তাঁর “মন কী বাত” অনুষ্ঠানে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেদিন মুখ্যমন্ত্রী ও আমলাদের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনটা ভাল করে পড়তে বলেছেন। তিনি বলেছেন আইনটা পড়লে বোঝা যাবে কোন নির্দেশ, কেন, কিভাবে আসছে। সমস্ত অস্পষ্টতা দূর হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। যা বলেননি তা হল, আইনটি পড়ে দেখুন, আমি যা বলব আপনাদের তাই করতে হবে। আপনারা বাধ্য। তিনি বলেননি, কিন্তু বলতেই পারতেন, আইনটি পড়লে আপনারা দেখবেন প্রধানমন্ত্রী এখন দেশের একচ্ছত্র অধিপতি, সর্বময় কর্তা। তার সমস্ত আদেশ সবাইকে অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। অঘোষিতভাবে দেশে এখন সংবিধান নেই, বিচারব্যবস্থা নেই, পার্লামেন্ট নেই। আছে শুধু এক্সিকিউটিভ। আমলা আর পুলিশ- মিলিটারি। আর তাঁকে এই সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (ডিএম অ্যাক্ট) বা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ২০০৫।
তাই করোনা তদন্তে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় দল আসা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ফোঁস করলেও, ২৪ ঘন্টা পরেই একেবারে সাপের মাথায় মন্ত্র পড়া। তিনি সব নির্দেশ চুপচাপ মেনে চলেছেন। এই আইন বলেই রাজ্যে কেন্দ্রীয় দল পাঠাতে বা একতরফা দোকান খোলার আদেশ দিতে বা পের্ট্রাপোল বর্ডার খুলে দিতে রাজ্যকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি কেন্দ্রীয় সরকার । কিন্তু টিভির পর্দায় ফোঁস করা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর কিছুই করার নেই। প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ ‘আইনসন্মত‘ কাজ করেছেন। আইনসন্মত কিন্তু সংবিধানসন্মত তো?
সংবিধান এদেশের সর্বোচ্চ আইন। এ কথা সবাই জানেন। এমন কোন আইন এদেশে করা যাবেনা যা সংবিধানসম্মত নয়। সংসদে তৈরি বহু আইন বা আইনের ধারা-উপধারা সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। একথাও সবার জানা। কিন্তু এই কথা করোনা সংকটের আগে বোধহয় জানাই ছিল না যে, এদেশে এমন অন্তত একটা আইন আছে যা ছত্রে ছত্রে সংবিধানকে নস্যাৎ করেছে এবং সে আইনের ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধানকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ, এই আইন ভারতীয় সংসদে পাস হয়েছে। মাত্র ১৫ বছর আগে ২০০৫ সালে, কংগ্রেসী জমানায়। এবং এদেশের বর্তমান শাসকরা সেই আইনের ক্ষমতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।
সচেতন পাঠক ঠিকই ধরেছেন, এখানে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫ এর কথাই বলা হচ্ছে। সংক্ষেপে এই আইন ডিএম অ্যাক্ট ২০০৫ নামেও পরিচিত। বস্তুত আইনটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আগাপাশতলা অসাংবিধানিক উপাদানে ভরপুর। এই ডিএম অ্যাক্ট একটা কালা কানুন। যে কোনো স্বৈরশাসকের উপাদেয় একটা আইন। প্রসঙ্গত, ডিজাস্টার বলতে সাধারণত প্রাকৃতিক বিপর্যয় বোঝালেও এই ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের পরিধি কিন্তু ব্যাপক। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট “বিপর্যয়”, এমন যে কোনো পরিস্থিতি যাতে ব্যাপক প্রাণহানি হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা আছে সেই রকম যে কোনো পরিস্থিতিই ডিজাস্টার। সবই এই আইনের আওতায় পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই আগামী দিনে কোন রাজনৈতিক সংর্ঘষের পরিস্থিতিতে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা দেখা দিলেও এই আইন প্রয়োগের পূর্ণ সুযোগ আছে। আইনটি সেভাবেই তৈরি। যদিও ২০০৪ সালের সুনামিকে সামনে রেখে আইনটি আনা হয়েছিল।
অনেকের এটা মনে হতে পারে যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হয়তো বা আইনটি প্রযোজ্য হতে পারে। শুধুমাত্র বিপর্যয়ের সময়ে, অল্প সময়ের জন্য এটা ব্যবহার করা যাবে। আসলে কিন্তু তা নয়।ডিএম অ্যাক্ট একটি সাধারণ আইন হিসেবে শাসকের তূনে আছে। শাসক তার প্রয়োজন মতন বিপর্যয় ঘোষণা করে যে কোনো সময়েই ডিএম অ্যাক্ট ব্যবহার করতে পারে, অর্থাৎ এর কোন ভ্যালিডিটি পিরিয়ড নেই। এই রকম নয় যে অধ্যাদেশ জারির তিন মাস বা ছয় মাস বা এক বছর পর্যন্ত আইনটি বলবৎ থাকবে। এই আইনের বলে দেওয়া আদেশ পরবর্তী আদেশ বাতিল না করা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
কী আছে এই আইনে? কেনই বা কালা কানুন বলছি এই ডিএম অ্যাক্ট বা বিপর্যয় মোকাবিলা আইনকে?
এই আইন অনুযায়ী বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ভারত সরকার একটা ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি তৈরি করবে। এই অথরিটি বিপর্যয় মোকাবিলার যাবতীয় নীতি নির্ধারণ করবে, পরিকল্পনা রচনা করবে এবং গাইডলাইন দেবে। এই অথরিটির একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীই হবেন সেই চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান ছাড়াও আরো নয় জন সদস্য থাকবেন। কারা থাকবেন সেটা প্রধানমন্ত্রীই ঠিক করবেন। কিভাবে করবেন, কাদের মধ্য থেকে করবেন, কী হবে যোগ্যতা তা কিছুই এই আইনে বলা নেই। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী যাকে ইচ্ছা তাকে নেবেন। কোন বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী বা বিরোধী দল নেতাদের কাউকে নিতে হবে – এই রকম কিছু কিন্তু আইনে বলা নেই।
প্রধানমন্ত্রী যাকে ইচ্ছা তাকেই সদস্য পদে বসাতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা মত তিনি একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত করবেন। অথরিটির মিটিং তখনই হবে যখন চেয়ারম্যানের ইচ্ছা হবে। সময় এবং স্থান চেয়ারম্যানের ইচ্ছামত হবে। জরুরী পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। যে কোনো কাউকে যে কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে পারবেন। অর্থাৎ জরুরী পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান ম্যানেজমেন্টের অথরিটির সমস্ত ক্ষমতা একাই কার্যকরী করতে পারবেন। পরবর্তী সভায় তাকে সেসব সিদ্ধান্ত অনুমোদন করাতে হবে। পরবর্তী সভা কবে হবে সেটাও চেয়ারম্যান ঠিক করবেন। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় কার্যকরী কমিটি তৈরি করা হবে। ভারত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সচিবরা এই কার্যকরী কমিটির সদস্য হবেন। সেনাবাহিনীর প্রধানরাও সদস্য হবেন। একজন সচিব এই কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। একই ভাবে একই কাঠামোতে প্রতি রাজ্যে ও প্রতি জেলায় ডিজাস্টার অথরিটি তৈরি হবে। রাজ্যস্তরে মুখ্যমন্ত্রী এবং জেলাস্তরে জেলাশাসক হবেন চেয়ারম্যান। সমস্ত ক্ষমতা তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। কিন্তু জাতীয় অথরিটির নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবেন সবাই।
এই আইনের বলেই বর্তমানে সারাদেশে লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে। যদিও আইনে কোথাও লকডাউন শব্দটি নেই। আইনে বলা আছে এই আইনের বলে জারি করা আদেশ বা নির্দেশ ভারতের সমস্ত সরকারকে, সমস্ত নাগরিককে অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র, ইউনিয়ন অফ স্টেটস। অথচ কোনো রাজ্য সরকার বা বিরোধী দলগুলোর সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই সারাদেশে লকডাউন নামিয়ে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হলো। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত কাজকর্ম চার ঘণ্টা পরেই বন্ধ হয়ে যাবে অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানতেই পারবেন না! সংবিধানে এই রকম ক্ষমতা কারো হাতে দেওয়া নেই । অথচ এই আইন দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় একনায়কের ক্ষমতা দিয়েছে।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় দুটি কেন্দ্রীয় দল তদন্ত করছে করোনা সংক্রান্ত ব্যাপারে। রাজ্য সরকারকে কিছু না জানিয়েই কার্যত এই দলকে রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর নির্লজ্জ লঙ্ঘন এই দল প্রেরণ। বিপর্যয় মোকাবিলা আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকার এই কেন্দ্রীয় দলকে সমস্ত রকম সাহায্য সহযোগিতা করতে বাধ্য। না করলে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের মুখ্যসচিব সহ যে কোনো সরকারি অফিসারকে সাসপেন্ড করে, অপসারণ করে, নিজের পছন্দের লোক বসাতে পারে। বিপর্যয় মোকাবিলার প্রয়োজনে সেনা, আধা সেনা নামাতে পারে। এমনকি বায়ু সেনাও নামাতে পারে। বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে আইন মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা সমস্ত নির্দেশ মানতে রাজ্য সরকার, রাজ্য অথরিটি, সবাই সম্পূর্ণ বাধ্য।
কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে ঘুরছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায়। থাকছে তাদের ব্যবস্থাপনায়। রাজ্য সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও রাজ্যের কাছে যা সাহায্য চাইবে দিতে হবে। রাজ্যকে যা করতে বলবে করতে হবে। বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার সেটা সবাই মানতে বাধ্য থাকবে। ভারতের সংবিধানে ভারত সরকারকে এই রকম কোন ক্ষমতায় দেওয়া হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী স্বাস্থ্য রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। রাজ্য সরকার ভালো-মন্দ বুঝবে। অথচ এই বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের জন্য করোনা সম্পর্কিত সমস্ত কিছু নির্দেশ দেবে কেন্দ্র। প্রসঙ্গত বিপর্যয় মোকাবিলা সংবিধানের কেন্দ্র-রাজ্য কোন তালিকাতেই নেই। অথচ এই আইন বলে কেন্দ্রীয় সরকার সারাদেশে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেল।
এই আইনের ৫১ নং ধারা অনুযায়ী, নির্দেশ না মানলে বা বাধা দিলে জেল বা জরিমানা হবে। এই আইনের ৫৬ নং ধারায় বলা আছে কাউকে কোন কাজের দায়িত্ব দিলে তা করতে অস্বীকার করা যাবে না। যে দায়িত্বই দেওয়া হোক না কেন তা পালন করতে হবে। না করলে জেল ও জরিমানা। এই আইন বলে নেওয়া কোন নির্দেশের বিরুদ্ধে সরাসরি আদালতে মামলা করা যাবে না। অন্তত ৩০ দিন আগে অভিযোগকারীকে লিখিতভাবে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটিকে নালিশ জানাতে হবে। অথরিটিই একমাত্র আদালতে অভিযোগ জানাতে পারবে। অথরিটি ছাড়া অন্য কারো মামলা নিতে পারবে না। অন্য সমস্ত আইনের উপরে এই ডিএম অ্যাক্ট আইন বলবৎ থাকবে অর্থাৎ অন্য যে কোনো বিষয়ে অন্য কোনো আইনের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা দিলে ডিএম অ্যাক্ট আইনই কার্যকরী হবে। এবং সমস্ত অফিসার, জনসাধারণকে এই আইনের নির্দেশ মেনে কাজ করতে হবে।
কোন সরকারি অফিসারের এর অন্যথা করার কোন উপায় নেই। কেন্দ্র বা রাজ্যের যেকোনো অফিসার এই ডিএম অ্যাক্ট আইনের বলে দেওয়া নির্দেশ কার্যকরী করতে বাধ্য থাকবে। এই ডিএম অ্যাক্ট আইনের বলে আদেশ দিয়ে যে কোনো লোকের যে কোন সম্পত্তি, জমি-বাড়ী, গাড়ী, যা কিছু মনে করবে, সব হুকুম দখল করা যাবে। এ জন্য অবশ্য উপযুক্ত ভাড়া দেওয়া হবে। সরকারের কোনো পরামর্শ বা সর্তকতা জানানোর থাকলে রেডিও-টিভি বা যেকোন সংবাদ মাধ্যম তা প্রচার করতে বাধ্য থাকবে। জানা গেছে সরকারের তরফ এবারও সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে “পজিটিভ খবর” পরিবেশনের জন্য। “পজিটিভ” মানে কি সেটা আপনাকেই বুঝে নিতে হবে।
এই আইনেরই বলা আছে কার্যকরী কমিটি চাইলে লিখিতভাবে তার সমস্ত ক্ষমতা চেয়ারম্যানের হাতে ন্যস্ত করতে পারে। জাতীয় স্তরে সুপ্রিমকোর্ট এবং রাজ্যস্তরে হাইকোর্টেই কেবলমাত্র এই আইন বলে নেওয়া কোন ক্ষমতার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। এই ডিএম অ্যাক্ট আইনের বলে নেওয়া কোনো পদক্ষেপের জন্য কোন অফিসার বা কর্মীর বিরুদ্ধে কোন মামলা করা যাবে না। কারণ এটা ধরে নিতে হবে যে তারা যাই করে থাকুন না কেন তা করেছেন “সরল বিশ্বাসে” ইন গুড ফেইথ। একেবারে উপদ্রুত এলাকা আইনের মতন। যাই করে থাকুক মামলা করা যাবে না। সাজা দেওয়া যাবে না। চরম অগণতান্ত্রিক এই ধারা রয়েছে এই আইনের মধ্যেও। সবমিলিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সমস্ত ব্যবস্থা করা আছে। পদাধিকারীদের আদালতের বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে তাদের সমস্ত প্রশ্নের উর্ধে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। ভারতবর্ষের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এই বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ২০০৫। তাই এই ডিএম অ্যাক্ট আইন বদলের জন্য বা বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি তোলা খুব দরকার।