সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকে এক তৃষ্ণার্ত পথিক জলের খোজ করতে গিয়ে নানা ধরণের জলের কথা শোনেন ও জানেন তবে পানীয় জল তাঁর কপালে জোটে না। বর্তমানে, বিশ্বের সব জায়গায় জলের দরকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে হাত ধোবার জন্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে আমাদের সন্ধ্যা সাতটার সিরিয়াল পর্যন্ত সবাই বলছে বারবার হাত ধুতে। তা আমি ব্যাটা ভাবি হাত তো ধবো, কিন্তু জল আছে তো? চলুন, আজ জলের খোজ করি।
ছোটবেলায় শুনেছিলাম কোনো এক মহাপুরুষ নাকি বলেছিলেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে জলের জন্য। সেটা হবে কিনা জানা নেই বা হয়তো আর একটু পরে জানা যাবে। যেটা এখন জানা যাচ্ছে সেটা হলো আসন্ন তীব্র দাবদাহে আমরা করোনা ভাইরাস এর সাথে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের ভাঁড়ারের মোক্ষম অস্ত্রটার অভাব খুব শীঘ্রই বোধ করবো, আর সেটা হল জল।
বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি তীব্র জলকষ্ট হচ্ছে নানা জায়গায়। গত বছর চেন্নাই শহরের শোচনীয় অবস্থা দেখেছি। নীতি আয়োগ এর রিপোর্ট অনুসারে রাজধানী নয়া দিল্লী সমেত ভারতের ২১টি মেট্রোপলিটন শহরে ভুগর্ভস্থ জল শেষ হয়ে যাবে এই বছরই, অর্থাৎ ২০২০ তেই। এই রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি বছর দুই লাখ লোক মারা যায় নিরাপদ জলের অভাবে। ৬০ কোটি লোক চরম থেকে মাঝারি জলের কষ্টে ভোগেন। তাই এই যে দিনে বার বার হাত ধোয়ার লড়াই আমরা করছি, যদি জলই না থাকে তবে তো ঢাল তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে যাবো আমরা!
আমরা অনেক দিন থেকেই জল, যার অপর নাম জীবন, হারাতে শুরু করেছি। যার অর্থ হল যে বেশ অনেকদিন ধরেই আমরা আমাদের জীবন হারিয়ে চলেছি আর সেটা আমরা করছি একেবারে নিশ্চিন্তেই। কিছুটা, সব দোষ নন্দ ঘোষ “জলবায়ু পরিবর্তন” এর আর বেশিটা পুঁজিবাদ নামক দানবের কল্যানে। আমাদের আকাশ বাতাস সবই গিলে ফেলেছে শুধু কেড়ে নেওয়ার পুঁজিবাদ। আর রাষ্ট্রের সীমাহীন লালসা নিলামে তুলছে সব প্রাকৃতিক সম্পদ কে। জল সেখানে আজ পণ্যে পরিবর্তিত হয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যেই তার উপর একচেটিয়া মালিকানা হবে বৃহৎ পুঁজির।
The World Resources Institute’s Aqueduct Water Risk Atlas ১৮৯টি দেশে গবেষণা চালিয়ে বিপদজ্জনক ভাবে জলসঙ্কটপূর্ণ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা অনুযায়ী ভারত এর নাম আছে ১৩ নম্বর এ। অথচ এই সংকট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর না আছে কোনো মাথাব্যথা, না আছে সঠিক পরিকল্পনা করার কোন প্রচেষ্টা। মূলধারার সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কারুরই এজেন্ডাতে ঠাঁই নেই জলসংকট এর।
নিবিড় জলের ফসল চাষ যথাসম্ভব হ্রাস করা বা তুলনামূলক ভাবে যে জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বেশি সেখানে চাষ করা, সঠিক ভাবে জল সংরক্ষণ, জলাধার নির্মাণ, জল পরিশ্রুত করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করা এ সময়ের সব থেকে জরুরী দাবি। কিন্তু মানা তো দূরের কথা, এই দাবি শোনে কে?
উটপাখির মতন বালিতে মুখ গুঁজে সব ঠিক আছে ভেবে বাস্তব কে উপেক্ষা করা ও জেনেশুনে ভুলে থাকা একটি স্বার্থপর জাতি আমরা যাঁরা সত্যিই প্রকৃতির কথা চিন্তা করতে পারি না। সব কিছুতেই উদাসীন আমরা। আর যখন নিজের প্রাণ যায় যায় তখন ঈশ্বরের কাছে প্রাণ ভিক্ষা করি! আমরা আসলে আসল ইস্যু নিয়ে রা কাড়ি না। যদি নেতারা বা পাড়ার দাদারা ক্ষেপে যায়! আশা করি এত দিনে লকডাউনের জীবন থেকে এইটুকু তো শেখা উচিত যে “আপনে বাঁচলে বাপের নাম” তত্ত্বে আর চিড়ে ভিজবে না। চিড়ে ভেজার জন্যেও তো জল লাগে!
দিল্লী-স্থিত non-profit organisation, Centre for Science and Environment(CSE) অনুযায়ী ৩০-৪০ সেকেন্ড হাত ধুতে গড়ে ৪ লিটার জল খরচ হয় কল খোলা থাকলে আর কল বন্ধ অবস্থায় জল খরচ হয় ২ লিটার (Down To Earth,16-30 April)। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে, একটি পাঁচ সদস্যের পরিবার যদি দিনে দশ বার হাত ধোয় তবে ১০০-২০০ লিটার জল লাগবে শুধু হাত ধুতে! আর জল খরচ বেড়েছে ২০-২৫% যেটা কিনা আগামী দিনে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলবে আমাদের, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের।
শহরে বসবাসকারী নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বস্তিতে বসবাসকারী দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষগুলোর জন্য আগামী দিন খুবই ভয়ানক। এই দেশের বেশির ভাগ শহুরে গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তের নিজস্ব জলের কলের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাঁদের চিরকাল নির্ভর করতে হয় কমিউনিটি বা বারোয়ারি কলগুলির উপর। মুম্বাই শহরের ধারাবি বস্তি হল এশিয়া মহাদেশের সবথেকে বড় আরবান স্লাম বা শহুরে বস্তি। বর্তমানে করোনা ভাইরাস এর রেড জোন এ পরিণত হয়েছে এই ঘিঞ্জি ধারাবি বস্তি। ধারাবি’র বাসিন্দাদের এক গ্যালন জল ২৫ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। সেই জলের জরুরি কোন কারণ ছাড়া ব্যবহার তাঁদের কাছে বিলাসিতা। সেখানে এই দরিদ্র লোকগুলো কে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলাটা একটা ধৃষ্টতা, যদি না সরকার তাঁদের হাত ধোয়ার জলের ব্যবস্থা করে দেয়। আর এক ভয়ানক করোনা ভাইরাস সংক্রমিত জেলা হলো মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর। এখানকার সানোয়ার এলাকা তীব্র জল কষ্টে ভুগছে বিগত দুই মাস থেকে। এখানেও মানুষের কাছে হাত ধোয়া একটা বিলাসিতা।
ভারতবর্ষে ব্যবহৃত জল শোধন করে পুনঃব্যবহার করার কোনো টেকসই প্রক্রিয়া নেই বললেই চলে। ব্যবহৃত জলের ৬৫% অপরিশোধিত অবস্থায় বিভিন্ন জলাধারে গিয়ে মিশে সেখানকার জল কে আরো দূষিত করে তোলে। এ অবস্থায় দরকার সঠিক উদ্যোগ, আর দায়টা মূলত সরকার বাহাদুরে আর তারপরে সজাগ জনগণের, দুই পক্ষেরই ভূমিকা তখন ঠিক করে পালিত হবে যখন এই বিষয়ে আমাদের নীতি নির্ধারকরা সত্যিই কিছু করতে চাইবেন।
পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ভীষণ ভাবে উদ্বেগের। যে সব জেলায় জলাভাব চরম তার মধ্যে পুরুলিয়া অন্যতম। Firstpostএর রিপোর্ট অনুযায়ী, পুরুলিয়া জেলার ৫০% এর বেশি জল ব্যবহারের অযোগ্য। বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, দুই বর্ধমান সহ বেশ কিছু জেলা প্রতিবছর তীব্র জলের অভাবের সম্মুখীন হয়। Union ministry of drinking water & sanitation এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ৭৮ লাখ গ্রামবাসী পরিশ্রুত জল এর থেকে বঞ্চিত। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমঙ্গের অবস্থান গোটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয়, রাজস্থান প্রথম। এই রিপোর্ট আরো প্রকাশ করে যে শহরে বসবাসকাীদের মধ্যে ৫৬% পরিবারের শুধু মাত্র পরিশ্রুত পানীয় জলের নাগাল পায়। কলকাতার জলস্তরও নেমে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। যথেচ্ছ ব্যয়, জল সংরক্ষণ এর পরিকল্পনার অভাব আর জল সংরক্ষণের পেছনে সরকারের বিনিয়োগে অনীহা, আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণকে চরম বিপদের মুখে ফেলবে।
আজ এই মহামারীর দিনে সবাই যখন করোনা ভাইরাস কে হারানোর জন্য হাত ধুতে রত,তখন সবার পণ হওয়া উচিত রাস্তার ধারে যে কল থেকে উদ্দাম জল পড়ছে সেই দৃশ্য দেখে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে কলটা একটু বন্ধ করার, বন্ধ করবো সেই জল কিনে খাওয়ার বিলাসিতা, যে বিলাসিতা হল জল কে পণ্য করে বেঁচে দেওয়ার ফল।
আমি মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত তাই আয়েষ করে কেনা জলে চুমুক দেব, আর আমার মজদুর ভাই বোনেরা শুষ্ক ঠোঁটে আর্সেনিযুক্ত, ফ্লোরাইড যুক্ত, বিষাক্ত জল খাবে – এই ঘৃণ্য মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে মুক্ত মনে দাবি করি যে জলের বিপণন বন্ধ করতে হবে। জল আমদের অধিকার। আর এই মহামারী এটা নিশ্চয় শিখিয়েছে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর সবার শেষে দাঁড়ানো মানুষটি যদি বিপন্ন হয়, তবে আপনার মতন বিলাসবহুল বাড়িতে থাকা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষটিও সমান ভাবেই বিপন্ন। আপনি সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইলেও আপনি কোনো ভাবেই প্রকৃতির রোষানল থেকে মুক্তি পাবেন না। করোনা ভাইরাসের বাজারে এই কথা আলাদা করে কাউকেই বোঝানোর দরকার নেই বলে মনে হয়।
সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকে অন্য পাড়াগাঁয়ে এসে শেষমেষ জল পেয়েছিলেন পথিক, কিন্তু তার জন্যে তাঁকে সেই পাগলাটে মামার বিরুদ্ধে জোর গলায় চিৎকার করতে হয়েছিল। কিন্তু আওয়াজ না তুললে আপনি বা আমি মরার আগের দুই ফোঁটা জলটাও পাবো না। হাত ধোয়া তো দূরের কথা। আসুন আওয়াজ দিই জলের জন্য। আওয়াজ দিই জীবনের জন্যে আর একটি সুস্থ এবং সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্যে।