সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের ভাড়া করা রাজনৈতিক কৌশল নির্মাতা, প্রশান্ত কিশোর বলেছেন যে ভারতের শাসক দল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), যদি নির্বাচনে হেরেও যায় তবুও সেই দলটি ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে খুব তাড়াতাড়ি বিলীন হবে না বরং কয়েক দশক রাজনৈতিক রণাঙ্গনে থাকবেই। কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য কে ঘিরে বিজেপি-বিরোধী শিবিরে শুরু হয় তুমুল হৈচৈ এবং তাঁকে বিজেপিরই ভাড়াটে হিসাবে চিহ্নিত করা শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস বাদে অন্য বিরোধীরা, বিশেষ করে কংগ্রেস। এর কারণ কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য কংগ্রেস নেতৃত্বকেও খোঁচা দিতে ছাড়েনি।
যদিও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য নিয়ে বলেছেন যে তাঁর কথার অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে ও বিজেপি কে হারাতে বিরোধী ভোটের একত্রে আসা ভীষণ জরুরী, তবুও সেইদিকে কর্ণপাত না করে অনেকেই এই রাজনৈতিক পরামর্শদাতার, যিনি ২০১৪ সালে মোদীর বিজয়ের প্রধান কারিগর ছিলেন, মুণ্ডুপাত করছেন। কিন্তু কিশোরের বক্তব্য ঠিক কী?
গোয়ায়, তৃণমূল কংগ্রেসের বৈঠকে কিশোর বলেন, “ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বিজেপি আরও কয়েক দশক থাকবে। ওরা জিতুক বা হারুক। কংগ্রেসের যেমন প্রথম ৪০ বছরে বিজেপি কোথাও ছিল না। ৩০% এর বেশি ভোট একবার দখলে চলে এলে সেটা এত তাড়াতাড়ি যাবে না। তাই কখনও এই ভুল করবেন না যে মানুষ ভীষণ রেগে রয়েছে আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কুর্সি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যদিও মোদীকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, বিজেপি কিন্তু কোথাও চলে যাচ্ছে না। ওরা থাকবে, আর আরও কয়েক দশক লড়াই করবে। এত তাড়াতাড়ি যাবে না বিজেপি।”
এই বক্তব্যের মধ্যেই রাহুল গান্ধী কে খোঁচা দেন পিকে হিসাবে পরিচিত কিশোর। “এটাই হল রাহুল গান্ধীর সমস্যা যে তিনি মনে করছেন, মানুষ মোদীকে ছুঁড়ে ফেললো বলে। সেটা হচ্ছে না,” বলেন কিশোর। এই বক্তব্যতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে কংগ্রেসের ভক্তরা। তাঁদের ঈশ্বর সম রাহুল গান্ধীর অপমান তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে, বিজেপি এই বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করতে না পেরে পিকের “কয়েক দশক” থাকার কথাটি ব্যবহার করে এই প্রচার শুরু করে যে, সেই রাজনৈতিক কৌশল নির্মাতা নাকি স্বীকার করেছেন বিজেপি কে হারানো যাবে না।
কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য কি ভুল? বিজেপি যদি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে হেরে যায় তাহলে কি দলটা ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চের থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে? অথবা, আরো সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলে, বর্তমানে সংসদীয় বিরোধীদের, বিশেষ করে ক্ষয় রোগাক্রান্ত কংগ্রেস পার্টির, যা অবস্থা তাতে কি সত্যিই ২০২৪ সালে তারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখার সাহস করছে?
কিশোর কোনো জ্যোতিষ নন। তিনি অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী কৌশল স্থির করে দেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কে বিপুল ভোটে জিতিয়ে তিনি গোটা ভারতেই নিজের প্রাক্তন সংস্থা আই প্যাক এর বাজার গরম করে ফেলেন। অথচ তারপরেও তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সাহায্যে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে পেশাদারি রাজনৈতিক কৌশল নির্মাণ করার থেকে অবসর নেন। তবুও, যেহেতু তিনি বিজেপি, কংগ্রেস, আম আদমী পার্টি (আপ), তৃণমূল কংগ্রেস, প্রভৃতির গতিপ্রকৃতি কে একজন পেশাদার হিসাবে খুবই কাছ থেকে দেখেছেন তাই বিজেপির ভবিষ্যত নিয়ে তাঁর বক্তব্য খুব একটা ফ্যালনা নয়।
পাঠক যদি ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতের সংসদীয় রাজনীতির বিবর্তন কে পুঙ্খানপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন যে এই কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের পর থেকে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ভারতের রাজনীতির একটি স্বাভাবিক, সাধারণ ধারা হয়ে গেছে, যাতে সমস্ত মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলই গা ভাসিয়েছে।
দিল্লীর আপ হোক বা পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) হোক বা সমাজবাদী পার্টি, বিজেপির আর তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) দ্বারা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি অতি প্রতিক্রিয়াশীল, ইসলাম বিদ্বেষী, ব্রাহ্মণত্ববাদী “হিন্দু” ভোট ব্যাঙ্ক কে আর কেউই অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাচ্ছে না।
এই দলগুলো বুঝে গেছে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ঠেকায় পড়ে,বিজেপি কে হারাতে, চোখে ঠুলি পরে তাদের মত “ধর্ম নিরপেক্ষ” দল কে ভোট দেবেন। তাই তারা আর বিজেপি-বিরোধী মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়া নিয়ে চিন্তিত নয়, শুধু চিন্তিত কী ভাবে বিজেপির মেরুকরণ করা ভোট ব্যাঙ্ক ভেঙে হিন্দু ভোট নিজেদের ঝুলিতে আনা যায়।
তাই, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জমির কেসে যখন সুপ্রিম কোর্ট এক অভূতপূর্ব রায়ে, আরএসএস-এর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের গুঁড়িয়ে দেওয়া মসজিদের জমি রাম মন্দির গড়তে দিয়ে দিল, তখনই কিন্তু সমস্ত তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলো, কংগ্রেস থেকে আপ বা বিএসপি, দুই হাত তুলে এই রায় কে স্বাগত জানালো।
কংগ্রেস নেতারা কথায় কথায় রামের প্রতি প্রেম দেখান; বিএসপি নেত্রী মায়াবতী, যিনি নিজেকে কাঁশিরামের উত্তরাধিকারী ও দলিত মুক্তির কান্ডারী হিসাবে তুলে ধরেন, ক্ষমতায় এসে ত্বরিত গতিতে রাম মন্দির নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দেন ভোট পাওয়ার স্বার্থে; আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল অযোধ্যায় গিয়ে রাম লালা দর্শন করে তাঁর পার্টির নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন; আর সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব রাম মন্দিরের প্রতি প্রেম দেখাতে গিয়ে তাঁরই পিতা মুলায়ম সিং যাদবের সরকারের দ্বারা ১৯৯০-তে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী করসেবকদের উপরে গুলি চালানোর ঘটনা কে চেপে যান। কিন্তু কেন?
এর কারণ এই পার্টিগুলো উপলব্ধি করেছে যে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির মডেলের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে গেলে তাদেরও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ কে আঁকড়ে ধরতে হবে, ব্রাহ্মণত্ববাদের আশ্রয়ে কাজ করতে হবে ও বৃহৎ পুঁজির স্নেহধন্য হতে হবে। ফলে বিজেপির তরফ থেকে ভারতের রাজনীতির যে সরকারি ভাবে গৈরিকরণ করা হয়েছে তা কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় না থাকলেও বহাল থাকবে। সম্প্রতি দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে আপ-এর জয় থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পরেও যে ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী চেতনা এই রাজ্যের সরকারগুলো কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বিজেপি সেখানে না থাকলেও, আরএসএস কিন্তু পুরো দমে উপস্থিত।
ফলে, কাল যদি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে মোদী ২০২৪ সালের নির্বাচন হেরেও যান, তাহলেও কিন্তু নতুন বিরোধী জোট সরকার বা কোনো পার্টির একক সরকার মোদী সরকারের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্তগুলো বা নীতিগুলো বদলাবে না। কোনো সংসদীয় রাজনৈতিক দলই কাশ্মীরে ধারা ৩৭০ ও ৩৫-এ পুনঃ বলবৎ করবে না। কোনো দলই কিন্তু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চালু হওয়া “গো রক্ষা” সংক্রান্ত আইনগুলো—যা ব্যবহার করে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা হয়—বাতিল করবে না। কোনো দলই কিন্তু অযোধ্যায় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দ্বারা ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের জমিতে মন্দির নির্মাণ রুখে দিয়ে পুনরায় মসজিদ নির্মাণ করবে না।
তাই বিজেপি ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক, বিজেপির আদর্শ, রাজনীতি, প্রভৃতি, ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ময়দানে জীবন্ত থাকবে, আর প্রতিটি রাজনৈতিক দল, যারা ক্ষমতায় আসবে বা আসার চেষ্টা করবে, তাদের এই ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে হবে। ফলে রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি, যে দল ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রায় ২০ কোটির উপর ভোট পেয়েছিল, ২০২৪ সালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। এমন কি শোচনীয় ভাবে হেরে গেলেও, বিজেপি কেন্দ্রের রাজনীতির ময়দানে এক শক্তিশালী পক্ষ হিসাবে থাকবে, যে ভাবে ১৯৭৭ সালের পরে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পার্টি ছিল।
কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য শুনে যাঁরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছেন, তাঁরা কি বিজেপি কে বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত করার জন্যে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক, আর্থিক আর সামাজিক রূপরেখা তৈরি করেছেন? তাঁরা কি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের প্রতিটি সৈনিক কে, তাদের প্রযোজকদের, রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করে মতাদর্শগত ভাবে, সাংগঠনিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে পরাস্ত করতে প্রস্তুত?
যদি তাঁদের সেই প্রস্তুতি বা লড়াইয়ের মানসিকতা না থাকে, যদি বিজেপির বিরুদ্ধে একটি সত্যিকারের বিকল্প বানানোর পরিকল্পনা বা লক্ষ্য না থাকে, তাহলে কেন কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য তাঁদের উত্তেজিত করছে? কিশোরের কথা মতন তো বিজেপি জিতবে বা হারবে না, কিশোরের কথা মতন তো ভারতের রাজনীতিও চলবে না, তাহলে তিনি কী বললেন তাতে বড় বড় স্বনাম ধন্য “ধর্মনিরপেক্ষ” সাজা দলগুলোর কী যায় আসে? কেন আজ কিশোরের বক্তব্য অনেকেরই কাছে বিষ মনে হচ্ছে, বিশেষ করে কংগ্রেসের কাছে?
তার কারণ, কিশোর খুব সহজেই সেই সত্যটি প্রকাশ্যে এনেছেন যা কংগ্রেসীরা নিজেদের দম্ভ বজায় রাখতে প্রকাশ্যে বলেন না – কংগ্রেস আজ একটি মৃত সাপ। একা কংগ্রেস কোনো ভাবেই বিজেপি কে পরাস্ত করতে পারবে না, আর মোদীর বিকল্প কোনো মুখও তুলে ধরতে পারবে না। বরং নানা কুট কাচালি করে বিরোধী ভোট ভাগ করে দেওয়ার তাল ঠুকবে কংগ্রেস।
তাই, এহেন কংগ্রেসীদের কাছে কিশোরের বিজেপি নিয়ে বক্তব্য অসহ্য লাগবেই। কিন্তু সেই কংগ্রেস দলের লোকেরাই কিন্তু দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে গোয়ায় সরকার গড়তে। তাই সেই গোয়ায় দাঁড়িয়ে কিশোরের বিজেপি ও কংগ্রেস কে আয়না দেখানো একটা গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা আর এর থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্দোপাধ্যায়েরও কংগ্রেস কে প্রান্তিক করে তৃণমূল কংগ্রেস কে গোয়ায় প্রধান বিরোধী দলে পরিণত করার কাজ জোর কদমে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এবার দেখার বিষয় হল যে বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস কী ভাবে আর একটি কংগ্রেস হওয়ার চেয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারে গোয়ায়।