বহু উৎকণ্ঠা আর যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে যখন ২রা মে ২০২১ এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হল তখন শুধু রাজ্য জুড়েই নয় সমগ্র দেশজুড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের নাকে ঝামা ঘষা হয়েছে বলে উল্লাস শুরু হয় ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মহলে। দেশের তাবড় তাবড় বিরোধী নেতারা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পুনরায় শপথ নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দেন। অন্যদিকে বিলুপ্ত প্রজাতির রাজ্য বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস কে দোসর করে মোদী-র ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কে নাকচ করতে হিংসার অজুহাত তুলে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলে জলঘোলা করা শুরু করলো।  

এই অবস্থায়, বিশেষ করে যখন করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে আর মানুষের মৃত্যু মিছিল চলছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণে, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির করণীয় কী? তারা কি বামফ্রন্ট-কংগ্রেস-বিজেপি জোটের মতন উগ্র তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতা করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন, অর্থাৎ মোদী আর তাঁর দোসরদের শাসন চাইবেন না আবার বন্দোপাধ্যায়ের ঝান্ডা ধরে বিজেপি বিরোধিতা করবেন? কী করা তাঁদের উচিত? 

আসলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফল দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের হার, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়ে প্রাপ্ত ৪০.৬৪% থেকে কমে ৩৮.১৩% হলেও, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেতা তিনটি আসন থেকে পূর্বতন বিধানসভার শেষ লগ্ন পর্যন্ত কেনা-বেচা করে বিধায়ক সংখ্যা ৩০ এর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া বিজেপি কিন্তু এই বার ৭৭টি আসন নিজে জিতেছে। যা এক ধরণের অশনী সঙ্কেত দেখাচ্ছে। বিজেপি-র ভোট কিন্তু তেমন কিছু কম হয়নি। আর এই তালে “হিন্দুরা আক্রান্ত” এই আওয়াজ তুলে গোটা রাজ্যে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা কে সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করবে আগামী দিনগুলোয়।

যদিও বিজেপি-বিরোধী ভোটের মেরুকরণের ফলে বিজেপি কে রাজ্যে হারতে হয়েছে তবে এত সহজে পশ্চিমবঙ্গ কে মোদী আর শাহ ছেড়ে দেবেন না। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিজেপি। তার আগেও মোদী সরকার চেষ্টা করবে তদন্তকারী সংস্থাগুলো কে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কদের ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভন দিয়ে মধ্যপ্রদেশ মডেল অনুসরণ করে রাজ্যে সরকার গড়ার। তাই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিজেপি-র মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়েছে এই রকম চিন্তা করা বাতুলতা।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখাচ্ছে যে রাজ্যের জনগণের মধ্যে মেরুকরণ হয়েছে বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কে বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে জনগণ বিজেপি-র বিরোধী হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস কেই নির্বাচিত করেছেন এবং বামফ্রন্ট, কংগ্রেস আর ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট (আইএসএফ) এর সংযুক্ত মোর্চা কে ভরসা করেননি। তবে তুমুল ভাবে বিজেপি বিরোধী এই হাওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস নিজের দুর্গ ধরে রাখতে পারলেও আগামী দিনে কিন্তু রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি আর তার পিতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়াতে পারবে দুইটি মূল কারণে।  

প্রথমতঃ বিজেপি কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধী হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে। সংযুক্ত মোর্চা ভাঙ্গর ছাড়া সব জায়গায় তৃতীয় হয়েছে। তার মানে এই রাজ্যের মানুষের কাছে কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপি বেশি প্রিয়। যার মানে আগামী দিনে যদি রাজ্যে যদি জনগণের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মেজাজ যদি তুঙ্গে ওঠে ও তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচার, দুর্নীতি, প্রভৃতির বিরুদ্ধে যদি তাঁরা লড়াই করতে চান তাহলে কিন্তু তাঁদের কাছে বিজেপি বাদে কোন বিকল্প শক্তি থাকবে না। ঠিক যেমন ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ধুয়ে-মুছে গেলেও তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে বন্দোপাধ্যায় তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস কে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন তাই জন্যেই তিনি কিন্তু সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, যেখানে বামপন্থী সংগঠনগুলো জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলছিলেন, গিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব হাইজ্যাক করে নিতে পারেন অনায়াসেই। তাই বর্তমানে বিজেপি প্রধান বিরোধী থাকলে তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত আন্দোলনে কিন্তু বিজেপি নেপোয় মারে দই করবে।

দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখাচ্ছে যে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ কে রোখা গেছে অনেক জায়গায়। তবে বিজেপির আতঙ্কে মুসলিম ভোটের পুরোটাই পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। আইএসএফ বা আব্বাস সিদ্দিকীর প্রভাব ব্যবহার করে পীরপন্থী বা অন্য মুসলিমদের সমর্থন সেই ভাবে পায়নি সংযুক্ত মোর্চা। আর মুসলিম ভোটের এই মেরুকরণ দেখাচ্ছে যে সংখ্যালঘু ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই সম্প্রদায়ের কাছে কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কালাপাহাড় কে প্রতিরোধ করার আর কোন বিকল্প নেই। ফলে তাঁদের বাধ্য হয়েই তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি, অত্যাচার, শোষণ সহ্য করেই বিজেপি কে রুখতে তৃণমূল কংগ্রেস কে ভোট দিতে হয়েছে। রাজ্যের মুসলিমদের এই দুরবস্থা কিন্তু দেখাচ্ছে যে বন্দোপাধ্যায় কিন্তু নিজের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক কে অটুট রাখতে একদিকে বিজেপি আর আরএসএস কে প্রশ্রয় দেবেন এই রাজ্যে, তেমনি মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব থেকে অধিকারগুলো কে অনায়াসে খর্ব করবেন, তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করবেন।

উপরোক্ত দুইটি বিষয় কিন্তু রাজ্যের রাজনীতিতে বিজেপি, ও তার দৌলতে আরএসএস কে, বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বিজেপি-বিরোধী ভোটে জয়ী হয়েছে। অথচ, বাংলার মাটিতে নিজের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে এই তৃণমূল কংগ্রেসেরই তাই দরকার বিজেপি আর আরএসএস কে। যেমন পাকিস্তান আর মুসলিম জূজূ দেখিয়ে আপামর হিন্দু জনগণের ভোট আর রাজনৈতিক বশ্যতা আদায় করে বিজেপি আর আরএসএস, তেমনি আবার এই হিন্দুত্ববাদী শক্তির জূজূ দেখিয়ে মুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষ বঙ্গবাসী জনগণের ভোট ও বশ্যতা আদায় করতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে সাধারণ মুসলিমদের জন্যে যদি বন্দোপাধ্যায় কিছু নাও করেন তবুও তাঁদের বাধ্য হয়েই তৃণমূল কংগ্রেস কে সমর্থন করে যেতে হবে বেঁচে থাকার তাগিদে।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে যদি কোন প্রগতিশীল ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ব্যক্তি বা সংগঠন মনে করে যে রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা গেছে তাহলে তিনি কিন্তু মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। রাজ্যে বিজেপি আর আরএসএস এখনো জমি ধরে রেখেছে আর এই প্রথম রাজ্য বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠছে। এর ফলে আগামী দিনে যদি প্রগতিশীল ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী, সংগ্রামী বামপন্থী শক্তি কে রাজ্যের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকতে হয় তাহলে তাদের লড়তে হবে প্রধান বিরোধী হওয়ার জন্যে। এর জন্যে যেমন একদিকে বিজেপি ও আরএসএস কে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ভাবে রাজ্য থেকে উপড়ে ফেলতে হবে তেমনি তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচার, দুর্নীতি, প্রভৃতির বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে জনগণের সামনে একটা ভরসাযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে হবে। তা না করে শুধু বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনা করে গেলে কিন্তু আগামী দিনেও রাজনৈতিক ভাবে জমি তৈরী করা যাবে না।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla