গত মার্চ মাসের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ অবধি দিল্লী শহরের নিজামুদ্দিন মার্কাজে অনুষ্ঠিত তাঁদের বার্ষিক ধর্মীয় সভার কারণে তাবলীগি জামাত সদস্যদের সারা দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার ও তার বশংবদ চাটুকার মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো। প্রচুর মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে জঘন্য কুৎসা করা হয় তাবলীগি জামাতের সদস্যদের নামে; এতে শুধু যে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তার লেজুড় সাংবাদিক সাজা এক দল দাঁড়কাকই যুক্ত তা নয়, এই ভয়ানক প্রচার কাণ্ডের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্র, তার মুসলিম-বিদ্বেষী পুলিস ও কিছু ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরাও যোগ দেন।
বলা হয় যে যদি নিজামুদ্দিন মার্কাজে তাবলীগি জামাত সদস্যরা কোন সভা না করতেন তাহলে ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ নাকি কম হতো। এর সাথে, সমস্ত মুসলিমদের, মানে ভারতবর্ষে বাস করা প্রায় ২০ কোটি মুসলিম জনগণ কে, নিজামুদ্দিন মার্কাজে তাবলীগি জামাতের সভায় যোগ দেওয়া ৩,০০০ জনের সাথে অভিন্ন হিসাবে দেখিয়ে শুধু যে কুৎসা করা হচ্ছে এবং তাঁদের জনসমক্ষে হেয় করা হচ্ছে তাই নয়, এমনকি তাঁদের উপর নানা জায়গায় হিংস্র আক্রমণের পথ প্রশস্ত করা ও প্ররোচনা দেওয়া ও তাঁদের ব্যবসা ও বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাঁদের আর্থিক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার কাজও জোর গতিতে চলছে।
সম্প্রতি কিছু ভিডিওতে কয়েকজন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক কে জনগণ কে মুসলিম সবজি ও ফল বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে ও তাঁদের কে ভয় দেখাতে দেখা গেছে।
এমতাবস্থায় প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংস্থা, তারপর কিছু প্রভাবশালী আরবদের এবং সর্বোপরি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) নিজামুদ্দিন মার্কাজে তাবলীগি জামাতের সভার নাম করে সার্বিক ভাবে দেশজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ঘৃণা ছড়াবার ঘটনা কে সমালোচনা করে। ওআইসি’র সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার তাড়না মোদী’র বহুদিনের এবং এর আগে বিজেপি’র পুরানো নেত্রী ও প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ বেঁচে থাকতে তাঁকে ওআইসি’র সভায় পাঠানো হয়েছিল ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে। যেহেতু ওআইসি’র দেশগুলোর থেকে ভারতে তেল আমদানি করতে হয় আবার অনেক লগ্নিও যেমন আসে তেমনি বহু প্রবাসী ভারতীয়রা এই সব দেশে কাজ করেন এবং ওখান থেকে অর্থ দেশে পাঠান তাই কোন ভাবেই এই সব দেশের সরকার কে চটাতে মোদী সরকার চায়নি।
ফলে মার্কিন চাপ আসা মাত্রই বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা সাংবাদিকদের সামনেই দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের কোন ভাবে মুসলিমদের করোনা ভাইরাস ছড়াবার জন্যে দায়ী করতে মানা করেন এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। ওআইসি’র চাপ আসা মাত্রই মোদী হঠাৎ টুইটারে, যেখানে ভারতের শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মুসলিমেরা বা তাঁদের উপর আক্রমণ করা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট পদাতিক বাহিনী নেই, একটা টুইট করে সকল সম্প্রদায় কে সাথে নিয়ে দেশের ভিতর করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বললেন ও বলে চুপ করে গেলেন। বেশ কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের “মন কী বাত” নামক রেডিও শো’র মাধ্যমে তিনি রমজান মাসে মুসলিমদের বেশি করে দোয়া করতে বললেন করোনা ভাইরাসের থেকে দেশের মুক্তি চাইতে। এই নাটকটা তাঁর অসাম্প্রদায়িক সাজার জন্যে দরকার ছিল। তবুও চিড়ে ভেজেনি কারণ মোদী’র ইন্টারনেট বাহিনী ক্রমাগত মুসলিম বিদ্বেষ যে শুধু ছড়িয়েছে তাই নয়, নানা ধরণের ঘটনার মধ্যে মুসলিমদের টেনে এনে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন লাগাতে চেয়েছে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মহারাষ্ট্রের পালঘর।
মহারাষ্ট্রের পালঘরে লকডাউনের মধ্যে পুলিশের চোখের সামনে দুইজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে নারকীয় গণপ্রহারে প্রাণ হারাতে হয় আদিবাসী একটি মারমূখী ভিড়ের কাছে, যাঁরা সন্দেহ করেছিলেন যে এই দুই সন্ন্যাসী বুঝি বাচ্চা চোর। এই হত্যার ঘটনা কে এক চরম ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) দ্বারা। পুলিশ ও মহারাষ্ট্র সরকারের হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বারবার স্পষ্ট করে যদিও বলেন যে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কোন সাম্প্রদায়িক হিংসার সম্পর্ক নেই, তবুও বিজেপি ও আরএসএস এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে হিন্দু মেরুকরণের প্রচেষ্টা চালায় গোটা মহারাষ্ট্রে। বিজেপি’র পেটোয়া টিভি চ্যানেল আর সংবাদমাধ্যমগুলো বারবার মানুষ কে সাম্প্রদায়িকতার গরল বেটে খাওয়াচ্ছে। বারবার তারা বলছে যে ৮৬% হিন্দুর দেশ ভারতে হিন্দুরাই নাকি আক্রান্ত। এর ফলে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা নানা জায়গায় বৃদ্ধি পেলেও বিজেপি বা আরএসএস কিন্তু তাবলীগি জামাতের ঘটনা কে চাপা দিয়ে দেয়নি, বরং বার বার আঁচে হাওয়া দিয়ে চলেছে।
আরএসএস এর নেতা মোহন ভাগবত রবিবার, ২৬ এপ্রিল, সংবাদ মাধ্যমের সামনে খুব চতুরতার সাথে তাবলীগি জামাতের উপর করোনা ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ চাপান। ভাগবত বলেন যে কোন “ক্রুদ্ধ বা হতাশ মানুষের রাগের ফলে ঘটিত ঘটনা দিয়ে একটি সম্প্রদায় কে বিচার করা উচিত না”, এবং ভারতের “১৩০ কোটি মানুষই ভারত মাতা’র সন্তান”। এর মানে হয়তো অনেকের কাছে দাঁড়াবে যে ভাগবত মুসলিমদের উপর আক্রোশ দেখানো কে বন্ধ করতে বলেছেন আর করোনা ভাইরাসের বাহক হিসাবে তাদের চিহ্নিত করতে মানা করেছেন। কিন্তু আদতেও কি তাই? আমরা যদি একটু গভীরে গিয়ে এই সাদামাটা কথার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব যে খুব মসৃন ভাবে ভাগবত কিন্তু মুসলিম তাবলীগি জামাতের সদস্যদেরই করোনা ভাইরাসের বাহক বলে চিহ্নিত করলেন ভাগবত।
“কিছু মানুষের ক্রোধ ও হতাশার ফল” বলে তিনি তাবলীগি জামাতের সদস্যদের উপর দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়াবার যে অভিযোগ তাকেই সত্য বলে সার্টিফাই করে দেখাতে চাইলেন যে সমস্ত মুসলিমেরা করোনা ভাইরাসের স্বেচ্ছাবাহক না হলেও তাবলীগি জামাতের সদস্যরা ভারতের উপর (পড়ুন হিন্দুদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে হতাশা ও ক্রোধ থেকে এই কাজ করেছে। যখন প্রধানমন্ত্রী মোদী কে টুইট করে ঐক্যের বাণী নমঃ নমঃ করে দিতে হচ্ছে, যখন তাঁকে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে বেশি বেশি করে করোনা ভাইরাস থেকে দুনিয়া কে মুক্ত করার জন্যে প্রার্থনা করতে বলা হচ্ছে, যখন সংখ্যালঘু মন্ত্রী কে ওআইসি কে শান্ত করতে বলতে হচ্ছে যে ভারত নাকি “মুসলিমদের জন্যে বেহেস্ত”, যখন ভারতের মধ্য প্রাচ্যে অবস্থিত সমস্ত দূতাবাসের কর্মীরা আদাজল খেয়ে আরব লগ্নিকারীদের তোষণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে, ঠিক তখন ভাগবতের এই বাণী কিন্তু প্রমাণ করছে যে ভারতের মুসলিমদের উপর থেকে শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার পাহাড় সরে যাবে না। বরং নতুন নতুন কায়দায় তাঁদের নিপীড়ন করবে আরএসএস ও বিজেপি, ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও ব্রাক্ষণত্ববাদী সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি এই ফ্যাসিস্ট শক্তি।
বর্তমানে যে সকল তাবলীগি জামাত সদস্যরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাঁরাই আবার তাঁদের হিন্দু ভাই বোনেদের স্বার্থে রক্তের প্লাজমা দান করছেন যাতে তাঁদের শরীরের মধ্যে গজিয়ে ওঠা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি যাঁরা এখনো সংক্রমিত তাঁদের শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ থেকে তাঁদের মুক্ত করে। রাজধানী দিল্লী শহরের বুকে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এবং এর সুফলও দেখা দিয়েছে। অথচ আজ অবধি যে সকল মোদীভক্ত ও সরকারের চরণামৃত পান করা সংবাদমাধ্যম নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, তাবলীগি জামাত সদস্যদের বিরুদ্ধে কুৎসা করে গেছে, তাদের কেউই কিন্তু এই সেরে ওঠা তাবলীগি জামাত সদস্যদের প্লাজমা দান নিয়ে একটাও কথা বলছে না। বরং আজও সেই একই কায়দায় কুৎসার বান ছুটে চলেছে যে জামাত সদস্যরা নাকি ডাক্তার, পুলিশ ও নার্সদের সাথে দুর্ব্যবহার করছেন এবং তাঁরা নাকি হাসপাতালে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছেন। অথচ কোন অকাট্য প্রমাণ বা প্রমাণিত সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ডিং না দেখেই এই গল্পগুলো কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেক অভিজাত ও মধ্যবিত্ত মানুষ নির্দ্বিধায় গিলছে ও সমাজে এই বিষ ছড়াচ্ছে।
তাবলীগি জামাত সদস্যদের উপর নামিয়ে আনা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও তাঁদের নিয়ে ক্রমাগত চলতে থাকা কুৎসার বান এই কথাটা প্রমাণ করে যে নিজের গাফিলতির থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে, অপ্রতুল পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই’র যোগান থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে, হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থা ও পরীক্ষার পর্যাপ্ত কিট না থাকার ঘটনা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতেই আজ মুসলিম-বিদ্বেষ শুধু বিজেপি আর আরএসএস এর নয় বরং ভারতের রাষ্ট্র যন্ত্রের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। চরম ভাবে ধর্মীয় মেরুকরণ হওয়া সমাজে এই বিদ্বেষের ফলে বিজেপি যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের ভোটব্যাঙ্ক এ ভাঙন আটকাতে পেরেছে তাই নয় বরং পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্রোধের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মুসলিমদের খলনায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এর ফলে লকডাউন পরবর্তী ভারতে চরম ভাবে মুসলিম-বিরোধী হিংস্রতা বাড়বে ও সমাজ এক চরম সঙ্কটে নিমজ্জিত হবে।
এই সঙ্কটের ফলে দেশের ও মানুষের চরম ক্ষতি হলেও, আখেরে লাভ হবে মোদী ও বিজেপি-আরএসএস এর, আর তাই মানুষকে বাঁচাতে ও সমাজের আড়াআড়ি ভাঙন রুখতে আজই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি কে জনগণের মধ্যে ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে খুলে দিতে হবে মোদী সরকারের মুখোশ। বোঝাতে হবে তাবলীগি জামাত না, বড় পুঁজির দালাল এই সরকারই কিন্তু নিজের গাফিলতির কারণে, ও ধনীদের রক্ষার স্বার্থে ভারতবর্ষের মানুষ কে এই ভাইরাসের মুখে ছুড়ে ফেলেছে। একমাত্র বার বার সত্য কে নানা ভাবে তুলে ধরেই এই মিথ্যার জাল থেকে মানুষ কে বাঁচানো সম্ভব হবে।