এই করোনাক্রান্ত এবং লকডাউন শাসিত সময়ে গত ২ সেপ্টেম্বরে অতিক্রান্ত হলো একজন বিখ্যাত বাঙালি কবির জন্মশতবর্ষ। দুঃখের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে যে জনসাধারণের এই প্রিয় কবি এখন তাঁর এই জন্মশতবর্ষে এসে ফেসবুকের লাইভ প্রোগ্রামে পুনরায় বন্দি হয়ে গেলেন! প্রখ্যাত কবি ও শিল্পীদের দেখা গেল নিজের ঘরের লাইব্রেরির সামনে বসে নিজেদের অথবা শতবর্ষী কবির কবিতা পড়ছেন, আর এসবই দেখা গেল ফেসবুকের লাইভ প্রোগ্রামে। এই করোনার কারণে সরকারের সামাজিক দূরত্ব রক্ষার অবশ্য পালনীয় লকডাউন নির্দেশিকার প্রতি প্রশ্নাতীত নতচিত্ততায় আমরা মুখোশ পরে ঘরে ঢুকে গিয়েছি। ফলে আমাদের প্রতিবাদ আন্দোলনও জনবিচ্ছিন্ন ফেসবুক লাইভের ছেলেখেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। স্বভাবতই ঘরের নিশ্চিন্ত শান্তির অন্ধকারের অবগুণ্ঠনে থেকে ফেসবুকে মুখ দেখানোই শস্তায় বাজিমাৎ করার সহজতম পন্থা হিসেবে আমরা মেনে নিয়েছি।

শতবর্ষী এই কবিই হলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁর জনপ্রিয়তা সাধারণ্যে প্রশ্নাতীত মান্যতা পেয়েছে। তিনি তাঁর জীবনের শেষদিন অবধি কাটিয়েছেন তাঁর ১৪ নম্বর ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের বাড়িতে। এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। আর তাঁর এই বাড়িতেই একসময় আস্তানা গেড়েছিল তরুণ কবিরা, তাঁরা কবির মধ্যে তাঁদের নতুন স্বপ্নের ঠিকানা লাভ করে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। বাস্তবিক গত শতকের সত্তরের দশকে এই বাড়িটিই হয়ে উঠেছিল উদ্দাম তারুণ্যের স্বপ্নের আকাশ।

মনে রাখা দরকার যে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে আদতে নকশালপন্থী কিম্বা কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিগত শতকের সত্তরের দশকের এমনই একজন সাহসী কবি যিনি তাঁর কবিতাকে প্রতিবাদের আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করতে সরাসরি পথে নেমেছিলেন। কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুলিশরাজ কীভাবে স্বদেশ, স-কাল এবং সমসময়কে সন্ত্রাসশাসিত করে তুলেছিল। সেসময় তিনিই  বলতে গেলে একমাত্র কবি যিনি দুর্দম সাহসে ভর করে পুলিশি গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন কবি এবং নকশাল নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশের তরফে প্রকাশ্যে হত্যা করে (১৯৭১-এর ৫ অগাস্ট ভোরে) তাঁর মুণ্ডুচ্ছেদ করার মতো জঘন্য কাজের। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন কবি এবং নকশালপন্থী আশু মজুমদারকে পুলিশ এবং মিলিটারির যৌথ আক্রমণে নিহত হতে! এসময় পুলিশি সন্ত্রাসে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে গেলেও কবি ভয় পাননি। সমসময়ের অন্য কবিরা যখন ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সুখের সন্ধান করছিলেন, তখন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিবাদী কবিতার আয়ুধ হাতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

স্বভাবতই এই রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কবিকে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালনের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্দি  করায় কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে!

একটা সামাজিক আন্দোলন যখন মাটির গভীরে তার শিকড় গেঁড়ে বসে এবং একটা ভূমিকম্পের জন্ম দিয়ে শাসকশ্রেণীর বুকের ভিতরে কম্পন সৃষ্টি করে বিশাল লাল পতাকা উত্তোলন করে এক স্বপ্নের উন্মোচন ঘটায়, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক শ্লোগানে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলে, তখন অনেক ছদ্ম বিপ্লবিদের মুখোশ প্রকাশ্যেই খসে পড়ে। আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়, তাঁদের মানবিক চেতনার উত্তরণ ঘটে।—এরকম ঘটনা ইতিহাসে অনেকবারই ঘটেছে।

গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝির পর আমরা আমাদের দেশে নকশালবাড়িতে কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আর তখন সময়-সচেতন সংবেদনশীল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কোনোরকম বিপ্লবী রাজনীতির সংসর্গ ব্যতিরেকেই, এই আন্দোলনের প্রতি মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেন নি।

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ থেকে ২৫ মে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মার্কসবাদী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্দেশে নকশালবাড়িতে কৃষক আন্দোলন দমন করতে যে পুলিশি সন্ত্রাস জারি হয়েছিল, যার পরিণতিতে এগারোজন কৃষক শহিদ হয়েছিলেন, তার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলার এই আন্দোলনের আগুন সারা ভারতব্যাপী পরিব্যপ্ত হতে সময় লাগেনি। এই আন্দোলনের ফলে জন্ম হয়েছিল উত্তাল এক প্রতিবাদী রণসঙ্গীতের, মূর্ত হয়েছিল এক লাল আকাশ জুড়ে এক নতুন দিনের স্বপ্নের জাগরণ। এই কৃষক আন্দোলনের আগুনে নিজের মুখ দেখেছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর মাস কয়েক পরেই ২৩ নভেম্বর কবি বীরেন্দ্র লেখেন :

                     …আকাশটাকে ঘিরে ফেলছে

 হাজার শকুন

 যেখানে ঝরেছে খুন, ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা…

 এদিকে আগুন জ্বলছে, মুখ দেখছে নিশি পাওয়া একলক্ষ মানুষ।

এ যেন সেই জ্বলন্ত জাহাজের ডেকে লেলিহান শিখায় আগুন জ্বলছে, তবুও ক্যাসাবিআঙ্কা সেই জ্বলন্ত জাহাজের ডেক ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে নেমে আসার চেষ্টা করেনি। এখানেও কবি বীরেন্দ্র দেখেছেন ‘মার্কসবাদী’ মন্ত্রীর নির্দেশে জারি থাকা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে রক্ত, লাশ আর আগুনের সর্বগ্রাসিতা সত্ত্বেও ‘এক লক্ষ মানুষ’ জ্বলন্ত আগুনে তাদের মুখ দেখছেন! এর মাত্র ছ’দিন পরে ২৯ নভেম্বর কবি বীরেন্দ্র আবার লিখছেন : 

                             প্রতিটি ধানের শিষ জ্বলে যেন

ফিনকি দেওয়া খুনের নিশান।

আর এরপর এই সাতষট্টির ডিসেম্বরেই আবার লেখেন :

ঊর্ধ্বে আন্দোলিত

ঐ টকটকে নিশান

মানুষের রক্ত লাগা, হাজার ছাত্রের খুনে লাল,…

…চারদিকে নক্ষত্র ধ্যানাসীন

একটি সূর্যের স্তবে। জয় হবে। নতুন জন্মের। মানুষের।

সাতচল্লিশ-উত্তর ভারতে, বিশেষত বাংলাদেশে, ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’র সাংগীতিক মুর্ছনায় আন্দোলিত এই অভূতপূর্ব লড়াইকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নির্দ্বিধচিত্তে স্বাগত জানিয়েছিলেন, এর মধ্যে মানুষের নতুন জন্মের স্বপ্ন দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।

  কবি বীরেন্দ্র বিগত শতকের সত্তরের দশকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কবলিত কম্পমান কালো দিনগুলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এসময় তিনি তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির  প্রসারণে কোনরকম সংকীর্ণতার গণ্ডিকে প্রশ্রয় না দিয়েই মেরুদণ্ড টানটান করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি সিংহের মতো গর্জন করে কংগ্রেসি অপশাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। এই সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে স্বপ্নপাগল তারুণ্যের বিদ্রোহ দমনে সরকার যখন শ্বেতসন্ত্রাস কায়েম করে দিন আর রাত্রির মধ্যে বিভেদরেখা লুপ্ত করে দেওয়ার দুর্দম স্পর্ধার প্রদর্শনী খুলেছিলেন, সেই সময়, যখন বাংলার কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবিদের অধিকাংশই তাঁদের বিবেক বন্ধক রেখে নিরাপদ জীবনযাপনের তন্নিষ্ট গবেষণায় ব্যস্ত, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন সেই সন্ত্রাস শাসিত অন্ধকার সময়ে প্রকৃত বীরের মতনই মাথা উঁচু করে পথে নেমেছিলেন, প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠনে কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং সরকারি দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কবিতার আয়ুধ নিয়ে রুখে দাঁড়াবার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অনেকেই তাঁকে অবিবেচকের মতো কাজ করছেন বলে অনুযোগ করলেও তিনি তা উপেক্ষা করে দুঃসাহসের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছিলেন। সেসময় বহু প্রতিবাদী আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। 

     একাত্তরের ১০ মার্চ পুলিশ-মিলিটারির যৌথ বেষ্টনীর মধ্যে দুঃসাহসী অভিমন্যুর মত একাকী লড়াই করতে করতে শহিদ হন কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলের বাসিন্দা কবি আশু মজুমদার। সেদিন এই এই ঘটনা সংঘটনের সময় কবি বীরেন্দ্র যাদবপুরেই ছিলেন। যাদবপুরের আরএসপি নেতা বামাচরণ চক্রবর্তী এবং স্বয়ং কবি বীরেন্দ্রের চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ আশুকে পুলিশবাহিনীর বীর পুঙ্গবরা ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। রক্তাপ্লুত আশুর সঙ্গে কবি বীরেন্দ্র এবং বামাচরণ চক্রবর্তীকেও থানায় নিয়ে গিয়ে বহুক্ষণ আটকে রেখেছিল পুলিশ। চোখের সামনে এভাবে একজন কবি ও নকশালপন্থী রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করার মতো পুলিশি অপকর্মকে কবি বীরেন্দ্র কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। ওই বছরের ২৫ জুলাই হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন আড়িয়াদহের যুবক কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়। এর মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় ৪ অগাস্ট রাত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বসন্ত রায় রোডের বাড়ি থেকে কবি ও নকশাল নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় এবং ভোরবেলায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করে তাঁর মুণ্ডুচ্ছেদ  করে যাতে করে তাঁকে সনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই ঘটনার মাত্র কুড়ি মাস আগে অন্ধ্রপ্রদেশের বিপ্লবী কবি সুব্বারাও পানিগ্রাহীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করেছিল পুলিশ। কবি সরোজ দত্তকে হত্যা করার মাত্র তিন মাস পর নভেম্বরের ২৬ তারিখে কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আরও অনেক বন্দির সঙ্গে কবি অমিয় চট্টোপাধ্যায়কে পিটিয়ে হত্যা করে পুলিশ। আর কবি দ্রোণাচার্য ঘোষকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুআরি মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ (২৪ মাঘ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ) জেলের ভেতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

     কবি আশু মজুমদার এবং কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়ের পর কবি সরোজ দত্তকে এভাবে হত্যা করার পুলিশি অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কবি বীরেন্দ্র হীরেন বসু সম্পাদিত সাপ্তাহিক দর্পণ  পত্রিকায় লেখেন বিচার  শীর্ষক একটি কবিতা। কবিতাটির শিরোনাম ‘বিচার’-এর নিচে বন্ধনীর ভেতর লেখা ছিল সরোজ দত্তকে নিবেদিত। এরকম একটা নির্মম নৃশংস ঘটনা সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের তরফে নীরব ঔদাসীন্যের প্রকট প্রদর্শন কবি বীরেন্দ্রের মনোবেদনার কারণ হয়ে উঠেছিল। এই নিষ্প্রতিবাদ তাঁকে এমনই মর্মপীড়া দিয়েছিল যে এই প্রতিবাদী কবিতার  শেষে তিনি আর্তনাদের মতন লিখেছিলেন :

 এদেশে মানুষ কেউ আছে নাকি? আমিই কি

 এখনো মানুষ?

     দর্পণ পত্রিকায় বিচার শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশমহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কবি বীরেন্দ্রের ওপর পুলিশি নজরদারি শুরু হয়। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ কলকাতার বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিটে কবির তৎকালীন কর্মস্থলে সমসময়ের জনৈক কংগ্রেস নেতার সাকরেদের উপস্থিতিতে  কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ অফিসার রীতিমতো হম্বিতম্বি করেছিলেন এমনকি কবি বীরেন্দ্রের সামনেই দর্পণ-বাংলাদেশ প্রমুখ পত্রিকাগুলি বন্ধ করে দবার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে এসেছিলেন!

     তবে এধরনের হুমকিতে কবি বীরেন্দ্র ভীত হননি। তিনি তাঁর মাথা উঁচু রেখেই বলেছিলেন যে তিনি ভয় পান নি। তিনি সেসময় একদিকে যেমন তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্প্রসারণে এক অনুকরণীয় বিবেকি মনুষ্যত্বের দায়িত্বপালনে ব্রতবদ্ধ হয়েছিলেন, তেমনই সমসময়ের কবিদের অনেকের নেতিবাচক ভূমিকার আক্রমণাত্মক সমালোচনা করেছিলেন দ্বিধাহীনভাবেই (এই কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি নাম নীরেন্দ্র চক্রবর্তী, গোলাম কুদ্দুস এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। সেই রক্তে ভাসা সময়ে তিনি অনবরত ‘মুখোশগুলি টুকরো করার সাহস’ অন্বেষণে অক্লান্ত থেকেছিলেন।  আসলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অপ্রতুলতা তাঁকে আহত, যন্ত্রণাবিধুর করেছিলো। তিনি এক সন্ত্রাসমুক্ত নতুন স্বদেশের প্রত্যাশী ছিলেন যেখানে জীবন হবে নিরাপদ, সঙ্গীতমুখর। রাজনীতিগতভাবে নকশালপন্থার সমর্থক না-হওয়া সত্ত্বেও কবি নকশালপন্থী সাহসী স্বপ্নদর্শী তরুণদের মধ্যে আশার আলোর সন্ধানব্রতী হয়েছিলেন। পঁচাত্তরের শেষ কিম্বা ছিয়াত্তরের প্রারম্ভে কবি বীরেন্দ্র লিখেছিলেন : 

ওরা রক্তের নদী হয়ে যায়, কখনো হাড়ের পাহাড়;

ওদের রয়েছে স্পর্ধা, যমের মুখোমুখি দাঁড়াবার:

ওদের মুখের লাবণ্যে আমি অনুভব করি

আমি

স্পষ্ট দেখতে পাই,

সব মানুষের জন্য একটি সত্যিকারের স্বদেশ

জন্ম নিচ্ছে—— আমি তার নাগরিক।

     রাজনীতিগতভাবে নকশালপন্থী আদর্শের অনুবর্তী না-হওয়া সত্ত্বেও বিগত শতকের সত্তরের দশকে কবি বীরেন্দ্র যে অকুতোভয়চিত্তে দুঃসাহসে সওয়ার হয়ে কবিতাকে প্রতিবাদের আয়ুধ করে তুলে পথে নেমেছিলেন তা অনেককেই প্রাণিত করেছিল। তাঁর সাহস অন্য অনেককেই সাহসী হতে শিখিয়েছিল। নির্বিবেক অন্ধকারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদের মশালবাহী এক বিন্দু যিনি তাঁর এই বিন্দুর মধ্যেই সিন্ধুর সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছিলেন অবলীলায়।  ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর চীন বিপ্লবের রূপকার প্রখ্যাত মার্কসবাদী নেতা মাও জে দঙ-এর প্রয়াণের পর কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন :

সমস্ত জীবন

মাথায় রোদ নিয়ে 

তিনি চেয়েছিলেন 

মহাপৃথিবীর জন্য একটিই অমল কবিতা

রচনা করতে… 

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিপ্লব আর মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নের সঙ্গে একটি অমল কবিতার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন সারাটা জীবন। কিন্তু এই রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কবির, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের আয়ুধ হাতে আন্দোলনে সামিল হওয়া কবির জন্মশতবর্ষপালন সেই রাস্তার সঙ্গে সম্পর্ক নিরপেক্ষভাবে কবিতা ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার লাইভ প্রচারে বন্দি করে দিয়েছে! সামাজিক দূরত্ব (কর্পোরেট, পুঁজিপতি এবং তাদের সেবক সহ সরকারের আদর করে দেওয়া নাম) বিধির প্রতি প্রশ্নাতীত মান্যতা প্রদর্শনের কারণে কবিতে রাস্তা থেকে তুলে এনে ঘরের পুতুল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে! এই মান্যতার মিছিলে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রতিবাদকে সিকেয় তুলে এই করোনাক্রান্ত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলি রাস্তার আন্দোলন থেকে ঘরে উঠে এসেছেন। এমনকি এই মিছিলে বামপন্থিরাও সামিল হয়েছেন। দুঃখের বিষয় এই যে, পথে নেমে আন্দোলনে সামিল হতে অভ্যস্ত থাকা কবির জন্মশতবর্ষ পালনও সেই পথেরই অনুসারী হয়েছে! সংগ্রামী জনসাধারণের প্রিয় কবিকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে সামাজিক দূরত্ব বিধির অনুসারিতায় জনবিচ্ছিন্ন ফেসবুক সংস্কৃতির অঙ্গনে বন্দি করা হয়েছে!

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla