কথায় আছে, কিছু মানুষ হাত পুড়িয়ে শেখার দলে! বর্তমানে ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯), জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি)-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বহু ব্যক্তি ও সংগঠন মুখে এবং মঞ্চে বাঘ মারার মতো হুঙ্কার ছাড়ছেন। কিছু সংসদীয় রাজনৈতিক দল গুলোও তাদের সীমানার মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থে চিৎকার করছেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁদের কর্মকান্ড আসলে এই মানুষ-মারা নীতিগুলো কে পরাস্ত করতে কোন সহযোগিতাই করছে না।
যেমন, সকলেই স্বীকার করছেন যে এনপিআর হলো এনআরসি করার প্রথম ধাপ। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) সরকারও একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যেখানে এই সংক্রান্ত পরিষ্কার স্বীকারোক্তি রয়েছে ! কিন্তু তবুও এনপিআর আর আধার নিয়ে অনেকেরই এখনো ভাবনা চিন্তা সঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি।
২০১০ সালে ভারতে আধার কার্ড এবং এনপিআর প্রক্রিয়া শুরু হয় আলাদা ভাবেই। প্রাথমিক পর্বে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতন সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যে, আধার কার্ড প্রদান করা শুরু হয় রেজিস্টার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া দ্বারা এনপিআর প্রকল্পের দ্বারা, যা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩)-এর রুল হিসাবে এনআরসি করার প্রাথমিক ধাপ হিসাবে দেখানো হয়েছে। আর বাকি জায়গায় তৎকালীন প্ল্যানিং কমিশনও এই কাজ শুরু করে। এনপিআর কে প্রথমে জনগণনার (census) সাথে জুড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করা সমীক্ষা করে করা হয় আর সেই এনপিআর নাম্বারের ভিত্তিতে আরজিআই আধার দেওয়া শুরু করে বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে। তবুও নানান জটিলতায় ফেঁসে সেটা অসম্পূর্ণ থাকে।
তবে ২০১২ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আধার থেকে এনপিআর-এর তথ্য বের করার একটি নোটিফিকেশন প্রকাশ করে যা বহু আন্দোলনকারী জানেন না। ১৫ই মার্চ ২০১২ সালে সংসদের প্রশ্নোত্তরে বিজেপি’র প্রকাশ জাভড়েকর কে তৎকালীন রাষ্ট্র মন্ত্রী অশ্বিনী কুমার জানান যে এনপিআর আর আধার একই বস্তু।
এরপর মোদীর নেতৃত্বে ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার গঠনের পরে, ২০১৫ সালে এক প্রস্থ এনপিআর আপডেট আবার করা হয়। এক বছর পরে ২০১৬ সালে ঐ আধার কার্ড প্রক্রিয়া UIDAI এর অধীনে চলে যায়। তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালের মধ্যে ৬০ কোটি ভারতবাসীর আধার আর এনপিআর এর মেলবন্ধন করিয়েছে সরকার। সরকার এই বিজ্ঞপ্তি ২০১৯ সালে জারি করার পরেই নিজের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়। তবুও সেই খবরটি চাপা যায়নি।
এর পরের ঘটনাক্রম সবারই জানা। আসামে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলা এনআরসি এবং দেশজুড়ে গণ আন্দোলন নাগরিকত্বের প্রশ্নটি জনসমক্ষে নিয়ে আসে। এই প্রসঙ্গে বিজেপি সরকারের নেতামন্ত্রীদের পরস্পর বিরোধী মন্তব্য সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে এবং এখনো করছে।
সিএএ ২০০৩ দিয়ে বিজেপি মানুষের জন্মগত নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছিল। সেটাকে সংশোধনী করার প্রতিশ্রুতির দিয়ে সেই বিজেপিই সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক সিএএ ২০১৯ নিয়ে আসে। যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানের মূল প্রস্তাবনা এবং একাধিক আইন বিরোধী। দেশভাগের বলি হওয়া মানুষকে সুড়সুড়ি দিতে ধর্মের নামে নির্যাতিত মানুষকে নাগরিকত্ব দেবে বলে ঘোষণা করে।
নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান আন্দোলনের চাপে বিজেপি সরকার কিছুটা কোনঠাসা হয়েছেন—এরকম যারা ভাবছেন তারা দিবাস্বপ্ন দেখছেন। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ খুব জোরের সাথেই বলছেন: সারা দেশে এনআরসি হবেই ! এবং এনআরসি হলে তার আগে এনপিআরও হবেই । করোনাকালে কেন্দ্রীয় সরকার যদিও ২৫শে মার্চ ২০২০ তে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এনপিআর এবং আধার প্রক্রিয়া সাময়িক ভাবে স্থগিত করেছিল, কিন্তু আনলক-১ থেকেই সে সব যে আবার শুরু হয়েছে সে খবর অনেকেই জানেন না।
আমার কাজের সূত্রে অনলাইনে আধার (আপডেট) বুকিং করতে গিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেকার বেশ কিছু আধার স্লিপ (UIDAI Acknowledgement Slip) হাতে আসে, যেখানে এনপিআর নম্বর দেওয়া রয়েছে। সেইসব ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারি, তারা জানেনই না তাঁদের এনপিআর হয়েছে। তাঁরা জানালেন যে তাঁরা শুধুমাত্র আধার করাতে গেছিলেন আর তার ফলে এই রিসিপ্ট পান।
এই রকম কিছু ঘটনা সামনে আসতেই একটু তথ্যানুসন্ধান শুরু করি । প্রথমেই মনে পড়ে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সুপ্রিম কোর্টের আধার নিয়ে নির্দেশ। “আধার সব ক্ষেত্রে আবশ্যিক করা যাবে না। শুধুমাত্র সরকারি সুযোগ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্ক করা যাবে।”
কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখলাম? বেসরকারি সংস্থা মুকেশ আম্বানির জিও ফ্রি সিম কার্ড নেওয়ার নামে যথেচ্ছ ভাবে আধার কার্ড ব্যবহার করেছে। ব্যাঙ্ক, স্কুল কলেজ, পিএফ, লোন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান, জমি রেজিস্ট্রেশন, সহ সমস্ত সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করেছে বর্তমানে । কিন্তু এদিকে আধার কর্তৃপক্ষ বলছে এরকম কোনো নির্দেশ নেই।
তাহলে গত কয়েক বছরে এই প্রক্রিয়া কেন চলছে? কেন সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অবমাননা করা হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা বুঝলাম তা আরও ভয়ানক।
এনপিআর-এর প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল: আপনার বাবা ও মায়ের জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ কী? এই প্রশ্নটির উত্তর ছাড়া একটি মানুষের সম্পূর্ণ তথ্য আধার কার্ড এবং অন্যান্য আইডির লিঙ্কের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে এনপিআর। আধারের সাথে যুক্ত সমস্ত তথ্য কিন্তু চলে যাচ্ছে এনপিআর লিস্ট তৈরির প্রক্রিয়ায়। আগেই সরকার বলেছে এনপিআর আধার থেকে সব তথ্য নেবে এবং তা নিচ্ছেও।
এই প্রশ্নটির উত্তর KYC আপডেট-এর নামে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তথ্য লিঙ্ক করার মাধ্যমে জানা অসম্ভব নয়।
এখন আপনার-আমার সামনে সমস্যা দুটো :
এক) আধার কার্ড প্রক্রিয়া মানুষকে প্রযুক্তিগত (ডিজিট্যাল) ভাবে একটি রোবটের মতন নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। অর্থাৎ আপনার সমস্ত তথ্য সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং আপনার অজান্তেই আপনার উপর রাষ্ট্রীয় বা কর্পোরেট নজরদারি চলবে।
দুই) আপনার অজান্তেই আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা তৈরি করবে।এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল গত ১লা নভেম্বর ২০২০ তারিখে, দ্য ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকায় একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে: আসামের প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের বায়োমেট্রিক তথ্য বিজেপি সরকার ব্লক করে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ স্কুল-কলেজ ভর্তি, সরকারি সুযোগ সুবিধা, আর্থিক লেনদেন সহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেখানকার মানুষ। মানুষ নিজের ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারছেন না।
অর্থাৎ সামান্য একটি আধারের মাধ্যমে আপনার সমস্ত কিছু বন্ধ করা যাচ্ছে। এই কারণেই সরকার অঘোষিত ভাবে সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার কার্ড লিঙ্ক করার জন্য আপনাকে বাধ্য করছে, বিভিন্ন পরিষেবার নামে ।
যারা এই আধার কার্ড প্রক্রিয়াকে নিরীহ ভাবছেন, এনপিআর আলাদা করে হবে ভাবছেন তাদের অবিলম্বে চোখ খুলতে বলা হচ্ছে। তাঁদের উচিত এই মুহূর্তে এই আধার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া, নয়তো চোখের সামনেই এনপিআর আর এনআরসি হয়ে যাবে আর সবাই হতভম্ব হয়ে বসে থাকবে।