২০২০ সালে লকডাউনে জনজীবন বিপন্ন হওয়ার ছবি আমরা সবাই দেখেছি, সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টায় মৃত্যুর স্মৃতি এখনো তাজা।
দেখা যাক, রাজনীতি কীভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তার নমুনা। কীভাবে সংক্রামক রোগটিকে (যার মৃত্যুহার ভারতে ১.১৮%, পশ্চিমবঙ্গে ১.৫৯%, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা শ্রেয়) নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে ও হচ্ছে।
হঠাৎ কেন করা হলো লকডাউন? ২০১৯ সালের শেষের দিকে নাগরিকত্ব হননকারী জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি)- বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছিল। বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলি দিন রাত এক করে মিছিল, সমাবেশ করে জনমত সংগ্রহ করছিল, সরকার চাপে ছিল। এই সময়ে সরকারের দরকার ছিল সব কিছু থামিয়ে দেওয়ার মতন ো একটি ব্রহ্মাস্ত্র, এই ধারাবাহিক আন্দোলনের শৃঙ্খলটাকে ভেঙে দেওয়ার।
ডিসেম্বর ২০২০-র মাঝামাঝি থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে চীন থেকে। ২৭শে জানুয়ারি ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা জানাজানি হয় (কেরলের ২০ বছর বয়সী একজন মহিলা)। তার আগে থেকেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, বা বলা যায় ছড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রোগ কিছুটা ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করা হয়েছে। তারপর হঠাৎ কোনো রকম পূর্ব অবগতি ছাড়াই ২৫ শে মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
এর ফলে বাইরে বেরোনো সমস্যার হয়ে গেলো। যে মানুষটার ‘দিন আনা দিন খাওয়া’, যে মানুষটা দৈনিক মজুরী-ভিত্তিক কাজ করে, তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারখানাগুলোয় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে। দেশের নানা প্রান্তের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। হাজারো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে তাঁদের মৃত্যু হল––অনাহারে মৃত্যু হল আর হল গাড়ি চাপা পড়ে বা ট্রেনে কাটা পড়ে। যাঁরা বেঁচে গেলেন তাঁদের জুটলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শান্তিপ্রিয় পুলিশের লাঠি। অনেক মানুষ কে আবার রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বিষাক্ত রাসনায়িক দিয়ে স্নানও করানো হল।
আর এই সবের মূল লক্ষ্য, পরোক্ষভাবে এনআরসি বিরোধীতামূলক আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে দমন করা। আর তা করা হয়েছে। এই আন্দোলনহীন সময়ে——আন্দোলন হলেও লকডাউনের জন্য যা ডিজিটাল ভাবে হয়েছে, ব্যাপ্তি পায়নি বা আটকে দেওয়া হয়েছে—— অনেকগুলো জনস্বার্থ বিরোধী বিল পাশ করা হয় সংসদে।
এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ (NEP) ২৯শে জুলাই ২০২০ তে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদে পাশ হয়। এই আইন চালু হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের পথে এগোবে। এরপর, আনলক পর্যায়ে পুনরায় নিয়মমাফিক জীবনে অভ্যস্ত হতে মানুষের সময় লেগেছে। আর সেই সময়েই ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ লোকসভা ও তার পরের দিন রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায় The Industrial Relations Code, 2020. যার ফলে মালিক পক্ষের হাতে সরকার তুলে দেয় ইচ্ছামত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অধিকার। এই সময় তিনটি কৃষি বিল উপস্থাপনা করা হয়, কর্পোরেট দালালদের সুবিধার্থে, কৃষকদের সাথে আলোচনা না করেই। যাদের গালভরা নাম —
১) অত্যবশকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০, চাল, ডাল, আটা, আলু, পিঁয়াজ, প্রভৃতি ২০টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ গেল। এছাড়া, কোনো সংস্থার পক্ষে এই সমস্ত পণ্য মজুত করার কোনো সর্বোচ্চ সীমা রইল না। ফলে যে কেউ অত্যধিক হারে উক্ত পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করতে পারে ও বেশি দামে তা বিক্রয় করতে পারে, এক্ষেত্রে সরকারকে জবাবদিহি করার কোনো বাধ্যকতা থাকলো না সেই সংস্থার।
২) কৃষকদের (সশক্তকরণ ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও কৃষি পরিষেবা চুক্তি-র আইন, ২০২০, নীলকর সাহেবদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া কৃষকদের দুর্গতির কথা আমরা সবাই জানি, এটা তারই আধুনিক রূপ। কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর, চুক্তি অনুযায়ী ফসল উৎপন্ন না হলে বা উৎপন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে না।
৩) কৃষকদের উৎপাদনের ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার এবং সুবিধা) আইন, ২০২০, ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নিজেরা সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল কিনতে পারবে। ফলে, পূর্বের স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকদের জন্য খরচের দেড় গুণ দামে বিক্রয়মূল্য সংক্রান্ত সুনিশ্চিতকরণের দায় সরকারের রইল না।
এই মারণ আইনগুলির বিরোধিতায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা ৯ই আগস্ট ২০২০ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের রাস্তা নেন। পরে অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা এতে যোগ দেন। তাঁরা দিল্লির সিংঘু ও টিকরী বর্ডারে বর্তমানে পাঁচ মাস ধরে বিক্ষোভরত। কিন্তু লকডাউন ও তৎপরবর্তী আনলকের ফলে বেশিরভাগ অঞ্চলে এই আন্দোলন নৈতিক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি। এরই মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর ও ২০শে সেপ্টেম্বর যথাক্রমে লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই জনবিরোধী কৃষি বিল গুলো আইন হিসাবে পাশ হয়ে যায়।
এই কৃষি আইনগুলোর বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলনকে ‘অশান্তিকর’ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে ভুয়ো তথ্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আন্দোলনকারীদের ‘আন্দোলনজীবী’ আখ্যা দিয়েছেন। দিল্লী শহরের সীমানায় বসা কৃষকদের মধ্যে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণ গেছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় আর তবুও আজ তাঁদের করোনা ছড়াবার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এই কাজে এগিয়ে আছে মোদী-র ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আর তার পেটোয়া, তথাকথিত সাংবাদিকেরা।
লকডাউনের শেষে নতুন খেলা শুরু হলো, আনলক। মানুষের মনে করোনার ভয় কমলেও, স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হলো। কিন্তু সিনেমা হল, শপিং মল সব কিছু খোলা রইল। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কি করোনা আসে? অনলাইনে ক্লাস হওয়াতে ৯১% ছাত্রছাত্রী, যাদের অনলাইনে পড়ার সুযোগ নাই, তারা বঞ্চিত হতে শুরু করলো। প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছায়নি। তা ছাড়া, সবার আধুনিক মোবাইল কেনার মত আর্থিক অবস্থাও নাই। তাহলে তাদের কী হবে? অনেক ছাত্রছাত্রী আছেন যারা এই অনলাইন পড়াশোনার চাকায় পিষে লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর এেকটা ব্যাপার হচ্ছে, প্র্যাক্টিক্যাল বা হাতে কলমে শিক্ষা। অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিজে হাতে না শিখলে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাওয়া অসম্ভব। সে সব ক্ষেত্রে, যাদের অর্থ আছে, যারা বিত্তশালী, তারা বিভিন্ন অনলাইন এডুকেশনাল অ্যাপ থেকে শিখতে পারবেন, বাড়িতে প্র্যাক্টিক্যালের সামগ্রী কিনে। কিন্তু যারা সেই প্রিভিলেজ পায় না, তারা কী করবে?
১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২১ বাংলায় স্কুল খুললেও কলেজের কোনো কথাই নাই। আবার, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে ২০ শে এপ্রিল ২০২১ থেকে স্কুল বন্ধ থাকবে গ্রীষ্মের ছুটি হিসাবে। এই দিকে কলেজ তো খোলেইনি। কিন্তু অফলাইনে যেমন ফ নিত, ঠিক তেমন হারেই ফি নিচ্ছে কলেজগুলো। তার মধ্যেও একটা ক্লাসও হয় তো ঠিক মতন হচ্ছে না। অর্থাৎ, মোবাইলের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, নেটের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, আবার কলেজের অন্যায্য ফিও আপনাকে দিতে হবে। এই অসম আর্থিক প্রতিযোগিতায় কতজন পেরে উঠবেন? এর মধ্যেই কখন নতুন শিক্ষানীতি NEP চালু হয়ে যাবে জানতে পারবেন না। শিক্ষা বেসরকারিকরণের সমস্ত ব্যবস্থা অবশ্য পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে।
আনলক-লকডাউন খেলার সুযোগে একের পর এক জনবিরোধী আইন এই ভাবেই পাশ হয়েছে। বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারিকরণ হয়েছে একাধিক সরকারী সংস্থা ও ব্যাংকের। রেল, বিমান, বীমা, খনি, বৃহৎ শিল্প, সবই বেসরকারী হয়েছে। বিপিসিএল, স্টেট ব্যাংক, বিএসএনএল, শিপিং কর্পোরেশন, কোনকোর, ইত্যাদি সংস্থাও বেচে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে।
এর বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। জনগণ বুঝতে শুরু করেছেন কেন্দ্র সরকারের কর্পোরেট দালালির স্বরূপ। পূর্বোক্ত আইন ও বিলগুলির বিপক্ষে প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, নাগরিকত্বের ইস্যু নিয়ে আবার সবাই কথা বলতে শুরু করেছেন। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনগণ কথা বলা শুরু করেছেন। আর তাই শাসক ভয় পাচ্ছে। আবারও করোনা আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে। শীঘ্রই লকডাউন করার কথা ভাবা হচ্ছে। দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের উচ্ছেদ করতে পারে কেন্দ্র কোভিডের জুজু দেখিয়ে — এমনটাই আশঙ্কা করছেন অন্নদাতারা (সূত্র — বর্তমান-২০/০৪/২০২১)। এটা বলাই যায় যে তাঁদের আশঙ্কাই সত্য।
২০২০ সালের সেই ভয়াবহ দিনগুলো ফেরৎ আসতে চলেছে। দিল্লিতে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে, মুম্বাই আর পুণা অনেকদিন ধরেই লকডাউনে। অন্য জায়গায় হতে দেরি নাই। বিভিন্ন জায়গায় থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁরা জানেন না, কীভাবে সংসার চলবে, কী খাবেন, বা আদেও খেতে পাবেন কিনা। এই অনিশ্চয়তা, এই উৎকণ্ঠা ও তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে জনগণ কে ফেলে কী মোদী সরকার আর বিজেপি আরও একবারনিরাপদে উৎরে যেতে পারবে? এর উত্তর দেবে নিজেদের অধিকারের জন্যে গড়ে ওঠা জনতার সংগ্রাম।