অর্ণব গোস্বামী পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন নিজের দোকান খুলতে। এই নির্বাচনী মরশুমে তিনিও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছেন তাঁর মালিক নরেন্দ্র মোদী সাহেবের ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) হয়ে। তাই রিপাবলিক বাংলা চ্যানেলটির পত্তন করেই শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা কে আরও সুদক্ষ ভাবে চালিয়ে, অমুসলিম জনগণ কে ইসলামবিদ্বেষের বিষাক্ত অপপ্রচার দিয়ে তাঁতিয়ে, বিজেপির পালে হাওয়া লাগানোর চেষ্টা। ঠিক কিছুদিন আগেই অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা তার পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা শুরু করলো এমন একটি মনগড়া কাহিনী দিয়ে যা কোন চূড়ান্ত ভাবে ফ্লপ হয়ে যাওয়া বোম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমার পরিচালকও কোনদিন ব্যবহার করবে না।
যে মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের মূল ইস্যু হিসাবে তোলা হচ্ছে বেকার যুবদের কর্মসংস্থানের কথা, তোলা হচ্ছে কৃষকদের দুরবস্থার কথা, তোলা হচ্ছে চরম দুর্নীতির কথা, তোলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা আর তোলা হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকটের কথা, যার ফলে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ও মোদীর বিজেপি, সেই সময়েই হঠাৎ চাকরী, কৃষি সংকট, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতন বিষয় থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা নিয়ে আসলো সাত বছর পুরানো খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কান্ড, যা তৎকালীন সময়ে চূড়ান্ত রকমের ইসলামবিদ্বেষ ছড়াবার কাজে এসেছিল।
একটি ভিডিও ক্লিপ, যাতে দেখা যাচ্ছে যে একদল মুখঢাকা, কালো ট্র্যাকস্যুট পড়ে, কোমরে মার্শাল আর্টের বেল্ট বাঁধা লোক সাবধান-বিশ্রাম করছে আর কেউ হাতে করে একটি খেলনার গ্রেনেড তাঁদের দেখাচ্ছে। আর এর সাথে দেখা গেল পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের একটি ভিডিও যাতে বাংলাদেশী টানে একজন কে দেখা গেল কোন ঘটনার বিবরণ দিতে যা পুলিশ বারবার কায়দা করে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি অনড় হয়ে সেই প্রয়াস কে রুখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই ক্লিপগুলো দেখিয়ে অর্ণব গোস্বামী তাঁর রিপাবলিক বাংলা চ্যানেলে বললেন যে পশ্চিমবঙ্গের নিরীহ মানুষের উপর নাকি জেহাদী সন্ত্রাসের ছায়া ঘুরছে। সাত বছর আগের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ভূত কে জ্যান্ত করা হল।
এই খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনাটি মোদী জমানায় পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বড় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আমলে মুসলিম-তোষণ ও বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কাল্পনিক গরু কে তাল গাছের মাথায় তোলার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল ও তার ফলে বিজেপি চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেছিল রাজ্যের হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে। কর্পোরেট-মালিকানাধীন বৃহৎ মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোও এই খেলায় বিজেপি কে সমর্থন করেছে আগাগোড়া, ফলে মানুষ কে প্রতিদিন অল্প করে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। এর ফলেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ আকারে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চালাবার কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। বঙ্গে অমুসলিমরা “আতঙ্কে” আছে বলে যে গল্প দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে, সেই গল্পটি বিজেপি-র আইটি সেলের দৌরত্বে রাজ্যের প্রতি কোনে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরও তীব্র করা সম্ভব হয়।
বর্তমানে রাজ্যের কৃষিজীবীরা চরম সঙ্কটে আছেন কারণ তাঁরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না পশ্চিমবঙ্গে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ভাবে ফসল ক্রয়ের কোন ব্যবস্থা না থাকার ফলে। চরম লোকসানে তাঁদের বেশির ভাগ ফসল বেচতে হয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা তাকিয়ে আছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের দিকে, যাঁরা বর্তমানে এমএসপি কে আইনী গ্যারান্টি দেওয়ার জন্যে সংগ্রাম করছেন। বর্তমানে আলু চাষিরা গত বছরের ভাল দাম দেখে চরম হারে আলুর ফলন করিয়েও গাড়ি পিছু বেশি দাম পাচ্ছেন না। এই আলু চাষিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কিন্তু অমুসলিম, পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চিত কৃষকদের অধিকাংশও কিন্তু অমুসলিম, তবুও এদের কষ্ট নিয়ে কেন হিন্দু হৃদয় সম্রাটের পদলেহী টিভি চ্যানেলের মাথা ব্যাথা নেই?
অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা কোন ভাবেই কৃষকদের সমস্যা কে দেখাবে না কারণ বঙ্গের কৃষকদের সমস্যাগুলো মানুষ জেনে ফেললে মোদী সাহেবের মালিক গৌতম আদানি আর মুকেশ আম্বানিদের স্বার্থে পাশ করানো কৃষক-বিরোধী কৃষি আইনগুলোর বিরোধিতা বঙ্গেও তীব্র হবে আর তার সাথে কৃষকেরা যদি এমএসপি-র আইনী দাবি করে তাহলে অবস্থা আরও সঙ্গীন হবে বিজেপির। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের আমলে কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠলেও বিজেপির আমলে যে তাঁদের অবস্থা কোথাও ভাল নেই, সেই কথা খুব ভাল করে বুঝতেন কৃষকেরা। অতএব কৃষকদের সমস্যা নিয়ে রিপাবলিক বাংলা চুপ।
পশ্চিমবঙ্গের কর্মহীন যুবদের চাকরির দাবি দীর্ঘদিনের। টেট পরীক্ষা নিয়ে গরমিল ও নিয়োগে দুর্নীতি, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরির আকাল, প্রভৃতি নিয়েও অর্ণব গোস্বামী-র রিপাবলিক বাংলা কেন টু শব্দ করলো না? অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা এই জন্যে চুপ কারণ এই ধরণের আলোচনা করলে গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকে ভারতের বেকারত্বের হার যে গত চার দশকের সর্বাধিক হয়ে উর্দ্ধেই ছুটে চলেছে সেই কথাও দর্শকদের জানাতে হবে। এটাও জানাতে হবে যে যেমন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আমলে রাজ্যে সরকারি চাকরির দেখা পাওয়া দুস্কর হয়ে গেছে তেমনিই মোদীর আমলে শুধু যে কেন্দ্রীয় সরকারের অসামরিক পদগুলিতে নিয়োগ করা বন্ধ হয়ে গেছে তাই নয়, বরং নানা মন্ত্রকে ও বিভাগে, রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন সংস্থাগুলোয় ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই চলেছে। বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে সমস্ত বড় রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর আর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, হিন্দুস্থান কেবলস, প্রভৃতি সংস্থা কে। খবরে প্রকাশ যে এর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন অসামরিক চাকরি আর থাকবে না।
এই মুহূর্তে মোদী কি পশ্চিমবঙ্গের কর্মহীন যুবদের সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেবেন? কেন বিজেপি প্রথমে কর্মহীন যুবদের কার্ড দিয়ে সমীক্ষা করা হবে বলেও পরে পিছিয়ে এল? কেন পশ্চিমবঙ্গের কর্মহীন যুবদের বিজেপি গ্যারান্টি দিচ্ছে না চাকরির? তার কারণ মোদী আর বিজেপির উন্নয়নের মডেলে সাধারণ বাড়ির, খেটে-খাওয়া মানুষের পরিবারের যুবদের সরকারি চাকরি হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। শুধু সরকারি চাকরি কেন, এমন কী বেসরকারি সংস্থায় কোন স্থায়ী চাকরির সুযোগও থাকে না কারণ ইতিমধ্যে শ্রম আইন সংস্কার করে মোদী সরকার চুক্তির ভিত্তিতে সকল চাকরিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করে ফেলেছে। খবরে প্রকাশ যে নির্বাচন শেষ হলেই চারটি নতুন শ্রম কোড আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করবে কেন্দ্রীয় সরকার।
ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে যে দুর্নীতিগুলো তৃণমূল কংগ্রেসের দশ বছরের শাসনকালে হয়েছে তার কী বিহিত করবে বিজেপি সেই কথা কেন অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা আলোচনা করতে পারে না? তার কারণ সেই দুর্নীতির সমস্ত পান্ডারা আজ দল বদল করে বিজেপির পতাকাতলে এসে জড় হয়েছে। কোন দুর্নীতিগ্রস্ত বা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নেতা তৃণমূলে আছে আর কে কখন বিজেপিতে চলে গিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হচ্ছে তার কোন হিসাব রাখা মুশকিল। বন্দোপাধ্যায় কে বাদ দিলে যে তৃণমূলের কোন স্থায়ী মুখ নেই, কোন স্থায়ী কর্মী নেই আর স্থায়ী জনপ্রতিনিধি নেই সেই কথা কিন্তু আলোচনা করলে বিজেপিরই বিপদ বেশি।
গোস্বামীর হাত ধরে রিপাবলিক চ্যানেলের জন্ম হয়েছিল বিজেপির হয়ে প্রচার করার জন্যে। উগ্র-হিন্দুত্ববাদ কে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের ড্রয়িং রুমে চিরস্থায়ী করতে। সেই কাজে গত কয়েক বছরে বেশ সফলতা অর্জন করেছে চ্যানেলটি। চূড়ান্ত নির্লজ্জের মতন বিজেপির মুখপত্র হিসাবে কাজ করে দেশের আপামর গরিব, শ্রমজীবী ও খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে আর বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি এবং তার ভারতীয় মুৎসুদ্দি দালাল পুঁজির স্বার্থে কাজ করেছে রিপাবলিক আর অর্ণব গোস্বামী। মোদী কে ২০১৯ এ পুননির্বাচিত করার পিছনে যে সমস্ত মিডিয়া সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ মদদ ছিল তার মধ্যে রিপাবলিক অন্যতম।
অর্ণব গোস্বামী কে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার মামলায় গ্রেফতার করলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা ছোটাছুটি করে তাঁকে জামিন দেন। সেই দেশেই সিদ্দিক কাপ্পান নামক একটি মালায়ালম ভাষার সাংবাদিক মিথ্যা মামলায় আটক থাকে দীর্ঘ দিন উত্তরপ্রদেশের জেলে। তার দোষ তিনি মুসলিম হয়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে খবর সংগ্রহের কাজে গেছিলেন। সেই দেশে প্রশান্ত কানোজিয়া থেকে শুরু করে মনদীপ পুনিয়ারা পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হন খবর করতে গিয়ে। যে দেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার মান আন্তর্জাতিক স্তরে পড়তে পড়তে আজ ১৪২ এ এসে ঠেকেছে।
তবুও সেই দেশে অর্ণব গোস্বামীর কোন চিন্তা নেই কারণ তিনি সাংবাদিক না, তাঁর কাজ বিজেপির ভেঁপু বাজানো। তাই যদিও তাঁর হোয়াটস্যাপ চ্যাটের ইতিহাস দেখায় তিনি ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এর পুলওয়ামা জঙ্গী হামলার খবরে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে এই হামলা মোদী কে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন জিততে সাহায্য করবে, তিনি আগেই জানতেন যে বালাকোট “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” করার পরিকল্পনা করেছে মোদী সরকার, তবুও তাঁর উপর এই ভাবে সরকারি গোপন তথ্য জেনে যাওয়া ও তা প্রচার করা নিয়ে কোন মোকাদ্দমা হয় না।
এহেন অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত মানুষের মন যে বিষিয়ে দিতে এসেছে সেই কথা আলাদা করে বলার দরকার রাখে না। তবে যেহেতু অর্ণব গোস্বামীদের পিছনে বৃহৎ পুঁজির হাত আছে আর মোদী সরকারের অভয় আছে তাই তিনি যে কোন আইনের উর্দ্ধে। ভারতবর্ষের কোন সরকারি সংস্থা বা আদালত তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তবে তার মানে এই নয় যে রিপাবলিক বাংলা দ্বারা প্রচারিত সকল সাম্প্রদায়িক, উগ্র জাতিবিদ্বেষী প্রচারের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন কথা বলবে না।
যে ভাবে দিল্লীর কৃষক আন্দোলন আজ রিপাবলিক সহ সমস্ত মোদী সরকারের তাঁবেদার প্রচার মাধ্যমের, যাদের বলা হয় ‘গোদী মিডিয়া’, বয়কট করেছেন, তাঁদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ করেছেন ঠিক সেই ভাবেই আজ পশ্চিমবঙ্গে এমএসপি-র আইন পাশের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলছেন যে কৃষকেরা, বন্ধ জুটমিল খোলার দাবিতে যে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন, শিক্ষকের চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে যে টেট-উত্তীর্ণ যুবরা লড়ছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের যে শিক্ষকেরা সংগ্রাম করছেন ও ব্যাঙ্ক, বীমা, রেল, বিএসএনএল, প্রভৃতি বেসরকারিকরণ করে জনগণের সম্পদ বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে যে কর্মচারীরা সংগ্রাম করছেন, তাঁদের আজ কোন মোহ না রেখেই অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক বাংলা কে বর্জন করতে হবে। একমাত্র জনগণের দ্বারা বর্জিত হলেই, আপামর মানুষের দ্বারা নিন্দিত হলেই রিপাবলিক বাংলার পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কে সুবিধা করে দেওয়ার চক্রান্ত ধ্বংস হবে আর রাজ্যে হিংসা ছড়াবার গেরুয়া শিবিরের চক্রান্তও ধ্বংস হবে।