২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কনকনে শীতের দিল্লি শহর। কিন্তু সেই শীত উপেক্ষা করেও দিল্লী শহরের রাজপথে ছিলেন লক্ষ মানুষ। বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ। এই কনকনে শীতেও রাতে তাঁরা নববর্ষের পার্টি করছিলেন না। হৈ হুল্লোড়ে মত্ত ছিলেন না ৩১শে ডিসেম্বর রাতে। বরং সেই সময়ে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯) এর বিরুদ্ধে, জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) ও তার প্রথম ধাপ জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে দিল্লীর রাজপথ জুড়ে আন্দোলন করছিলেন মুসলিম মহিলারা। শাহীনবাগ আন্দোলন ছিল তার পীঠস্থান। ভারতবর্ষের নিঃশর্ত নাগরিক থাকার দাবিতে এই লড়াইয়ের স্লোগানে ও গানেই নতুন বছর ২০২০ কে বরণ করেছিল রাজধানী দিল্লী। তারপরে যমুনা দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেলেও আজ ঠিক এক বছর পরে, সেই দিল্লীর সীমানায় খোলা আকাশের নীচে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিদ্রোহের বহ্নিশিখা বুকে রেখে রাত জাগছেন তার উত্তাপে নতুন বছর কে স্বাগত জানাচ্ছে। আর তাঁদের সমবেত হুঙ্কারে ঘুম আসছে না তাঁদের থেকে অনেক মাইল দূরে, দিল্লী শহরের কেন্দ্রে—লুটয়েন দিল্লীর—বিলাসবহুল ঘরে, নিয়ন্ত্রিত তাপে বাস করা এক সত্তর বছরের বৃদ্ধ স্বৈরশাসকের আর তাঁর পঙ্গপালদের।
তীব্র শীতেও কী ভাবে উত্তাপ সৃষ্টি করে নিজেদের সংগ্রামের ইঞ্জিনে ইন্ধন দেওয়া যায় তা আজ দেশের কৃষকদের থেকে শেখা উচিত। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী-র নেতৃত্বে তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন পুনঃজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হল, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, তখন অনেকেই এটাকে ভবিতব্য মেনে হতাশ হয়ে গেছিলেন। দেশের জনগণ কে, যাঁদের মধ্যে মাত্র ২০ কোটি ভোটার বিজেপি কে ভোট দিয়েছিলেন, দোষারোপ করে নিজেদের ক্লীবতা ঢাকতে চেয়েছিলেন, তারাই কিন্তু ডিসেম্বর ২০২০ তে চোখ মেলে দেখলেন মানুষের মিছিল রাস্তা কাঁপাচ্ছে। যদিও নাগরিকত্ব আন্দোলনের মূল দাবিগুলো সেদিন বিজেপি কায়দা করে গুলিয়ে দিয়ে লড়াইটা শুধুই মুসলিম-কেন্দ্রিক রাখতে চেয়েছিল, তবুও সেই লড়াইয়ে ব্যাপক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। পুলিশী সন্ত্রাস মোকাবিলা করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। লড়াইয়ের নীতিনির্ধারক শক্তিগুলো ভুলভাল লাইন দিয়ে বিজেপি কে সমর্থন করলেও, লড়াকু মানুষেরা, বিশেষ করে মহিলারা কিন্তু লেগে-পড়ে থাকার নাম যে বিজয় তা দেখিয়েছিলেন। আজ সেই ধারাবাহিকতায়, নেতৃত্ব বেইমানি করার ধান্দায় ঘুরলেও, ব্যাপক কৃষকেরা কিন্তু দিল্লী শহরের সীমানা থেকে উঠবেন না এই ফয়সালা করেই এসেছেন।
চাপে পড়ে বাপ বলার মতন আজ মোদী কে বলতে হচ্ছে সে নাকি কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যেই বিতর্কিত নতুন কৃষি আইনগুলো এনেছে আর অত্যবশকীয় পণ্য আইন এর সংশোধনী করেছে। কৃষকরা নাকি কৃষকদের স্বার্থ বুঝতে পারছেন না তাই “ভুল বুঝে” তাঁরা আন্দোলন করছেন। মোদী ও বিজেপি কৃষকদের খালিস্তানি, মাওবাদী, ইত্যাদী আখ্যা দিয়ে আগে তাঁদের লড়াই কে সন্ত্রাসবাদ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। মোদীর একনিষ্ঠ সেনাপতি অমিত শাহ বারবার চেষ্টা করেছে যাতে কৃষক আন্দোলনে “ভাগ করো, শাসন করো” নীতি অনুসারে বিজেপির প্রতিপত্তি সৃষ্টি করা যায়। দালালদের সাহায্যে যাতে লড়াইকেই শেষ করে দেওয়া যায়। কিন্তু সজাগ কৃষকেরা সেই সাধে পানি ঢেলে দিয়েছেন। তাঁরা জানান দিয়েছেন তাঁদের দাবি পূর্ণ না হলে, অর্থাৎ দুটি বিতর্কিত কৃষি আইন —কৃষকদের উৎপাদনের ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার এবং সুবিধা) আইন, ২০২০, ও কৃষকদের (সশক্তকরণ ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও কৃষি পরিষেবা চুক্তি-র আইন, ২০২০—এবং অত্যবশকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০, বাতিল না হলে, কৃষিতে আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি না দিলে, তাঁরা কোন ভাবেই কোন আশ্বাসনে উঠে যাবেন না।
যেহেতু এনআরসি-এনপিআর নিয়ে, বিশেষ করে সিএএ ২০১৯ নিয়ে অনেক ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে তাই এই লড়াই কে, দিল্লীর শাহীন বাগ সহ নানা লড়াই কে খুব সহজেই বিজেপি “মুসলিম ইস্যু” বলে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এই বাজারে, যেখানে রান্নার গ্যাসের দাম আজ ৮০০ টাকা সিলিন্ডারে দাঁড়িয়েছে, আলু, পেয়াঁজ, ডাল, প্রভৃতির দাম আকাশ ছোঁয়া, আর রেশন ব্যবস্থা কে সংকুচিত করে দেওয়ায় ব্যাপক মানুষ রেশন তুলতে পারছেন না, সেই সময়ে কৃষিতে কর্পোরেটগুলো কে একচেটিয়া রাজত্ব চালাতে দিয়ে যে শুধু সরকার কৃষকদের ক্ষতি করছে তাই নয়, সাথে সাথে ব্যাপক সাধারণ মানুষ কে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির, কালোবাজারির শিকারও করছে। এ যাবৎকাল ক্ষেত থেকে বাজারে যেতে যেতে যদিও কৃষি পণ্যের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তো, তবুও কালোবাজারি করা অপরাধ ছিল এবং আইন কে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিতে হতো। এখন যেহেতু আইন করে কর্পোরেটদের কালোবাজারি করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে তাই ব্যাপক মানুষ বুঝছেন যে এটা কোন নির্দিষ্ট পেশার মানুষের, নির্দিষ্ট শ্রেণীর বা জাতির সমস্যা না, এটা গোটা দেশের সাধারণ মানুষের সমস্যা। তাই কৃষক আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের ঝড় উঠেছে।
এই ঝড় দেখে আজ শংকিত শাসক। লুটয়েন দিল্লীর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে তাই নিদ্রাহীন বৃদ্ধ স্বৈরশাসক রক্তচাপে ভোগে। কর্পোরেটদের নিমক খেয়েছে সে, তাই জান গেলেও কোনদিন কৃষকদের কথা সে শুনবে না। কিন্তু যদি কৃষকদের ট্রাক্টরগুলো আর শহরের সীমানায় না থেকে ভিতরে ঢুকে আসে? যদি তাঁর আদর্শ পুরুষের স্বপ্ন শহর জার্মানীকার মতন তাঁর পরিকল্পিত একটি নতুন রাজধানী গড়ার স্বপ্ন কে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় কৃষকের ক্ষোভ? যদি লাঙল দিয়ে সরকারটাই আগাছার মতন উপড়ে দেন কৃষকেরা? ভয়ে বৃদ্ধ ঘুমাতে পারে না। গলগল করে সে ঘামতে থাকে। ২০১৯ থেকে ২০২১, অনেক পানি বয়ে গেছে। নতুন বছরেই বৃদ্ধের সঙ্কট হাজারো গুণ বাড়বে আর কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের বিজয়ও। এই আশার কিরণ দেখি আমরা নতুন বছরের শুরুতে।