ইন্দোনেশিয়ার কুখ্যাত সালেম গোষ্ঠীর আগ্রাসন থেকে নিজেদের জমি ও জীবিকা রক্ষা করতে ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত নন্দীগ্রামের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শাসকদল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] এর হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্র যন্ত্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালের ১৪ই মার্চ বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ কৃষকদের উপর গুলি চালায় নন্দীগ্রামে। সেইদিন গুলিতে ১৪জন গ্রামবাসী শহীদ হন আর তাঁদের রক্তে ভেজা নন্দীগ্রামের মাটি সমগ্র দেশে এক নয়া উত্তাল সৃষ্টি করে স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন বা এসইজেড বানাবার জন্যে জমি অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে। আর নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে তেমনি “মা, মাটি, মানুষ” স্লোগানের জন্ম দেয়। আজ সেই নন্দীগ্রাম, যেখানে সিপিআই(এম) এর হার্মাদ বাহিনীর “অপারেশন সূর্যোদয়” কে জনগণ সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে রুখে দেন, সেই জায়গায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) গেরুয়া হার্মাদ বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কি নতুন ঝড় উঠবে? মমতা আজ সেই নন্দীগ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী আর উল্টোদিকে তাঁরই এককালের সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী যিনি আজ বিজেপির কোলে দোল খাচ্ছেন। কী হবে নন্দীগ্রামের ফলাফল তার দিকে তাকিয়ে গোটা ভারতবর্ষ।
এটা সঠিক যে মমতার আমলে নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন কে শুধুই আনুষ্ঠানিক ভাবে নমঃ নমঃ করে স্মরণ করা হয়েছে, কৃষকদের আদতে কোন উন্নতি হয়নি, তবুও এই আমলে কৃষকের জমি তাঁদের থেকে শিল্পের নামে সিপিআই(এম) জমানার মতন কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জেতার পরেই কিন্তু একদিকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের তিনটি কৃষি আইনের সাহায্যে কৃষকদের দাদন প্রথার অন্তর্গত করে কর্পোরেটদের দাসে পরিণত করা হবে, লোকসানের দায়ে জমি বেচতে হবে, আর অন্যদিকে SWAMITVA স্কিমের মাধ্যমে তাঁদের বসত ভিটেও কব্জা করে তাঁদের গৃহহীন করে ফেলবে সরকার-কর্পোরেট-সামন্তপ্রভু জোট। তাই নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন কে পুনরায় পুরানো মেজাজে জাগিয়ে তুলে বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) কে ওই আন্দোলনের শহীদদের রক্তে ভেজা মাটিতে কবর দেওয়া আজ দরকার।
বর্তমানে কলকাতা, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর ও আসানসোল সফরে এসেছেন দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের একটি অংশ। তাঁরা কৃষকদের বোঝাচ্ছেন কেন তিনটি কৃষি আইন তাঁদের সর্বনাশ ডেকে আনবে আর বিজেপি জিতে গেলে কেন তাঁদের সামনে আর কোন পথ খোলা থাকবে না। কৃষি আইনগুলোর মাধ্যমে একদিকে সরকার কর্পোরেটদের কৃষিতে প্রবেশের অবাধ অধিকার আর কী চাষ হবে, কতটা ফলন হবে আর ফসল তোলার পরে কী ভাবে তা বাজারজাত হবে সেই অধিকার তো দিয়েছেই, তার সাথেই কৃষকদের থেকে আদালত থেকে ন্যায় চাওয়ার ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। অত্যবশকীয় পণ্য আইন, ১৯৫৫, সংশোধন করে বৃহৎ কর্পোরেটদের খাদ্য পণ্য নিয়ে কালোবাজারী করার বড় সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। এই কথাগুলো বারবার কৃষকদের কাছে আজ বলা প্রয়োজন যা মমতা বা তাঁর বিরোধী সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোট আজ জোরালো ভাবে প্রচারে আনছে না।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনই একমাত্র নির্বাচন যা নিয়ে বিজেপি গোটা দেশের মধ্যে আশাবাদী। তার কারণ এই রাজ্যে বিজেপি কে কার্যত প্রতিরোধ করার সদিচ্ছা না মমতা-র তৃণমূল কংগ্রেসের না বাম-কংগ্রেস জোটের আছে। বিজেপি যে ভাবে টাকার খেলা খেলে নির্বাচনে লড়ছে ও পাইকারি দরে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের কিনে ফেলছে, তার মুখে অসংগঠিত তৃণমূল কংগ্রেস বা দুর্বল সিপিআই(এম) প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো দূরে থাক ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে অপারগ। পাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রুষ্ট হন।
নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন এর শহীদ দিবস কে উপলক্ষ করে আজ প্রস্তুতি চালানো উচিত নন্দীগ্রাম ও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জাগ্রত করে, সাধারণ মানুষ কে সাথে নিয়ে, এই নয়া জঘন্য কৃষক-মারা কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবি তুলে, আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) তে কৃষকদের থেকে সমস্ত কৃষি পণ্য কেনার দাবি তুলে, বিজেপি ও আরএসএস-র বিরুদ্ধে এক নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। এমন এক আন্দোলন যা হাড় হিম করে দেবে মোদী সরকার ও তার তল্পীবাহকদের। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, প্রভৃতি রাজ্য পথ দেখাচ্ছে কী ভাবে বিজেপি ও আরএসএস কে গ্রাম স্তর থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে উচ্ছেদ করতে হয়।
আজ ১৪ই মার্চ ২০২১ এ, ১৪ বছর আগের ১৪ জন শহীদের রক্তে রাঙা নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন এর মাটি থেকে নতুন এক কৃষক আন্দোলন গোটা পশ্চিমবঙ্গে ছেয়ে যাক। যে কৃষকদের দিল্লীতে দেখতে চাননা মোদী আর বিজেপি নেতারা, আজ যেন সেই কৃষকদেরই বিজেপি কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করতে এগিয়ে নিয়ে আসা হয় ও দাবি তোলা হয় তিনটি কৃষি আইন বাতিলের ও এমএসপি-র আইনী স্বীকৃতির। রাজনীতিতে কৃষকদের প্রাধান্য দিলে, নন্দীগ্রাম কৃষক আন্দোলন যে ভূমিতে জন্মেছিল সেখানে বিজেপির ইন্দ্রপতন হবেই। রাজনীতিতে তাঁরা যদি অগ্রগামী হতে পারেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে “আসল পরিবর্তন” আনবেন কৃষকরাই।