আম্ফান ঘূর্ণির দাপটে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে। গত কয়েকশো বছরে এই রকম প্রাকৃতিক প্রলয় বাংলার মানুষ দেখেছেন কি না তা সন্দেহ আছে। অষ্টদশ শতাব্দীতে স্বাধীন বাংলায় এইরকম এক ঘূর্ণি আছড়ে পড়েছিল তবে সেদিনকার ক্ষয়ক্ষতির কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র এই মুহূর্তে উপস্থিত নেই। একবিংশ শতাব্দীর এই তীব্র ঘূর্ণিঝড় বাংলার বুক চিরে বিক্ষত করে দিয়ে গেল গ্রাম থেকে শহরের জনজীবন কে। আম্ফান (প্রকৃত উচ্চারণ উম পুন্) ঘূর্ণি ঝড়ের সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব মিলতে অনেকদিন কেটে যাবে আর যেহেতু সরকারি ব্যাপারে আঠারো মাসে বছর হয় তাই মানুষের হাতে ক্ষতিপূরণ যে কবে পৌঁছাবে তারও কোন ঠিকঠিকানা নেই। তবে যেহেতু করোনা ভাইরাসের প্রকোপে জরাজীর্ণ হওয়া সময়ে, দেশজোড়া লকডাউনে এই ঘূর্ণি ঝড়ের দাপট বাংলায় চলেছে তাই বহু মানুষের প্রাণ বেঁচে গেছেন। কারণ যত মৃত্যুর ঘটনা হয়েছে তার বেশির ভাগ হয়েছে বাইরে, তবে সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান এখনো সরকারি ভাবে জানা যায়নি। রাজ্য সরকার প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ কে সময় থাকতে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে, তবে এই আম্ফান ঘূর্ণির প্রকোপ যেহেতু পূর্বের আয়লা, ফণী বা বুলবুলের চেয়েও তীব্র ছিল ফলে এর ক্ষয়ক্ষতির থেকে রাজ্য কে লকডাউনের পূর্ববর্তী অবস্থায় আনতে অনেক বেগ পেতে হবে।
আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ের প্রকোপে যে শুধু গ্রামাঞ্চলেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাই নয়, এমন কী খাস কলকাতা শহরের বুকেও এই ঘূর্ণি তার নিশান ছেড়ে গেছে। প্রতি কোনে গাছ ভেঙে, ল্যাম্পপোস্ট আর ট্রাফিক সিগন্যাল উপড়ে ফেলে আর বিদ্যুতের তার ছিড়ে শুধু যে মানুষের চলাফেরা বন্ধ করেছে আম্ফান ঘূর্ণি ঝড় তাই নয়, কলকাতার বুকে অনেক প্রাণও কেড়ে নিয়েছে সে। বহু বছর পরে কলকাতা দেখলো রাজপথে ভাসমান মানুষের লাশ। মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হয়ে মৃত হেলমেটধারী অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবককে। কলকাতা দেখলো মধ্য কলকাতায় মৃতের মিছিল রাস্তার উপরে। মানুষের মন থেকে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক মুহূর্তে দূর করে নিজের ত্রাস কী ভাবে সৃষ্টি করতে হয় এই আম্ফান ঘূর্ণি তা দেখিয়ে গেল। শুধু যে সে গরীবের উপর প্রকোপ দেখালো তাই না, বরং যে সব ধনী আর উচ্চবিত্তরা শহরের উঁচু উঁচু অট্টালিকায় বসে ভেবেছিলেন তাঁরা সত্যিই নিরাপদ, তাঁদের জানলা, দরজা ভেঙে ঘরের আসবাবপত্রে হানা দিয়ে আম্ফান বুঝিয়ে দিল তার কাছে কোন শ্রেণীরই রেয়াত নেই। শুধু যে মানুষের বাড়িতে সে হামলা করেছে তাই নয় এমন কী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে খোদ নবান্নের উপরতলায় সে উপদ্রব চালায়। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে রাষ্ট্র। সামনে উদ্ধত শির এক অনমনীয় ঘূর্ণি ঝড়।
দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন হয়ে থাকা গ্রামের ও শহরের গরীব মানুষের জীবনে এই আম্ফান ঘূর্ণি নিয়ে এসেছে এক চরম সঙ্কট। আম্ফানের ফলে নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের সবজি, শস্য আর বালি ও নোনাজলে ভরে গেছে বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকার চাষের ক্ষেত। এই মাটি পরিষ্কার করে চাষ যোগ্য করা এক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আমন ধান বোনার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এই সময়ে যদি কৃষকেরা ধান রোপনে অপারগ হন তবে যে শুধু তাঁদের জীবনেই নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার তাই নয়, এক চূড়ান্ত খাদ্য সংকটে ভুগবে গোটা পশ্চিমবঙ্গ। জমিতে নোনাজল বা বালির সাথে সাথেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তা আর বিদ্যুৎ সংযোগ, তার ফলে নানা অঞ্চলের ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ তীব্র সঙ্কটে পড়েছেন। পানীয় জলের সমস্যাও ঘনিয়ে উঠেছে এবং বহু মানুষ গৃহহীন হওয়ায় এখন সরকারি শিবিরে আশ্রয় নিলেও তাঁদের খাদ্য ও পানীয় জলের বন্দোবস্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে প্রশাসন কে। বহু মানুষের বাড়ির জলের ট্যাংক আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ে উড়ে যাওয়ায় লকডাউনের বাজারে তাঁরাও গভীর সঙ্কটে পড়েছেন। হাওড়া জেলার গ্রামীণ অঞ্চলেই হাজার খানেক মাটির বাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে, অনেক বাড়ির টালির ছাদ ও আসবেস্টসের ছাদও উড়ে গেছে। গাছ ভেঙে ক্ষতি হয়েছে প্রকৃতির ও গাছ উপড়ে পড়ায় বহু জায়গায় গাড়ি ও রেললাইনের ক্ষতি হয়েছে। কলকাতা বিমান বন্দরও একবুক জলে ডুবে গেছে।
আম্ফান ঘূর্ণির প্রকোপ ও তার উৎস এবং কারণ নিয়ে নানা ধরণের তর্ক বিতর্ক চলতে থাকলেও এই সঙ্কট থেকে আবার যে শিক্ষা বাঙালি কে দেওয়া হল তা হচ্ছে প্রকৃতি দিয়ে প্রকৃতির প্রকোপ থেকে বাঁচার পথে চলার শিক্ষা। যেহেতু নির্বিচারে গাছ কেটে, নদী নালা শুকিয়ে ও বিনা কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় নগরায়ন হয়েছে উন্নয়নের নাম করে তাই আজ একটি চরম শক্তিশালী ঘূর্ণি ঝড়ের সামনে রুখে দাঁড়াবার কোন অস্ত্র বাংলার মানুষের কাছে নেই। এমন কী কেউ যদি আজ থেকে গাছ লাগানো শুরু করেন, তবুও সেই গাছ বড় হয়ে কর্মক্ষমতা পেতে পেতে আরও ৩০ থেকে ৪০ বছর লাগবে আর তার মধ্যে আরও কত যে আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ের মতন দুর্যোগ বাংলার বুকে আছড়ে পড়বে তার কোন হিসাব নাই। পুঁজির চরম আগ্রাসনের ফলে সংকুচিত হয়ে নিজের বিলোপের দিকে চলা অরণ্য ও জলসম্পদগুলো কে রক্ষা না করতে পারলে আগামী দিনে যে আর মাত্র কয়েকটা ঘূর্ণি ঝড়ই বাংলা কে চিরতরে ভৌগলিক ভাবে মিটিয়ে দিতে পারে তা বলার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।