এই কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে নানা ভাষণবাজির সাথে সাথে পূর্ব বর্ধমানে এক কৃষকের বাড়িতে পাত পেড়ে ভুঁড়িভোজ করলেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি জেপি নাড্ডা। বলা হচ্ছে কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ নাকি কৃষকদের প্রতি বিজেপির নির্ভেজাল ভালবাসার নিদর্শন হয়ে থাকলো। তবে এই তো প্রথম না। এর আগে বারবার কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ডানহাত অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এসে কৃষকদের ঘাড় ভেঙে তাঁদের বাড়িতে গাদা গাদা লোক নিয়ে গিয়ে খেয়েছেন আর সেই ছবি বারবার বিজেপি ব্যবহার করেছে রাজ্যে তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার কাহিনী দেখাতে।

দিল্লীর সীমান্তে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা উপেক্ষা করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড ও রাজস্থানের প্রায় ১০ লক্ষ কৃষক সেই ২৬শে নভেম্বর থেকে বসে আছেন অবস্থানে। তাঁরা আন্দোলন করছেন মোদী সরকারের দ্বারা সংসদে পাশ করানো তিনটি কৃষি সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে এবং তাঁদের দাবি এই আইনগুলি বাতিল করা হোক আর আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) কে যেন বাধ্যতামূলক করা হয় সারা দেশে। কিন্তু এই এতদিনে, প্রধানমন্ত্রী মোদী তো দূরের কথা, বিজেপি সভাপতি নাড্ডা বা অন্য নেতারা একবারও কৃষকদের খোঁজ নিতে যাননি।

যদিও বিজেপি নেতারা—পরিচালক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এর নির্দেশ অনুসারে—প্রচার করেছেন যে দিল্লীর সীমান্তে প্রতিবাদি-অবস্থানকারী কৃষকেরা নাকি আসলে কৃষকই নন আর তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কৃষক হলেও তাঁরা নাকি মোদীর দ্বারা প্রণয়ন করা কৃষি আইনের সুফল বুঝতে পারছেন না। তবে যদি কৃষকেরা ভুল বুঝে থাকেন, যদি তাঁরা মোদীর কর্পোরেট-প্রেমী কৃষি সংস্কারের সুফল বুঝতে অপারগ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের সেই ঠাণ্ডায়, ভুল চিন্তার মধ্যেই ফেলে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গে এসে কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ কি রাজনৈতিক ভাবে সঠিক বার্তা দিচ্ছে?

গ্রামে-গ্রামে গরিব কৃষকদের বাড়িতে জোর করে খাজনা আদায়ের মতন জোর করে দলবল নিয়ে গিয়ে পাত পেড়ে ভুঁড়িভোজ করা কি রাজনৈতিক ভাবে সমীচীন যখন বিজেপি-র মতে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের-নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে কৃষি ও কৃষকের অবস্থার নাকি অবনতি হয়েছে? দিল্লীর কৃষকদের থেকে শত যোজন দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা বিজেপি ও তার নেতৃত্ব কেন বাংলার কৃষকদের নিয়ে এত কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছেন? কেন কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ এক নতুন নিদর্শন হয়ে রইলো রাজনৈতিক নিকৃষ্টতার?

যখন কৃষকদের আন্দোলন কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির থেকে আড়াল করতে বিজেপি তার পেয়াদা সংবাদমাধ্যমগুলো কে বলেছে তাঁদের নাম করে অপবাদ ছড়াতে, তাঁদের সম্পর্কে জনমানসে ঘৃণা সৃষ্টি করতে, যখন মোদী সরকার সাফ বলে দিয়েছে কৃষকদের যে কর্পোরেটদের স্বার্থে আনা কৃষি সংস্কারগুলো কোন ভাবেই বাতিল করা যাবে না, তখন কেন পশ্চিমবঙ্গে এসে কৃষকদরদী সাজার চেষ্টা করছেন নাড্ডা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা? কেন পূর্ব বর্ধমানের এক গ্রামে এসে কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ রাজ্যের ব্রেকিং নিউজ হলো?

কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ যদি কৃষকদের প্রতি বিজেপির ভালবাসা দেখাবার একটা পদ্ধতি হয় তাহলে সেই পদ্ধতি দিল্লী শহরে কেন প্রয়োগ করা হচ্ছে না? পূর্ব বর্ধমানে যখন কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ নিয়ে রাজ্যের রাজনীতি তোলপাড় হচ্ছে, ঠিক তখনই হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর এর জনসভা ভণ্ডুল করে দেন সেখানকার কৃষকেরা। খট্টর কে হেলিকপ্টার অবধি তাড়া করে কৃষকেরা। রীতিমত ছুটে পালাতে হয় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী কে। এই যখন অবস্থা, তখন খট্টরের রাজ্যের কৃষকদের বাড়িতে খেতে যাচ্ছেন না কেন নাড্ডা? সেখানে তো সুযোগ আছে শুদ্ধ নিরামিষ খাওয়ারও!

পাঞ্জাব জুড়ে যে কৃষকেরা মোদী ও তাঁর মনিব রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক মুকেশ আম্বানি আর আদানি গোষ্ঠীর মালিক গৌতম আদানির কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন, তখন সেখানে গিয়ে কেন কৃষকের বাড়িতে খাচ্ছেন না নাড্ডা বা শাহ? এখন তো পাঞ্জাবে শীতে মকাইয়ের আটার রুটি আর সর্ষে শাঁকের সুস্বাদু আহারও পাবেন তাঁরা, শতভাগ নিরামিষ! তবুও বিজেপি নেতৃত্ব কেন পাঞ্জাবে যাচ্ছেন না? কেন তাঁরা কৃষকদের ভুল ভাঙাতে যাচ্ছেন না? যাচ্ছেন না তার কারণ গেলে কৃষকেরা তাঁদের বুঝিয়ে দেবেন কত ধানে কত চাল।

ঘুরে ফিরে আমিষাশী বাঙালি হিন্দু কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ নিরামিষ পদ দিয়ে এই রাজ্যে বিজেপি কে কি কোন ভাবেই জনপ্রিয় করতে পারে? ধর্মীয় মেরুকরণ ছাড়া যেহেতু এইবার বিজেপির কাছে আর কোন ইস্যু নেই আর অর্থনৈতিক ভাবে মোদীর সমস্ত সিদ্ধান্ত যে গরিব মানুষের মাজা ভেঙে দিয়েছে, তাই নাড্ডা থেকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ দিলীপ ঘোষ, সবাই বুঝছেন যে বিধানসভা নির্বাচন ঠিক ততটা জলভাত হবে না যেরকম তাঁরা আশা করে বসে আছেন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা যে এমএসপি-র সুযোগ পাননা, চালকল মালিক, ফোঁড়ে আর আড়ৎদারদের চক্রের হাতেই যে কৃষি পণ্যের বাজারজাত করার ব্যবস্থা কুক্ষিগত, রাজ্য সরকার যে রেশনের জন্যে ধান ও অন্য ফসল কেনার বরাদ্দ বৃদ্ধি করেনি বছরের পর বছর আর ফসল সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেলে যে হয়রানির শিকার হতে হয় কৃষকদের সেই সব নিয়ে কিন্তু নাড্ডা বা ঘোষের কোন বক্তব্য নেই। তাঁরা কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিজেপি সরকার কেন রেশনে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দিল, কেন আধারের মাধ্যমে রেশন ব্যবস্থা করে গরিব মানুষ কে ভাতে মারার বন্দোবস্ত করলো, এই সব নিয়ে কোন কথা খরচ করেননি।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে যদিও রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অনেক দেরিতে রাজনৈতিক ভাবে মাঠে নেমেছে, আর অন্য বিরোধী, সরকারি বাম আর কংগ্রেস জোট, এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি যে বিজেপি কে রুখবে না তৃণমূল বিরোধিতার ঘাড়ে চেপে নির্বাচন পার করবে, বিজেপির এই ন্যাক্কারজনক কৃষকদরদী প্রচার কে কিন্তু হালকা করে কেউই দেখছেন না কারণ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের ভোটেই ঠিক হয় কে নবান্নের মসনদে বসবে। বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত ভাবে পশ্চিমবঙ্গ কে পাখির চোখ করে মোদী সরকার আর বিজেপি যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে ২০২১ এর নির্বাচন যেনতেন প্রকারে জিততেই চায় গেরুয়া শিবির।

বাংলার কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ বা তাঁদের থেকে ভিক্ষা নিয়ে রাজনীতি করার নাটক দেখিয়ে নাড্ডাও বুঝে গেছেন বেশিদূর টানা যাবে না রথ কে। তাই বিজেপির শীঘ্রই একটা বড় আকারের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা দরকার। তাই উত্তরবঙ্গের নানা অঞ্চলে বিজেপি নেতৃত্ব আরএসএস কে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারের পারদ চড়াচ্ছে। তাই দক্ষিণবঙ্গের মতুয়া ও অন্য নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের অঞ্চলের মানুষ কে তাঁদের প্রতিবেশী মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু এই ঘৃণ্য কর্মকান্ড কে রুখতে না তো তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে কোন সত্যিকারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে আর না বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে বিজেপি-আরএসএস কে রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা করার কাজটা হচ্ছে না।

বাংলা কে বিজেপির হাত থেকে, আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা থেকে, মানুষের মধ্যে বিভেদ করার আর জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বানিয়ে মানুষকে বেনাগরিক, সস্তা শ্রমিক করে দেওয়ার চক্রান্তের থেকে বাঁচাতে এখন নির্বাচনী ঐক্য দিয়ে কাজ হবে না। দরকার হচ্ছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ সংগ্রামের যা বিজেপির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিগুলো কে এই রাজ্যে ভাঙবে, বিজেপির প্রতি তৃণমূল-বিদ্বেষ থেকে মোহগ্রস্ত হওয়া জনগণ কে রুটি-রুজি আর নাগরিকত্বের প্রশ্ন তুলে, বিজেপিতে তৃণমূল আর সিপিএম-কংগ্রেস থেকে বন্যার মতন ধেয়ে যাওয়া পালটি-খাওয়া নেতাদের প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হবে। এই সংগ্রামের, যা আসলে মাটি কামড়ে থেকে লড়তে হবে, ফলে সম্ভব হবে বিজেপির জয়রথের চাকা কে বাংলায় ভেঙে ফেলা আর কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ ও অন্য নেতাদের ভুঁড়িভোজ বন্ধ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বাকি সব পথ নির্বাচনী গোলকধাঁদার থেকে বেরিয়ে কোন সুস্পষ্ট পথ দেখাতে পারবে না।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla