠ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। ফিউচার গ্রূপের খুচরো বিপণনের ব্যবসা কিনে ফেলে নিজের রিলায়েন্স জিও ও জিও মার্ট ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশী লগ্নি পান আম্বানি। এর মধ্যে কৃষি অর্ডিন্যান্সগুলো তাঁর আর আদানি গ্রূপের গৌতম আদানি-র জন্যে চরম হিতকর হয়ে ওঠে।
তবে মোদী সরকার আর বিজেপির পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) কিন্তু আন্দাজ করতে পারেনি যে কৃষি সংস্কারের বিরুদ্ধে কী তীব্র আন্দোলন শুরু হতে পারে ভারতবর্ষে। বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, প্রভৃতি দিল্লীর লাগোয়া রাজ্যে। এর ফলে যে কৃষকদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে এসে মোদী সরকার কে আর সমগ্র বিজেপি-আরএসএস এর বাহিনী কে ধাক্কা খেতে হয়। শুরুর থেকেই এই আন্দোলন কে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগকারী “ফড়েদের আন্দোলন” বলে চিহ্নিত করেছিল বিজেপি। এর ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, প্রভৃতি রাজ্যের কৃষকেরা আরও ক্ষেপে যান।
কৃষক আন্দোলনের চাপে পাঞ্জাবের আকালি দল বিজেপির সাথে কয়েক দশক পুরানো সম্পর্ক ত্যাগ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) ত্যাগ করে। এনডিএ ত্যাগ করতে মুখিয়ে আছে হরিয়ানার জেজেপি। আর উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয় সেই জাট সম্প্রদায় যাদের মুজ্জাফরনগর মুসলিম-নিধন যজ্ঞে বিজেপি আর আরএসএস ব্যবহার করেছিল।
এরপরে মোদী সরকার অর্ডিন্যান্সগুলো বাতিল করে সংসদে ধ্বনি ভোটে কৃষকদের উৎপাদনের ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার এবং সুবিধা) আইন, ২০২০, কৃষকদের (সশক্তকরণ ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও কৃষি পরিষেবা চুক্তি-র আইন, ২০২০, আর অত্যবশকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০, পাশ করায় যার মাধ্যমে কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত কৃষি পণ্যের বাজারজাত করা থেকে শুরু করে চুক্তি চাষের ব্যবস্থা কে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হল। এর সাথে কৃষকদের আদালতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে এই আইন সংক্রান্ত অভিযোগ শুধু মাত্র আমলাতন্ত্রের কাছে দায়ের করার অধিকার দিল। এর ফলে সেপ্টেম্বর মাস থেকেই কৃষকদের আন্দোলন তীব্র হয় সেই সমস্ত রাজ্যে যেখানে এমএসপি-তে ফসল বিক্রি করার মতন ব্যবস্থা আছে, যেমন পাঞ্জাব আর হরিয়ানায়। শুধু কৃষকদের বিক্ষোভই চলে না, এর সাথে রিলায়েন্স আর আদানি গ্রূপের সমস্ত পণ্য বয়কট করার ডাকও দেওয়া হয়।
গত ২৬শে নভেম্বরে দেশজোড়া শ্রমিক ধর্মঘটের দিনে পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকেরা শ্রমিকদের প্রতি সংহতি দেখিয়ে দুইটি কৃষি আইন আর অত্যবশকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০, বাতিল, আইন করে এমএসপি-র এর ভিত্তিতেই কৃষি পণ্যের খরিদ করা বাধ্যতামূলক করা ও বিদ্যুৎ বিল, ২০২০, প্রত্যাহার করার দাবি তুলে রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত সংসদ ভবনের বাইরে অবস্থান করতে অভিযান শুরু করেন। সেই যাত্রা পথে হরিয়ানার বিজেপি সরকার হাজারো পুলিশ কর্মী লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, পানির কামান আর নানা ধরণের অত্যাচার নামিয়ে আনলেও কৃষকদের অধিকাংশই সেই সব বাঁধা অতিক্রম করে দিল্লীর সীমান্তে পৌঁছে যান। তাঁরা দিল্লীর দরবারে তাঁদের কথা তুলতে চান। তবে মোদী আর তাঁর সাগরেদরা দেখতে আর দেখাতে চাননা কৃষকদের। তাই কৃষকেরা দিল্লীর কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে অবস্থান শুরু করেন রাজধানীর সাতটি সীমান্তে।
মোদী ভেবেছিলেন যে লম্বা সময় অবধি কৃষকেরা অপেক্ষা করতে করতে সরকারের অনীহা দেখে হয় আপস করবে না হয় হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে যাবেন। একের পর এক মিটিংয়ের নামে, আলোচনার ফাঁদ পেতে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমার কৃষকদের সাথে ছলনা করতে থাকেন। কোন আলোচনাতেই সরকার কৃষি আইনগুলো বাতিল করার মূল দাবি আর আইন করে এমএসপি-র নিশ্চয়তা দেওয়ার দাবি স্বীকার করেনি। বরং সুপ্রিম কোর্ট কে টেনে এনে আইনটা “আইনত” চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে মোদী সরকার আর অন্যদিকে বিজেপি ও আরএসএস-র প্রচার যন্ত্র এই আন্দোলন কে খালিস্তানি, পাকিস্তানের মদদপুষ্ট, মাওবাদী, প্রভৃতি তকমা মেরে দমন পীড়নের স্বার্থে জনমত তৈরী করা শুরু করে। কিন্তু এই খেলায় কৃষকদের অসীম ধৈর্য, যে ধৈর্য ধরে তাঁরা ফসল উৎপাদন করেন মাসের পর মাস পরিশ্রম করে, কৃষকদের চরম কষ্ট ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করে লেগে-পড়ে থাকার ক্ষমতা কে অগ্রাহ্য করেছিল বিজেপি। আর তাতেই সংকট ঘনিয়ে এসেছে শাসকশ্রেণীর শিবিরে। শাসকশ্রেণীর সংকটই দেখা গেল সিংহু বর্ডারে।
সিংহু বর্ডারে ঢোকার মুখেই মঞ্চ বেঁধে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করছেন পাঞ্জাবের কৃষকেরা। কৃষক-শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি পাঞ্জাব এর ব্যানারে মঞ্চ বেঁধে কর্মসূচী চলছে যাতে নানা সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসে বক্তব্য রাখছেন, কবিরা সংগ্রামের কবিতা শোনাচ্ছেন আর গায়কেরা গান গাইছেন। সবটাই মোটামুটি পাঞ্জাবি ভাষায়। এমন কী তামিল নাড়ুর থেকে সংহতি জানাতে আসা প্রতিনিধিরা সেখানে তামিলে বক্তব্য রাখেন এবং সাথে সাথে পাঞ্জাবিতে একজন দোভাষী সে বক্তব্যের অনুবাদ মানুষ কে জানাতে থাকেন।
সেই মঞ্চের থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে জাতীয় সড়কের দুই ধারে কয়েক হাজার ট্র্যাক্টর দাঁড়িয়ে। তাঁদের পিছনে জোড়া লম্বা লম্বা ট্রলি, যার ভিতর বিছানা পাতা, বসে আছেন কৃষকেরা, হাতে তাঁদের বিভিন্ন সংগঠনের পতাকা। প্রতিটি ট্র্যাক্টরের উপরে উড়ছে এক একটি সংগঠনের পতাকা বা খালসা পন্থার গেরুয়া পতাকা। এই ট্র্যাক্টরের ভিড়ের মধ্যেই আছেন মানুষ, আর আছে লঙ্গর। অর্থাৎ যেখানে সারাদিন রান্না হচ্ছে আর প্রত্যেক কে, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-শ্রেণী নির্বিশেষে, পাত পেড়ে খাওয়ানো হচ্ছে সারা দিন। আপনার সকালের চা থেকে রাতের এক গ্লাস দুধের যোগানও এই লঙ্গরে আপনি পাবেন।
চরম পরিশ্রমী পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকেরা গোটা সিংহু আর টিকরি বর্ডার অঞ্চলগুলিতে গড়ে তুলেছেন নিজেদের ঘাঁটি এলাকা। বড় একটি শপিং কমপ্লেক্স, যা মার্কিন বহুজাতিক রেস্তোরাঁ কেএফসি’র আউটলেট থাকায় সেই নামে পরিচিত, আজ কৃষকদের দখলে। সেখানে কৃষকেরা থাকছেন, রান্না করছেন, সবজি, আনাজ, প্রভৃতি মজুত করছেন। আর মিটিং করছেন নানা ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পগুলো কৃষকদের সাথে খালসা এইড এর মতন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। টিকরি বর্ডারে এর আগে যখন আমি গেছিলাম, দেখেছিলাম খোলা আকাশের নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে কৃষকদের অধিকাংশ কে, যাঁদের জায়গা ট্র্যাক্টরগুলোয় হয়নি স্থানের অভাবে, বসে থাকতে। বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায়, কৃষকদের অবস্থানের এক মাস পরে, জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে হেমকুন্ত ফাউন্ডেশন নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অনেক ছোট তাঁবু বিলি করে গেছে টিকরি আর সিংহু বর্ডারে। এর ফলে কৃষকদের একটা সুরাহা তো হয়েছেই।
টিকরির মতনই, তবে অনেক ব্যাপারে তার চেয়েও বেশি, দেখলাম সিংহু বর্ডার জুড়ে তৈরী হয়েছে হাসপাতাল, মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার, শিখ জাঠেদারদের জন্যে ঘোড়শাল, লাইব্রেরি, বাচ্চাদের জন্যে ইস্কুল––যার ছবি তোলার শর্ত হলো বাচ্চাদের আধঘন্টা পড়িয়ে সেবা দেওয়া––আর এমনকি জুতো সেলাই, কাপড় সেলাই, প্রভৃতির তাঁবু। আর এই সবের জন্যে আপনার থেকে কেউই এক কানাকড়িও নেবে না। সব কিছুই চলছে সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলোর, কৃষকদের নিজস্ব উদ্যোগে ও শিখ সম্প্রদায়ের সহায়তায়। হরিয়ানার জাঠ আর হিন্দু কৃষকেরাও এই কাজে জড়িত সাংগঠনিক ভাবে এবং পাঞ্জাবের কৃষকদের তাঁরা সব ভাবে সহায়তা করছেন।
শিখ আর অন্য পাঞ্জাবি কৃষকদের সংহতিতে সিংহু আর টিকরি দুই সীমান্তেই এসেছেন পাঞ্জাবের মালেরকোটলা শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মালেরকোটলা পাঞ্জাবের ফরিদকোট জেলায় অবস্থিত, রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-সংখ্যাগুরু শহর। সিংহু বর্ডারে মালেরকোটলার থেকে আসা মুসলিম ব্রাদারহুডের লঙ্গর থেকে দেওয়া হচ্ছে ওষুধ আর সাথে সাথে মিষ্টি ভাত আর নোনতা ভাত। এই দুটি খুব তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন পাঞ্জাবের শিখ কৃষকেরা, যাঁদের আর মুসলিমদের মধ্যে মোদী আর বিজেপি ভাগ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে মোদীও আছেন সিংহু বর্ডার জুড়ে। অধিকাংশ ট্র্যাক্টরের গায়ে তাঁর পোস্টার। কোন পোস্টারে তাঁর গলায় হয় জুতোর মালা, না হয় তাঁকে গৌতম আদানি আর মুকেশ আম্বানির ভৃত্য আর পোষ্য হিসাবেও দেখানো হয়েছে পোস্টারগুলোয়। এর সাথে সাথে খিল্লি উড়ছে মোদী সরকারের পদলেহী মূলধারার মিডিয়াগুলোর ও হিন্দি সিনেমার চটকদার অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতের। কৃষকদের সামনে কেউই সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। তাই শুধু মোদী বা বিজেপি না, শুধু কঙ্গনা বা মোদী-র “গোদী” মিডিয়া বা কোলে বসা সংবাদমাধ্যম নয়, সমালোচিত হতে হচ্ছে পাঞ্জাবের সেই সমস্ত নেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রভৃতিদের, যাঁরা এক কালে পাঞ্জাবের মানুষের প্রিয় ছিলেন কিন্তু কৃষকদের আন্দোলনের সাথে বেইমানি করে যারা খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
পাঞ্জাবের ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন (ক্রান্তিকারী) বা বিকেইউ (ক্রান্তিকারী) সংগঠনের কর্মী ও সমর্থকদের সাথে আর কীর্তি-কিষান ইউনিয়নের কর্মী সমর্থকদের সাথে আলোচনা করে যা বুঝলাম তা হলো টিকরি বর্ডারে প্রায় চার থেকে পাঁচ লক্ষ কৃষক আছেন আর সিংহুতে আছেন আরও তিন লক্ষ কৃষক। সিংহু বর্ডারে ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ ট্র্যাক্টর আছে আর টিকরি বর্ডারেও সমপরিমানে ট্র্যাক্টর রয়েছে। ২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে একটি ট্র্যাক্টর প্যারেডের ডাক দেওয়া হয়েছে। কৃষকেরা বলেছেন তাঁরা প্রজাতন্ত্রের উপর তাঁদের অধিকার ফলাবেন ট্র্যাক্টর নিয়ে প্যারেড করে ঠিক সেই সময়ে যখন প্রায় ৩০-৪০ কিঃমিঃ দূরে মোদী ভারতের সেনাবাহিনীর সেলামি নেবেন।
এই ট্র্যাক্টর প্যারেডে কতজন যোগ দেবেন জিজ্ঞাসা করায় বিকেইউ (ক্রান্তিকারী) এর লোকেরা আর স্টুডেন্টস ফর সোসাইটির কর্মীরা বললেন যে তাঁরা আশা করছেন সিংহু বর্ডারে আরো ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ ট্র্যাক্টর আসবে আর ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ ট্র্যাক্টর আসবে টিকরি বর্ডারে। আমার থাকাকালীন দীর্ঘ বৈঠক চলছিল বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের ট্র্যাক্টর প্যারেডের রুট নিয়ে। যদিও এই ব্যাপারে সবাই একমত যে দিল্লীর “বাহারী মুদ্রিকা” বা আউটার রিং রোড ধরে এই প্যারেড হবে, তবে প্যারেডের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত কৃষকদের সংগঠনগুলি।
মূলতঃ সংসদীয় বামদল-গুলোর প্রভাবাধীন সংগঠনগুলো এবং অন্যান্য মূলধারার রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন সংগঠনগুলো চায় যে এই ট্র্যাক্টর প্যারেড সরকার কে অনুরোধ করে অনুষ্ঠিত করে আবার সিংহু বর্ডারে বা টিকরি বর্ডারে ফিরে আসতে। তবে অন্য কৃষক সংগঠনগুলো, বিশেষ করে যেগুলো কোন ভাবেই সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাবে নেই, চায় দিল্লীর ভিতরে গিয়ে অবস্থান করতে। এদের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সিংহু বর্ডারে।
কৃষক সংগঠনগুলোর অধিকাংশের দাবি যে কৃষকেরা দুই মাস ধরে টিকরি আর সিংহু বর্ডারে অবস্থান করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এর ফলে তাঁরা চান যে প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্র্যাক্টর প্যারেড করে যত ভিতরে ঢোকা যায়, যত ভিতরে ঘাঁটি গাড়া যায়। এর ফলে কৃষকদের সাথে যে রাষ্ট্রের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে সেই কথা কিন্তু খুবই স্পষ্ট। আর কৃষকদের সেই নিয়ে ভয় নেই। তাঁরা চান একটা হেস্তনেস্ত করে মোদী সরকার আর কর্পোরেটদের হারাতে। তাঁরা চান যে তাঁদের দাবি যেন পূরণ করা হয় এবং এ ছাড়া কোন আশ্বাসনে তাঁরা পিছু হটবেন না।
জানতে উদগ্রীব হলাম কৃষকদের এই অনড় মনোভাবের পিছনে কী অনুপ্রেরণা আছে? কেন কৃষকেরা তাঁদের চাষের কথা ভাবছেন না, গ্রামের পরিবারের কথা ভাবছেন না, ক্ষেতের ফসলের কথা ভাবছেন না? জিজ্ঞাসা করলাম বিকেইউ (ক্রান্তিকারী) পাঞ্জাব রাজ্য সভাপতি সুরজিৎ সিং ফুল কে। তাঁর কাছ থেকে চোস্ত পাঞ্জাবিতে যা শুনলাম তার মর্মার্থ হল গ্রাম থেকে প্রত্যেকে আসেননি। এই লড়াইটা পাঞ্জাবে শুরু হয়েছে আর ওখানে সংগ্রামের প্রাথমিক ইউনিট হল গ্রাম। প্রতিটি গ্রামে নিয়ম করা হয়েছে যে কিছু মানুষ সেখান থেকে আন্দোলনে সামিল হতে যাবেন আর সেই সময়ে বাকিরা তাঁদের ক্ষেতের, তাঁদের ফসলের দেখাশুনো করবেন, তাঁদের বাড়িতে কারুর চিকিৎসা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় কোন কিছুর দরকার পড়লে তার ব্যবস্থা করবেন। এর পরে সেই দলটি ফিরে গেলে নতুন দল আসবে সেই গ্রাম থেকে আর যাঁরা ফিরবেন তাঁরা এর পরে যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিতে আসবেন, তাঁদের ক্ষেত থেকে পরিবারের দেখাশুনা করবেন।
জিজ্ঞাসা করলাম যে তাহলে ক্ষেত মজুরদের কী হবে? তাঁদের যাদের অন্যের জমিতে খেটে পেট চলে তাঁদের। ফুল জানালেন যে ক্ষেত মজুরদের ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে তাঁদের অনুপস্থিতিতেও তাঁদের বাড়ির উনুন জ্বলে ও যেকোন ধরণের স্বাস্থ্য বা অন্য জরুরী পরিস্থিতিতে গ্রাম তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। যাদের ট্র্যাক্টর আছে, যাদের সামর্থ্য আছে, যাঁদের বাড়িতে জোয়ান ছেলে-মেয়ে আছে, কিন্তু তবুও যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন না বা সহযোগিতা করছেন না, তাঁদের গ্রামে গ্রামে চিহ্নিত করে একঘরে করার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে মোদী-র দালাল, আম্বানি আর আদানি-র দালাল বলে। এর ফলে অনেক বিজেপি কর্মী পাঞ্জাবের গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছেন পরিবার সমেত।
কৃষক নেতার মতে বেশির ভাগ প্রৌঢ় কৃষক এই আন্দোলনে এই জন্যে যোগ দিতে এসেছেন যে তাঁরা জানেন যে তাঁরা তাঁদের জীবন কাটিয়ে ফেলেছেন আর এবার সম্মানের সাথে, মানুষের স্বার্থে লড়াই করে মৃত্যু বরণ করতে চান। তাঁরা ফেরার কথা ভেবে আন্দোলনে আসেননি বরং জেতার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে এসেছেন। মহিলারা বেশি করে এসেছেন সুপ্রিম কোর্ট কে জানান দিতে যে নিজেদের ভাল মন্দ তাঁরা বোঝেন। আর লক্ষ লক্ষ শিখ এসেছেন নির্দ্বিধায় নিজ ধর্মীয় পরিচয় কে সামনে রেখে কারণ সর্দার হওয়া মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামনের সারির থেকে, সবার আগের থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।
ইচ্ছা হল মোদী কে জিজ্ঞাসা করি, কী ভাবছেন? জিতবেন এই লড়াই? আপনার কাপুরুষতা কি কৃষকদের হিম্মত কে হারাতে পারবে? ততক্ষণে জোরে জোরে স্লোগান তুলে একদল নারী আর শিশুরা এগিয়ে এলেন, মোদী-র পতন দাবি করে, আম্বানি আর আদানির উচ্ছেদ দাবি করে, দেখে মনে হল এই মিছিলটি এগিয়ে নিয়ে যাবে গোটা সমাজ কে একটি নতুন পর্যায়ে। সেই আশায় নতুন ভোরের আলোয় দেখলাম সিংহু বর্ডারে এক “নতুন ভারত” কে জেগে উঠতে। মোদী, আম্বানি-আদানি বা আরএসএস এর “নতুন ভারত” না, বরং গুরনাম সিংহ, হরপ্রীত কৌরদের ভারতবর্ষ।