ভারত কিছুদিন আগেই জি – ৭ বৈঠকে “মুক্ত ও স্বাধীন” সমাজ গড়ার অঙ্গীকারে সাক্ষর করেছে। যদিও তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ, আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভদেকার, বা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ কেউই ভাবিত নন। তাই অনায়াসে গাজিয়াবাদ পুলিশ মামলা রুজু করে সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম কোম্পানি টুইটারের বিরুদ্ধে। ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে এই হল সব চেয়ে ওয়াও ওয়াও মুহূর্ত।
একজন ৭১ বছর বয়সী মুসলিম বৃদ্ধকে উত্তর প্রদেশের লোনিতে মারধর করার অভিযোগ করা হয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে। সেই বৃদ্ধ, আব্দুল সামাদ সৈফির আক্রান্ত হওয়ার বিবরণের ভিডিও ও অপরাধের ভিডিওটি সাংবাদিক রানা আইয়ুব, মোহাম্মদ জুবাইর, কংগ্রেসের কিছু নেতারা নিজেদের টুইটার একাউন্টে শেয়ার করেন। চাপে পড়ে বিজেপি নিজের দলদাস পুলিশ কে কাজে লাগায় অভিযুক্তদের আড়াল করে নিপীড়িত মানুষটি কে দোষী হিসাবে সাব্যস্ত করতে। গাজিয়াবাদ পুলিশ তাই ঘোষণা করে, সামাদের উপর হামলা সাম্প্রদায়িক কোন অপরাধ ননয় কারণ তাতে নাকি কিছু মুসলিমও জড়িত। এই খেলার মাঝে আইয়ুব, জুবাইর, কংগ্রেস কিছু নেতাদের, সংবাদ সংস্থা দ্যা ওয়্যার ও টুইটারের বিরুদ্ধে গাজিয়াবাদ পুলিশ মামলা করে।
উত্তর প্রদেশে এই প্রথম কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের উপর আক্রমণ হয়নি। এর আগেও, মিড-ডে মিলে নুন আর রুটি দেওয়া হচ্ছে রিপোর্ট করার জন্যে গ্রেফতার হয়েছেন সাংবাদিক পবন জয়সওয়াল, গ্রেফতার হয়েছেন প্রশান্ত কানোজিয়া, হাথরাস গণধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের রিপোর্টিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে মাসের পর মাস অত্যাচারিত হয়েছেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। এর আগেও মানুষের উপর পুলিশী নির্যাতনের জন্যে দেশের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে যোগীর উত্তর প্রদেশ।
যদিও বিশ্বের স্বাধীন সাংবাদিকতার নিরিখে ভারতের স্থান ক্রমাগত নিম্নগামী তাতেও মোদী সরকারের কিছু যায় আসে না। কারণ বিজেপি যতদিন ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে ভোটে জিততে পারবে, ততদিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পরিসর ভারতে সংকুচিত হবে, একনায়কতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাই মোদী সরকারের অধীনে ভারত কে একটি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আর তাই বিদেশে জি-৭ এর বৈঠকে ভারত স্বাধীন আর মুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করলেও মোদী তার সাথে শর্ত জুড়ে দেন যে স্বাধীনতার ফাঁক দিয়ে নাকি মিথ্যা খবর প্রচার করে সমাজে অশান্তি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ টুইটার সহ সমস্ত সামাজিক মাধ্যম কে নিয়ন্ত্রণ করা, সংবাদমাধ্যম কে দমন করা, সাংবাদিকদের জেলবন্দী করার জন্যে রাস্তা প্রশস্ত করে নেন।
গণতন্ত্র কে করোনা ভাইরাসের ভয় দেখিয়ে যেমন গায়েব করে দেওয়া হয়েছে, রোগ প্রতিরোধের নামে সহজেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, দেশজোড়া আর প্রাদেশিক-আঞ্চলিক স্তরে লকডাউন করে জনতার পেটের ভাত মারা হয়েছে, জাতীয় বিপর্যয় আইন প্রয়োগ করে আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সেখানে গাজিয়াবাদ পুলিশ মামলা করে যে বিজেপি সরকারের সমালোচকদের দমন করতে চাইবে সেই কথা কি অবাক করে?
অথচ এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা যে জনগণের আন্দোলনের তা মেনে নিয়েও কোন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, এমনকি বামপন্থীরাও কোন আন্দোলন রাস্তায় গড়ে তুলছেন না। সাধারণ মানুষ কে এই গণতন্ত্র বিরোধী, ফ্যাসিবাদী, গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা সরকার কে উচ্ছেদ করার ডাক দিয়ে রাস্তায় তাঁরা সমবেত হচ্ছেন না। এর কারণ তাঁদেরও হয় টিকি শাসকশ্রেণীর খুঁটিতে বাঁধা আর না হয় তাঁরা এখনো সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করতে পারেনি। যতদিন পর্যন্ত না বিজেপি – বিরোধী শক্তি জনগণ কে রাস্তায় নামাতে পারবেন, রাষ্ট্রের দমন ও পীড়ন সহ্য করে সংগ্রাম গড়তে পারবেন মোদী ও যোগীর মতন ফ্যাসীবাদীদের সিংহাসন থেকে নামাবার, ততদিন গাজিয়াবাদ পুলিশ মামলা করবে, উত্তর প্রদেশ পুলিশ মামলা করবে, ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র দমন করবে ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের, সংবাদ মাধ্যম কে।