সম্প্রতি পয়লা বৈশাখে এবিপি আনন্দ-র “ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন” অনুষ্ঠানে সুমন দে কে সাক্ষাৎকার দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আর এই সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে আসে কী ভাবে বঙ্গের মূলধারার সংবাদ মাধ্যম ধূর্ততার সাথে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বের ধ্বজ্জা বহন করে চলেছে। কী ভাবে সুমনের মতন লোকেরা চতুরতার সাথে যে শুধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) সেবা করছে তাই নয়, তাঁদের এজেন্ডা কে বঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে নিরন্তর “নিরপেক্ষতার” মুখোশ লাগিয়ে, তা বোঝা গেল এই সাক্ষাৎকার দেখে। বন্দোপাধ্যায় এই সাক্ষাৎকারে বারবার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের স্বার্থে চালানো মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের “ব্যালেন্সিং” এর খেলার বিরোধিতা করেন। ও সুস্পষ্ট ভাবেই সুমনের চ্যানেল কে বিজেপির দালাল হিসাবে চিহ্নিত করেন। তবুও সুমন কিন্তু তাঁর কারসাজি ভোলেননি।
যদিও কোনদিন তামিলনাড়ু বা কেরলের মুখ্যমন্ত্রী কে কোন টেলিভিশন চ্যানেল হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দিতে বাধ্য করতে পারে না আর সেই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরাও সেই দাবি মানবেন না, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কে দিয়ে কিন্তু খুব সহজেই “জাতীয় সম্প্রচার বলে” সুমন বাংলা ছেড়ে হিন্দিতে কথা বলালেন আর মুখ্যমন্ত্রীও সেই ভাষায় তাঁর সাথে কথা বললেন। আর হিন্দি ও বাংলা দুটো ভাষাতেই কিন্তু সুমন “অন এয়ার” একটা মিথ্যা কথা বলে গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর তোলা একটা ন্যায্য প্রশ্নের জবাবে।
বন্দোপাধ্যায় প্রশ্ন তুললেন কেন বিজেপি-র চাপে মোদী সরকারের মিথ্যা ফাঁস করে দেওয়ায় এবিপি একজন সাংবাদিক কে চাকরি থেকে তাড়িয়েছিল? সুমন সটান মানা করে দিলেন যে এমন কোন ঘটনা তিনি জানেন না। বন্দোপাধ্যায় অনেকবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সুমন অস্বীকার করতে থাকেন। সুমন মুখ্যমন্ত্রীকে নাম জিজ্ঞাসা করেন সেই সাংবাদিকের, কিন্তু বন্দোপাধ্যায় তা মনে করতে না পারায়, সেই কথা কে কেটে দিলেন অন্য আলোচনা তুলে। অনেকের মনে হবে যে হয়তো বন্দোপাধ্যায় খামোকা বিজেপি-র বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্যেই শুধু শুধু আক্রমণ করছেন এবিপি কে এবং সুমন নিজের সংস্থা কে বাঁচাতে সঠিক কথাই বলছেন। এই জন্যেই হয়তো খুবই চতুরতার সাথে সুমন চট করে হিন্দি সাক্ষাৎকার শুরু করে দিলেন।
কিন্তু বন্দোপাধ্যায় ভুল বলেননি। তিনি হয়তো নামটা মনে করতে পারেননি তবে এবিপি কে তিনি ঠিক ভাবেই ধরেছেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই মোদী সমস্ত মূলধারার সংবাদ মাধ্যম কে নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। কোন ধরণের সমালোচনামূলক সংবাদ আর পরিবেশিত করতে দেয় না বিজেপি সরকার। এর ফলে বিজেপির কাছে মিডিয়া ফাঁকা মাঠ হয়ে রয়েছে সাত বছর ধরে। এরই মধ্যে কিন্তু অনেক সাংবাদিক সাহসিকতা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন এবং চাকরির তোয়াক্কা না করেই তাঁরা সেই কাজ করেছেন। তাঁদেরই একজন পুণ্য প্রসূন বাজপেয়ী।
এবিপি নিউজে বাজপেয়ী “মাস্টারস্ট্রোক” বলে একটি অনুষ্ঠান পরিবেশন করতেন। সেই অনুষ্ঠানেই ২০১৮ সালের ২০শে জুন বাজপেয়ী দেখান যে কী ভাবে মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা, যাঁদের সাথে মোদী তাঁর কথোপকথন প্রচার করেন ঢাকঢোল পিটিয়ে, আসলে কোন সুবিধাই পাননি। তিনি নিয়ে আসেন টিভি পর্দায় ছত্তিশগড়ের চন্দ্রমনি কৌশিক কে, যাঁর সাথে মোদী কথা বলেছিলেন। বাজপেয়ী কে কৌশিক জানান যে তিনি মোদীর সভায় যা বলেছিলেন তা তাঁকে বিজেপি নেতারা শিখিয়ে দিয়েছিল এবং তিনি কোনদিনই ধান চাষ ছেড়ে কাস্টার্ড এর আপেল চাষ করেননি। এই টিভি শো-র ফলে ভীষণ ধাক্কা খায় মোদী সরকার ও জুলাই মাস থেকে এবিপির উপর চাপ আসা শুরু হয়, সিগন্যালিং এ গন্ডগোল হয় ও ভন্ড সাধু সাজা বৃহৎ পুঁজির মালিক রামদেব তাঁর সংস্থার সমস্ত বিজ্ঞাপন সরিয়ে নেন এই চ্যানেল থেকে।
তারপরে, বাজপেয়ীর বক্তব্য অনুসারে তাঁকে মিটিং এ ডাকেন এবিপি নিউজের মালিক ও প্রধান সম্পাদক। বাজপেয়ী জানান তাঁকে প্রধান সম্পাদক বলেন যে তিনি যেন নিশ্চিন্তে বিজেপির যে কোন নেতা বা মন্ত্রীর বা মন্ত্রকের তথ্যভিত্তিক সমালোচনা তাঁর অনুষ্ঠানে চালিয়ে যান। শুধু যেন নরেন্দ্র মোদী নামটা তিনি না নেন। তিনি যেন মোদী-র কোন সমালোচনা না করেন। যা শুনে বাজপেয়ী বলেন যে সে কাজ করা অসম্ভব কারণ দেশের সব কেন্দ্রীয় মন্ত্রকই মোদী-র ইশারায় চলে, সব মন্ত্রীরা মোদী-র গুণগান গাইতে গাইতে কাজ করেন আর সব প্রকল্পেই মোদী-র ছাপ থাকে। তাই মোদী-র সরকারের নামই যখন “মোদী সরকার” তখন মোদী কে বাদ দিয়ে বাকি মন্ত্রীদের বা বিজেপি কে সমালোচনা করে কী লাভ? এর কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ছাড়তে হয় বাজপেয়ী কে।
ঠিক একই রকম ভাবে দীর্ঘদিন ধরে মোদী সরকারের মিথ্যা ফাঁস করছিলেন এবিপি-র আর এক সাংবাদিক অভিসার শর্মা। তাঁকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয় এবিপি। এর কারণ ছিল তিনি এপ্রিল ২০২০ তে মোদী সরকারের লকডাউন সংক্রান্ত কড়াকড়ির সমালোচনা করেন টিভিতে যা বিজেপির ভক্তদের ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে চাকরি যায় শর্মার। অথচ পরবর্তী কালে প্রমাণ হয় যে শর্মার সমালোচনাই সঠিক ছিল। কিন্তু কলকাতার ইংরাজী সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ বা বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকা যতই মোদী বিরোধিতা করুক না কেন, হিন্দি বলয়ে এবিপি কে বিজেপির থুতু চেটেই জীবনযাপন করতে হয় সে কথা এই দুই সাংবাদিকের চাকরি চলে যাওয়াই প্রমাণ করে।
নিজের সমালোচনা বরদাস্ত না করতে পারা মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের অন্যতম ও তা খুব সঠিক ভাবেই ধরিয়ে দিয়েছেন বন্দোপাধ্যায় সুমনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারে। এই কথা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গে সমালোচনা বা বিরুদ্ধ মতামত শোনা নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর রেকর্ড খুব মধুর নয়। বারবার তার প্রমাণ বঙ্গীয় রাজনীতিতে তাঁর কট্টর বিরোধীরা (বিজেপি আর বিলীন হওয়া বাম-কংগ্রেস বাদে) পেয়েছেন। কিন্তু বন্দোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় মদদে গণহত্যা চালাননি। একটি বিশেষ সম্প্রদায় কে ক্ষমতাহীন করে তাঁকে বিলীন করতে আক্রমণ নামাননি। ফলে তাঁকে আর বিজেপি কে এক করে না দেখাই রাজনৈতিক ভাবে সমীচীন কাজ হবে। যদিও এই কথা ভোলা উচিত না যে রাজ্যে বিজেপি কে প্রথম গ্রহণযোগ্য তিনিই করেছিলেন ১৯৯৮ সালে ওই দলের সাথে জোট করে ও মোদী-র নেতৃত্বে যখন গুজরাট সরকার ২০০২ সালে মুসলিম গণহত্যায় মদদ দিচ্ছে তখনও বন্দোপাধ্যায় বিজেপির সাথীই ছিলেন।
সেই বন্দোপাধ্যায়ের সূত্র ধরেই আজ জোর গলায় বারবার মোদী সরকারের দ্বারা সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা, সংবাদ মাধ্যম কে দালালি করার মাধ্যমে পরিণত করা ও সরকারের সমালোচনা কে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া কে মানুষের সামনে উন্মোচিত করতে হবে ও তাঁদের দেখাতে হবে কেন বিজেপি-র শাসনে তাঁদের ভাল তো কিছু হবেই না বরং দিন দিন আরও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। জনগণের সংগ্রাম তৃণমূল কংগ্রেস কে বা বন্দোপাধ্যায় কে জেতানোর সংগ্রাম না, তাঁদের সংগ্রাম যেনতেন প্রকারে ফ্যাসিবাদ কে প্রতিরোধ করা আর তাকে পরাজিত করা। সেই লড়াইয়ের জন্যে কোন সুমন বা অন্য মূলধারার সংবাদ মাধ্যম জনতার পাশে দাঁড়াবে না, বরং জনতা কেই সংগ্রামের ময়দানেই নিজের পাল্টা, বিকল্প সংবাদমাধ্যম গড়ে তুলতে হবে।