শনিবার, ২৩শে জানুয়ারী ২০২০ তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আসেন সুভাষ চন্দ্র বোস-এর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে তাঁর নামে শহরের মধ্যমণি ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল কে উৎসর্গ করতে। সেই সভায় মোদী-র সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) নেতা, কর্মী ও ভাড়াটে সৈনিকেরা যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী এই সরকারি অনুষ্ঠানে মাস্ক ছাড়াই, নিজের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মাবলী কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যোগ দেন। তাঁর সাথে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও যোগ দেন রাজ্য সরকারের তরফ থেকে। এই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বন্দোপাধ্যায় বক্তব্য রাখতে স্টেজে উঠতেই গোটা সমাবেশ জুড়ে ভিড় করে থাকা মোদী-র ভাড়াটে লোকেরা উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট যুদ্ধ নাদ “জয় শ্রী রাম” স্লোগান তোলা শুরু করে। মোদী ও তাঁর মোসাহেবরা চুপ করে বসে মজা দেখতে থাকেন এবং এর পরে বন্দোপাধ্যায় হঠাৎ করে হিন্দি ভাষায় জানান যে যেহেতু সরকারি একটি অনুষ্ঠানের কোন মর্যাদা রাখা হচ্ছে না, তাই তিনি কিছুই বলবেন না। তিনি নেমে আসলেও মোদীর ভাড়া করা লোকেরা “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিতে থাকেন।

এর পরে মোদী হিন্দি ও দুর্বোধ্য বাংলা মিশিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিলেও একবারের জন্যেও বন্দোপাধ্যায় কে বিজেপি-র লোকেদের দ্বারা উত্তক্ত করার বিরোধিতা করলেন না বা নিন্দা করলেন না। ফলে বুকের পাটা ফুলিয়ে সেই বিজেপি কর্মীরা, যাঁরা আজ হরিয়ানা, পাঞ্জাব আর রাজস্থানের গ্রামের থেকে কৃষকদের ভয়ে শহরে পালিয়ে আত্মগোপন করে আছেন, নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শন করতে সারাদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ময়দান এই “জয় শ্রী রাম” যুদ্ধনাদ কে তীব্র করে, ব্যাকফুটে যায় বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। এর মধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] আর কংগ্রেস এই ঘটনার জন্যে বিজেপি ও মোদী কে সমালোচনা করার জায়গায় চিৎকার করে বন্দোপাধ্যায়ের সমালোচনা করতে থাকে ও খিল্লির রাজনীতির আশ্রয় নেয়। তাঁদের কেউই কিন্তু কৃষি আইনের বিরোধিতা বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর (এনআরসি) পরিকল্পনার বিরোধিতা করে মোদী কে কালো পতাকা দেখালেন না।

প্রশ্ন উঠেছে বন্দোপাধ্যায়ের কি এই ভাবে প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত ছিল? তাঁর কি বক্তব্য না রেখে চলে আসা ঠিক হয়েছে? এই প্রশ্ন নিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে স্বভাবতই দুই ভাগ হয়েছে। বিজেপি দলের মধ্যেও হয়েছে। একদিকে রাজ্য বিজেপির কেষ্টবিস্টুরা, বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেল ইনচার্জ অমিত মালব্যিয়, প্রভৃতি বন্দোপাধ্যায় কে “জয় বাংলা” বলার জন্যে ও “জয় শ্রী রাম” শুনে ক্ষেপে যাওয়ার জন্যে যখন ভর্ৎসনা করছেন, ঠিক তখনই, অন্যদিকে শমীক ভট্টাচার্যের মতন নেতা এই ঘটনার নিন্দা করছেন। তৃণমূল কংগ্রেস স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি নিয়ে এই বিষয়ে মেপে মেপে চলছে। প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের মধ্যেও।

যদি আমরা এই ঘটনার বস্তুগত বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের আগে সুভাষ চন্দ্র বোস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবর্ণ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে বিজেপির পাল্লা ভারী করা। মোদী এই কারণে ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল কে সুভাষ চন্দ্রের নাম উৎসর্গ করতে আসেন। যদিও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতীক এই বৃহৎ ভবনটি বহু দশক ধরে কেন্দ্রের মালিকানাধীন, তবুও একবারের জন্যেও ২০১৪ সাল থেকে মোদী বা বিজেপি এই প্রসঙ্গে কোন কথা তোলেনি। হঠাৎ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই পদক্ষেপ নেওয়া যে ভোটের বাক্সে কামাল করার জন্যে সে কথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

যখন এই অনুষ্ঠানের পিছনে কী উদ্দেশ্য সেটা জলের মতন পরিষ্কার, তাহলে কেন বন্দোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার থেকে সেই কথা বুঝতে পারেননি? তিনি তো দীর্ঘ এক দশকের উপর বিজেপির সাথে ঘর করেছিলেন। তাহলে তাঁর বুঝতে অসুবিধা কোথায়? তিনি কি জানতেন না যে মোদী এই অনুষ্ঠান কে ব্যবহার করবেন নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে? তিনি কি বোঝেননি যে ভারত সরকার আর বিজেপির মধ্যে কোন সুক্ষ পার্থক্যও আর নেই? নাকি তিনি বিজেপির কাছে রাজনৈতিক শিষ্টাচার আশা করেন? আসলে ওই মঞ্চের থেকে মোদীর সমর্থকদের হিন্দিতে উত্তর দিয়েই তিনি নিজের দুর্বলতা ও বাঙালি জাতির রাজনৈতিক দৈনতা কে গুজরাটি-হিন্দিভাষী বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজির তল্পিবাহক বিজেপির সামনে উজাড় করে দিলেন। তিনি দেখিয়ে ফেললেন যে কী নিদারুন একটি ক্লীব জাতিতে বঙ্গবাসী পরিণত হয়েছে যে তাঁরা নিজের মাটিতে বহিরাগত একটি দাঙ্গাবাজ শক্তি কে পেশী আস্ফালন করতে দিয়ে মজা দেখছে।

আসলে বন্দোপাধ্যায়ের এই অনুষ্ঠানে না যেতে চাইলে কখনোই যেতেন না। তিনি কৃষি আইনের বিরোধিতা করেও এই সভা বয়কট করতে পারতেন, তাতে তাঁর পক্ষেই রাজনৈতিক সমর্থন জাগতো বাংলার বাইরে। তেমনি তিনি ওখানে গিয়ে, “জয় শ্রী রাম” যুদ্ধ নাদের হুঙ্কার শুনে না পালিয়ে গিয়ে পরিষ্কার বাংলায় কৃষি আইনের সমালোচনা করতে পারতেন আর বলতেন যে যেহেতু কৃষি আইন বাতিল হয়নি, যেহেতু দেশের যুবদের চাকরি হয়নি, যেহেতু শ্রম সংস্কার বন্ধ হয়নি, যেহেতু তাঁর সরকারের সমস্ত বকেয়া কেন্দ্র মিটিয়ে দেয়নি, তাই তিনি এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন না। বলতে পারতেন বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে যখন বিজেপি মজা করা শুরু করেছে তখন তিনি ওই সভাতে থাকবেন না। কিন্তু তিনি তা না করে মোদীর সামনে পলায়ন করে একটা সুযোগ করে দিলেন বিজেপি কে এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় কে নিজের দিকে টেনে নিতে।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সামনে এক বিরাট বিপদ। বিজেপি যদি এই রাজ্যে নির্বাচনে জিতে যায় তাহলে আর কোনদিন সেই দল নির্বাচনে হারবে না এবং রাজ্য সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে ২০২২ সালে ভারতবর্ষ কে সরকারি ভাবে একটি ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এতে গরিব মানুষের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কারণ তাঁদের বহু যুগের সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করা অধিকারগুলো কেড়ে নেবে রাষ্ট্র। এনআরসি-র ফলে নাগরিকত্ব হারাবেন কোটি কোটি আদিবাসী, দলিত ও শোষিত-নিপীড়িত মানুষ। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হলে মোদী আর বিজেপির অপরাধের, তাঁদের একের পর এক পাপের হিসাব জনতার সামনে তুলে ধরতেই হবে। তুলে ধরতেই হবে এনআরসি-র বিপদের কথা, কর্মহীনতার কথা, দুর্নীতির কথা, প্রভৃতি। তবেই গড়ে উঠবে জনমত হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla