বাংলার পয়লা বৈশাখ ইংরাজী ও হিন্দির আগ্রাসনের কারণে অনেক আগেই “Pohela Boishakh” হয়ে গেছে। এর সাথেই বাংলার দুই প্রান্তেই এই নতুন বছর (Bengali New Year) কে, বঙ্গবাসীর বছর কে একটা হিন্দু আইডেন্টিটি দেওয়া হয়েছে। যে বাঙালি জাতীয় পরিচয় চিরকাল বাংলা নববর্ষ পালনের সাথে বা বাংলা তারিখের সাথে যুক্ত ছিল, তাকে যেমন বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গীরা বলে “মালাউনের উৎসব” তেমনি আবার ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণী এই বাংলা নববর্ষের সাথে ইসলামের পুরানো সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে, এই দিনপঞ্জিকার বাঙালি ঐতিহ্য কে বাদ দিয়ে, বাংলার কৃষকের সাথে এর সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে শুধুই পয়লা বৈশাখ কে “হিন্দু নববর্ষ” আর বাংলা ক্যালেন্ডার কে হিন্দু ক্যালেন্ডারে পরিণত করতে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বাঙালিরই জানা নেই যে বাংলা নববর্ষ ও বাংলা দিনপঞ্জিকা মুঘল সম্রাট আকবর এর আমলে তৈরি হয় খাজনা আদায় প্রক্রিয়া কে মসৃন করার জন্যে। আগে যদিও ইসলামী দিনপঞ্জিকা অনুসারে কৃষকের কাছ থেকে মুঘল সাম্রাজ্য কর নিত, কিন্তু তাতে প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি হত কারণ ইসলামী মাসের কোন ঋতুর সাথে সম্পর্ক থাকে না। এর কারণ এটি চন্দ্র নির্ভর একটি ব্যবস্থা। তাই কোন বছর যদি রাজব মাস বসন্তকালে আসে তাহলে কোন বছর তা আবার বর্ষাকালেও আসতে পারে। কোন বছর শাওয়াল মাস যদি প্রখর গ্রীষ্মে আসে তাহলে কোন বছর তা আবার প্রচন্ড শীতেও আসতে পারে। যেহেতু মরুভূমিতে ভরা আরব দেশে চাষবাসের বেশি বালাই কোন কালে ছিল না, তাই সেখানে চান্দ্রেয় বছরের ফলে কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে বাংলায়, যেখানে কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতি সর্বদাই বৃষ্টি নির্ভর আর তাই কোন স্থায়ী হিসাব ছাড়া সেখান থেকে কর আদায় করা সেই সময়ে একটি সাম্রাজ্যের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এর ফলেই আকবর কে চালু করতে হয় বাংলার জন্যে আলাদা দিনপঞ্জিকা।
এই দিনপঞ্জিকার সাথে, পয়লা বৈশাখের (Pohela Boishakh) এর সাথে কিন্তু আকবরের আরও একটি সম্পর্ক আছে। শোয়েব দানিয়াল তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন যে আকবর যে শুধুই হিন্দু ও ইসলামী তারিখের সংযোজন করে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরি করেছেন তা নয়, তার সাথে তাঁর ক্ষমতায় আসার তারিখের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। যদি জানতে চান বর্তমান বাংলা বছর কত, তাহলে তার হিসাব করা সম্ভব একমাত্র আকবর কে ব্যবহার করে। আকবরের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ইসলামী বছর (হিজরী) হল ৯৬৩, যা গ্রেগোরিয়ান বা সৌর দিনপঞ্জিকা (খ্রিস্টাব্দ) হিসাবে ১৫৫৬ সাল। তাই যদি বর্তমান বঙ্গাব্দ কে বার করতে হয় খ্রিস্টাব্দ আর হিজরী দিয়ে তাহলে আকবরের সিংহাসনে বসার ইসলামী বছর ৯৬৩ এর সাথে যোগ করতে হবে বর্তমান খ্রিস্টাব্দ কে (২০২১) আর তার থেকে বিয়োগ করতে হবে আকবরের সিংহাসনে বসার খ্রিস্টাব্দ কে (১৫৫৬). তাহলে ৯৬৩ + ২০২১ = ২৯৮৪, আর ২৯৮৪-১৫৫৬= ১৪২৮, যা বর্তমান বঙ্গাব্দ।
যদিও আকবরের এই তারিখ-এ-ইলাহী তাঁর বানানো ধর্ম দ্বীন-এ-ইলাহী-র মতনই তাঁর সাথেই বিলীন হয়ে যায়, তা কিন্তু চিরকাল বেঁচে থাকে বাংলার মানুষের মধ্যে, তাঁদের বঙ্গাব্দের মধ্যে। আজ যাঁরা এই নববর্ষ (Bengali New Year) বা পয়লা বৈশাখ (Pohela Boishakh) পালন করা কে ইসলাম-বিরোধী মনে করেন, তাঁদের জানানো উচিত যে এই পয়লা বৈশাখের সাথে কিন্তু নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে ইসলামের নবী মোহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনা। যাঁরা আবার এই দিনটি কে বাঙালি হিন্দুদের নিজস্ব উৎসব হিসাবে দেখিয়ে থাকেন আর বাঙালি মুসলিম কে এর থেকে আলাদা করেন, তাঁদেরও জানা উচিত যে ইসলামী হিজরী বছর ছাড়া বাংলার দিনপঞ্জিকার হিসাব করা যায় না।
বর্তমানে যখন পশ্চিমবঙ্গের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট বাহিনী, যাঁরা বঙ্গবাসীর ভাষাগুলোকে, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কে ধ্বংস করে তাঁদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় হিন্দি ভাষা, হিন্দি সংস্কৃতি ও উত্তর ভারতীয় রীতি রেওয়াজ, যখন বঙ্গ ভূমি কে তার কৃষক, আদিবাসী, মুসলিম ও দলিত মানুষের থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে বানাতে চায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রকল্পের একটি গবেষণা কেন্দ্র, তখন নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে বঙ্গবাসী কে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করতে হবে যে এই মাটি, জল, জঙ্গল ও সম্পদ এখানকার মানুষের আর দিল্লী কে তাঁরা শোষণের রোলার চালাতে দেবেন না। পয়লা বৈশাখ (Pohela Boishakh), বাংলার নববর্ষ (Bengali New Year) পালনের মাধ্যমেই যেন গড়ে ওঠে আপামর বঙ্গবাসীর ঐক্য, কাঁটাতার ভেদ করে, বিভেদকামী শত্রুর বিরুদ্ধে, মানুষের স্বার্থের পক্ষে।