ফুটবে কি ফুটবে না সেই বিতর্কে জল ঢেলে সন্ধ্যার আগে গোয়ালের গরু গোয়ালে ফিরে, তৃণমূল কংগ্রেসের ডালে মুকুল রায় পরিস্ফুটিত হয়ে জানান দিলেন যে দিকে ক্ষমতার ভার, সেই দিকেই ঝোঁকেন তিনি। আপাতত ঘরের ছেলে মুকুল “দুষ্টু লোকেদের” নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে ঘরে ফিরে আসায় তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে খুশির হাওয়া। তবে মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন কিন্তু রাজ্য রাজনীতির এক জঘন্য দিক উন্মোচন করলো, দেখালো কী ভাবে সংসদীয় সব দলই কত সহজে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে স্বাভাবিক করে নেন। কী তাড়াতাড়ি তাঁরা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সাথে বিছানা সঙ্গী হতে পারেন আর কী সহজে আবার সেই দাগ না মিটিয়েই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছেড়ে অন্য দলেও যোগ দেন।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন যে বেইমানদের মধ্যেও ভাগ করতে হবে। যাঁরা দল ছেড়ে গিয়ে কদর্য ভাবে দল কে (পড়ুন তাঁকে) অপমান করেছে, তাঁদের তিনি চরমপন্থী বলে আখ্যা দিয়ে জানালেন যে তাঁদের জন্যে তৃণমূল কংগ্রেসের দরজা বন্ধ। অন্যদিকে যাঁরা সেই কাজ করেননি, শুধু চুপচাপ বিজেপি করেছেন, তাঁদের তিনি নরমপন্থী বলে আখ্যা দেন ও জানান তাঁর দরজা খোলা আছে। তিনি জানান দিলেন যে মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ রায় কখনোই বিজেপির ভিতরে থেকে তৃণমূল কংগ্রেস কে (পড়ুন মমতা কে) গালাগালি করেননি। কিন্তু সেই কথা কি সত্যি?

তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেই প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে রায় বলেন বন্দোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস কে একটা রাজনৈতিক দল না, বরং একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে চালাচ্ছেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যখন চরম হিংসা ছড়াচ্ছিল রাজ্যে বিজেপির ভাড়াটে হার্মাদ বাহিনী আর তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডারা, তখন রায় বলেন যে বন্দোপাধ্যায় রাজ্যে “গণতন্ত্র কে ধর্ষণ করেছেন”। এর সাথেই বারবার মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে।

মার্চ ২০১৮ তে রাম নবমীর সশস্ত্র মিছিল দিয়ে রাজ্যে নানা কোনে মুসলিম বিরোধী হিংসায় ইন্ধন যোগান রায়। উত্তর ২৪ পরগনায় নিজে সশস্ত্র মিছিলে যোগ দেন ও সশস্ত্র মিছিলের পক্ষে ওকালতি করেন। আসানসোল, রানীগঞ্জ, পুরুলিয়া ও অন্যান্য জায়গায় রাম নবমীর মিছিল দিয়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক, মুসলিম – বিরোধী হিংসা ছড়ায় উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে আসা হিন্দুত্ববাদী গুন্ডারা, নৈপথ্যে মুকুল রায়। তাই আজ মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন চলাকালীন তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু রায় যখন বলেন যে দিল্লী থেকে বিজেপি নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও হিংসায় ইন্ধন দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ষড়যন্ত্র করছে, তখন প্রশ্ন করা উচিত ডিসেম্বর ২০২০তে ডায়মন্ড হারবারে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা আক্রান্ত হওয়ার পরেই—অথবা আক্রান্ত হওয়ার ভান করার পরেই—তাঁর বাবাই প্রথম রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলেন কেন? তাও এমন সময়ে যখন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই দাবি তোলেনি?

মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন আরও একটা ব্যাপারে খটকা জাগায় যে এইবার কি বন্দোপাধ্যায়ের সরকার তাঁর উপর থেকে এক তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়কের হত্যার অভিযোগের মামলা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রুজু হওয়া ৬৫টি ফৌজদারি মামলা কি তুলে নেবে? নিজের দলের বিধায়ক খুনও কি মাফ হবে দলের সহ–প্রতিষ্ঠাতার দলে ফেরায়? অথবা ধরুন যে সমস্ত তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির হাতে আক্রান্ত হলেন, সেখানে কি দল তাঁদের চুপ করে মেনে নিতে বলবে?

ধরে নিলাম বন্দোপাধ্যায়ের মতে রায় তাঁর বিজেপিতে থাকাকালীন তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী বা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো কুৎসা করেননি। তাহলে তাঁর টুইটার হ্যান্ডেল কী বলছিল? এই কিছুদিন আগেই? দলে ফেরার ৩৩ দিন আগে, ৮ই মে, রায় ঘোষণা করেন যে তিনি বিজেপির অনুগত সৈনিক হিসাবেই লড়াই করবেন, যেমন তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়ার আগে বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। রায়ের ৮ই মে-র টুইট কে কোট করে নাড্ডা লেখেন যে বিজেপির কর্মীদের রায়ের পথ অনুসরণ করা দরকার। রায় তৃণমূল কংগ্রেস কতৃক রাজ্যে বিজেপির উপর নির্বাচনোত্তর আক্রমণের কথা তুলে, তাতে সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে বারবার রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলেন। সেই ঘটনাগুলো কি মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন ধুয়ে সাফ করে দেবে?

আসলে মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন স্পষ্ট করেই দেখায় যে ভারতের দক্ষিণ পন্থী শক্তির কোনো ভাবেই নীতি নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, কোনদিন ছিল না। এককালে যে ভাবে কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আর তার বিপরীতেও যোগদান চলতো ক্ষমতার লোভে, বর্তমানে সেই কংগ্রেস পার্টি বিলীন হয়ে সেই স্থান অধিগ্রহণ করেছে বিজেপি। অনেকের যদি মনে হয় এই যাওয়া আসার পালা অল্প কিছুদিনের, তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন কারণ যেহেতু ক্ষমতা ও স্থায়িত্ব পাওয়ার লোভে এই প্রত্যাবর্তন আর যোগদানের হিড়িক লেগে থাকে তাই ক্ষমতার বিন্যাসে অল্প পরিবর্তন হলেই, ক্ষমতার সমীকরণে বিজেপি শক্তিশালী জায়গায় পৌঁছলেই আবার দল বদলের হিড়িক শুরু হবে। মুকুল রায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন তাই কোন স্থায়ী ব্যাপার নয় আর এর ফলে রাজ্যে বিজেপি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে না।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla