আজ ঐতিহাসিক মে দিবস। পথ চলতে চলতে অনেকেই দিবসগুলো কে উৎসবের পাঁজির মতন মনে রাখেন তবে সেই দিবসের তাৎপর্য এবং সর্বোপরি সেই দিবসের শপথগুলো ভুলে যান। যেহেতু ধর্মঘটী শ্রমিকদের রক্তে রাঙা হে মার্কেটের থেকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের লাল পতাকার জয়যাত্রা শুরু তাই সেই লাল পতাকা নিয়ে আজ অনেকেই ভাষণ দেবেন, অনেকেই কথা বলবেন বর্তমান সময়ে শ্রমিক শ্রেণীর চরম দুর্দশা, দারিদ্র, তাঁদের উপর চলমান শোষণ ও অত্যাচার নিয়ে। অনেকেই বলবেন প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার কথা, তুলবেন কার্ল মার্কস আর ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস এর সেই বিখ্যাত স্লোগান “দুনিয়ার মজদুর, এক হও”। তবে এই মে দিবসে চীন ও কিছু দেশ ছাড়া বাকি সারা বিশ্বেই করোনা ভাইরাসের ভয়ে কিন্তু লক ডাউন চলছে। আর এই লক ডাউনে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁদের ক্রীতদাসে পরিণত করার একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আজ আমাদের চোখের সামনে উন্মোচন হচ্ছে।

ভারতবর্ষে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও তার ফলে হওয়া লক ডাউনের ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমিক শ্রেণী। মার্কস বা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সময়ের শ্রমিক শ্রেণীর সাথে বর্তমান শ্রমিক শ্রেণীর এক বিস্তর গুণগত ফারাক সৃষ্টি হয়েছে যেমন, তেমনি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও লক ডাউনের ফলে ক্রীতদাসে, এমন কী ভোটাধিকারহীন, কারখানাহীন এবং উৎপাদনের জন্যে সক্ষম থাকার জন্যে শ্রমিকশ্রেণী কে যে বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ, যেমন খাদ্য, পরিধান ও আচ্ছাদন, পুঁজিবাদ জুগিয়ে থাকে বলে মার্কস দেখিয়েছিলেন, সেই রসদহীন একটি শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। সারা দেশজুড়ে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অনাহারক্লিষ্ট হয়ে হাজার হাজার মাইল পদযাত্রা করে নিজেদের গ্রামে, নিজেদের রাজ্যে ফিরছেন এই ছবি আজ থেকে দুই মাস আগে অকল্পনীয় হলেও বর্তমানে মধ্যবিত্তের চোখে একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। এর সাথে সাথে তাঁদের উপর অমানুষিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পথে না খেতে পেয়ে, গাড়ি চাপা পড়ে বা অসুস্থ হয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মৃত্যুও শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের গা সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে শ্রমিকেরা ফিরতে পারেননি নিজেদের রাজ্যে, তাঁদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। অনেক ট্রেড ইউনিয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের থেকে তাঁদের হাতে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছে দিলেও কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন হেলদোল হয়নি। জলের মতন ডাল বানিয়ে পোড়া রুটির উপর তা ছড়িয়ে দিয়ে শ্রমিকদের সামনে দম্ভের সাথে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে সরকারি খাবার হিসাবে। শ্রমিকদের জন্যে বরাদ্দ করা রেশন লুঠ করেছে ফোঁড়েরা আর শ্রমিকদের শুনতে হয়েছে গঞ্জনা, তাঁদের খেতে দিয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে এই ভাব দেখিয়েছে দিল্লী, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিল নাড়ু সহ নানা রাজ্যের সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার যে ভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়ে বড় মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকদের তোষামোদ করছে ও মানুষের করের টাকা দিয়ে এই ধনীদের সঙ্কট থেকে মুক্ত করছে, ঠিক তখন গরীব মানুষের জন্যে বা শ্রমিকদের জন্যে সরকারের কোন মাথাব্যথা তো দূরের কথা, বরং তাঁদের নিংড়ে আরও কিছু ধন যদি ধনীক শ্রেণীর সিন্দুকে ভরা যায় তার তোড়জোড় করছে।

মে দিবস শ্রমিকের অধিকারের সংগ্রামের দিন। সেই সংগ্রামের একটা মুখ্য দাবি ছিল আট ঘন্টা কাজ। বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী এই আট ঘন্টা’র কাজের দাবি আদায় করেছিল। অথচ নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির যুগে শুরুর থেকেই ওই আট ঘন্টার কাজ বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি করে আসছে পুঁজির মালিকেরা। তাঁদের কাঠপুতুল হয়ে নাচ করা ভারতের প্রাক্তন সরকারগুলো এই দাবি অংশতঃ মেনে নিয়ে স্পেশাল ইকোনোমিক জোন বা এসইজেড এর মাধ্যমে শ্রমিকদের দশ বা বারো ঘণ্টা খাটিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এবার মোদী’র ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) সরকার এই করোনা ভাইরাস ও তার লক ডাউনের ফলে হওয়া আর্থিক বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে আইন করে শ্রমিকদের শ্রম দিবস কে ১২ ঘন্টা অবধি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শ্রম আইন সংশোধনের নামে যে ভাবে শ্রমিকদের বহু সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিতে চাইছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) এনে বিজেপি কোন শ্রেণীর অধিকার কেড়ে তাঁদের রাষ্ট্রহীন, দর কষাকষির অধিকারহীন শ্রেণীতে পরিণত করতে চাইছে।

আজ আমাদের মনে রাখা দরকার যে মে দিবস একটা পতাকা উত্তোলনের আর হারমোনিয়াম-তবলা সহযোগে গান গাওয়ার দিন নয়। এটা একটা শপথ। শ্রমিকের অধিকার নিয়ে আপস না করার শপথ। মালিকশ্রেণীর জুলুমের কাছে, গুলি-লাঠি’র কাছে হার না মানার শপথ। নিজের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারগুলো পুঁজির মালিকদের পায়ে ভেট না চড়ানোর শপথ। সেই শপথ পালন করার জন্যে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় হতে পারে না। গরীব শ্রমজীবী মানুষের পিঠ আজ দেওয়ালে শুধু ঠেকেনি, তাঁরা পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছেন। একদিকে যেমন বিজেপি ও মোদী সরকার সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ভাবে বশীভূত করতে চাইছে তেমনি অন্যদিকে গুজরাট রাজ্যের মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজির মালিকেরা সরকারের কাছে আগামী এক বছর অবধি ট্রেড ইউনিয়ন করা নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে। এই স্পর্ধা তারা পাচ্ছে, এই এনআরসি করে শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করার সুযোগ তারা পাচ্ছে শপথগুলো পালন না হওয়ায়। তাই অত্যন্ত জরুরী হল শপথগুলো কে বোঝা আর সেই হিসাবে শ্রমিকদের বোঝানো যে তাঁদের সামনে কী বিপদ এবং এই বিপদ থেকে তাঁদের রক্ষা পাওয়ার জন্যে ঠিক কী ভাবে সংগ্রাম করতে হবে। এটা না হলে মে দিবস ক্যালেন্ডার থেকে মুছে যেতেও বেশি সময় লাগবে না।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla