প্রথমে চললো প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চ্যাটার্জির সাথে তাঁর স্ত্রীর দ্বন্দ্ব ও বৈশাখী মজুমদারের সাথে তাঁর প্রেম নিয়ে নানা মশলা মাখানো খবর। তারপর বাজারে এল টলিউডের চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে বসিরহাটের সাংসদ হওয়া নুসরাত জাহান আর তাঁর ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, জ্বালানি তেল, রান্নার গ্যাস, প্রভৃতির দাম বাড়া উপেক্ষা করে, বেকারত্বের হার ১২ থেকে ১৫% এর মধ্যে ঘোরাফেরা করার কথা উপেক্ষা করে, আর লকডাউনের কারণে পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা রাজ্যের গরিব মানুষের জীবনে যে দুর্দশার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তা উপেক্ষা করে নেতা, মন্ত্রী আর চলচ্চিত্র শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মশলা মাখানো খবর বেচে কর্পোরেট মিডিয়া কার স্বার্থ রক্ষা করছে? সেই প্রশ্নই উঠছে বর্তমানে, যখন নুসরত জাহানের জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে।
নুসরত জাহান আর তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী নিখিল জৈন কে নিয়ে যে ভাবে বাংলার সংবাদ মাধ্যম মেতে উঠেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে রাজ্যের মানুষের উপর চাপানো লকডাউন, তার ফলে হওয়া কর্মহানি ও সামগ্রিক একটা অর্থনৈতিক মন্দা আজ আর আলোচনায় রাখতে চাইছে না বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো। রাজ্যে কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশার ফলে ২০২০ সালের থেকে এই পর্যন্ত ১৬,৫৫৫ জনের সরকারি ভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল, এই যে ৯ই জুনেও ৯৫ জন মারা গেলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন হল শুধু যে নুসরাত জাহানের গর্ভস্থ সন্তানের পিতা কে? গর্ভস্থ শিশু তো আজও মায়ের পরিচয়ে জন্ম নিতে পারে না। তাই আজ সব খবরের শীর্ষে আছে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ নুসরাত জাহানের বিবাহ, প্রেম ও মাতৃত্বের ঘটনা গুলো।
এই ভাবে কারুর ব্যক্তি জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া করা তো বৃহৎ কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে নতুন ব্যাপার নয়। ইংরাজী ভাষায় যাকে বলে gossip, তাই নিয়ে অনেক ভাল ব্যবসা করে বিনোদন নিয়ে কাজ করা সংবাদ মাধ্যমগুলো। খুঁড়ে খুঁড়ে বাজারি celebrity-দের কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বার করা হয়, তাতে রঙ করা হয়, তারপরে মশলা মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। খেতে পরতে পারা মধ্যবিত্ত থেকে অনটনে থাকা এক শ্রেণীর গরিব মানুষকেও এই সব খবরের জৌলুস ব্যবহার করে মূল সমস্যার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। বেঁচে যায় বৃহৎ পুঁজি, যা শ্রমজীবী মানুষের রক্ত ঘামই শোষণ করে নিজের সিন্দুক স্ফীত করে। নুসরাত জাহান কে নিয়ে এই gossip এর বন্যা যে তাঁদের ব্যবসায় লাভই শুধু দেবে না বরং সাধারণ মানুষ কে দেশের মূল সমস্যার উপর যে নজর দিতে দেবে না তা আমরা দেখেছি সুশান্ত সিংহ রাজপুত নামক এক হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পীর মৃত্যুর সময়ে।
নুসরাত জাহান তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী নিখিল জৈন কে তাঁর স্বামী মানেন কি মানেন না, তাতে বঙ্গবাসী খেটে খাওয়া মানুষের কী যায় আসে? নুসরাত জাহান যদি যশ দাশগুপ্তের সাথে জীবন কাটান, বা অন্য কারুর সাথেও প্রেম করেন তাতে বসিরহাটের জনগণের জীবনে তার কী প্রভাব পড়বে? প্রশ্ন হল একটি চলচ্চিত্র শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের কাটাছেঁড়া করে যে বিনোদনের মশলা পাওয়া যায় আর তাই দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যে দেশের মানুষের নজর জ্বলন্ত সমস্যার থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সেটা ভালই বোঝে মূলধারার সংবাদমাধ্যম। এর সাথে যোগ করুন নুসরাত জাহানের মুসলিম পরিচয়, সেই পরিচয়ের মহিলার একটি জৈন ধর্মের ছেলে কে বিয়ে করা সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিতে পারলো না আর এই বার বিচ্ছেদ না করে অন্য কারুর সাথে জীবন যাপন করা, সেটাও তেমন সাম্প্রদায়িক মোড়ক না পাওয়ায় প্রচেষ্টায় খামতি রাখছে না বাজারি সংবাদমাধ্যম। কিন্তু তাই বলে কি নুসরাত জাহানের ব্যক্তি জীবন নিয়ে কাটা ছেঁড়া করা যাবে না? তাঁর কর্মকাণ্ডের, তা ব্যক্তি জীবনের হলেও, বিশ্লেষণ করা যাবে না?
চলচ্চিত্র শিল্পী নুসরাত জাহান কী করছেন আর কী করছেন না তাঁর ব্যক্তি জীবনে সেটা কারুর দেখার এক্তিয়ার নেই। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ নুসরত জাহানের বেলায়? সেই ক্ষেত্রে যদি তাঁর ব্যক্তি জীবন তাঁর রাজনীতির উপর প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড় করায় সেটা নিয়ে কি আলোচনা হবে না? পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের মূল অভিযুক্ত ও আসামী সাব্যস্ত হওয়া কাদের খান কে যখন তিনি নিজের ফ্ল্যাটে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাগদত্তা হিসাবে, সেই সময় তিনি জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। এখন নুসরাত জাহান একজন জনপ্রতিনিধি। তৃণমূল কংগ্রেস যখন তার ঘোষিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে লড়ছিল বিধানসভা নির্বাচন, সেই সময়ে তিনি বিজেপি প্রার্থী যশ দাশগুপ্তের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে বাস করে কী প্রমাণ করলেন?
একজন মানুষের জীবনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলো তাঁর ব্যক্তিগত ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ না সেটা বৃহৎ রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে যুক্ত না হয়। নুসরাত জাহান একটি রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধি। তিনি একজন সাংসদ এবং তাঁর দলের কর্মী। কিন্তু তিনিই কী ভাবে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে, যিনি এমন এক দলের প্রার্থী যা নুসরাত জাহানের ধর্মীয় পরিচয় কে ঘৃণা করে, যে দল মুসলিমদের হত্যা করায়, তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণীর, অধিকার-হীন নাগরিকে পরিণত করতে চায়, যে দলের অস্তিত্ব মুসলিম বিদ্বেষের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, বাস করেন? তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন? সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে কি যশ দাশগুপ্ত তাঁর দল বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে গেছেন না নুসরাত জাহান কে নিজের দলের নীতির পক্ষে এনেছেন? সেই সম্পর্কের জন্যে কি যশ দাশগুপ্ত মুসলিম বিদ্বেষ ছেড়ে দিয়েছেন না নুসরাত জাহান কে মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন? যদি তৃণমূল কংগ্রেস এই ভাবে তাদের দলের জনপ্রতিনিধির ফ্যাসিস্টদের সাথে সহবাস করা কে অনুমোদন করে তাহলে কি তার নিজের সুবিধাবাদী, ফ্যাসিস্ট চরিত্র সামনে আসে না?
জার্মানির একটি প্রবাদ আছে। একটি টেবিলে যদি তিনজন নাৎসি বসে থাকে আর তাঁদের সাথে যদি চতুর্থ কোন ব্যক্তি দেখা করে গল্প করতে বসেন, আলোচনা করতে বসেন, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় ওই টেবিলে চারজন নাৎসি বসে আছে। ঠিক সেই ভাবেই, যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে, যে বিজেপি কে দেশের আপামর খেটে খাওয়া জনগণ ঘৃণা করেন, যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ কে ধ্বংস করে দিতে চায়, সেই বিজেপির নেতার সাথে সহবাস করে নুসরাত জাহান কিন্তু জানান দিলেন তিনিও এই ফ্যাসিবাদের সমর্থক। আর তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস এই সম্পর্ক কে অনুমোদন করে জানান দিল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই মূলত আসন দখলের লড়াই, বিজেপি কে পরাস্ত করার লড়াই নয়।
যদি এই ক্ষেত্রে ঘটনাটা উল্টো হত– একজন মুসলিম পুরুষ তাঁর হিন্দু ধর্মের বা জৈন ধর্মের স্ত্রীর সাথে বিবাহ কে অবৈধ ঘোষণা করে আর এক জন হিন্দু নারীর সাথে সহবাস করতেন ও সেই নারী তার ফলে যদি গর্ভবতী হতেন, তাহলে কী হত? তাহলে কি সেটা মশলাদার খবর হত না সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াবার, “লাভ জেহাদ”-এর তত্ত্ব আউড়ে সমাজে ধর্মীয় মেরুকরণ করার একটা সুযোগ তৈরি করতো বিজেপির জন্যে? যাঁরা এখন নুসরাত জাহান “স্বাধীন” এক মহিলা বলে দাবি করছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত কে সম্মান জানাতে বলছেন, তাঁরা কি একই কথা বলতেন ওই মুসলিম পুরুষের হিন্দু সঙ্গিনীকেও? তাহলে কি সমাজে এর পরিণাম একই হত? না এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে তোলপাড় হত?
আসলে উদারাতাবাদের, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তারা ফ্যাসিবাদেরই গুপ্ত সমর্থক। তাঁরা মুখে ধর্মনিরেক্ষতাবাদী সাজলেও আদতে তাঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাদ চরম ভাবে বিরাজ করে এবং সেই রাজনৈতিক দেউলিয়া দেখা যায় আজ তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতরে। যে ভাবে রাজনৈতিক নৈতিকতা বাদ দিয়ে, শুধু নিজের স্বার্থে নুসরাত জাহান একজন বিজেপি নেতার সাথে সহবাস করা শুরু করলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি কিন্তু আদতে একজন ফ্যাসিস্ট। তাঁর কাছে বিজেপি কোন সমস্যা নয়; হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মুসলিমদের গণহত্যা করা, তাঁদের সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানো ও তাঁদের থেকে সব অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাজনীতি নুসরাত জাহান কে কোন ভাবেই চিন্তিত করে না। আর তাই মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে, একটি নারীর নিজের জীবনের উপর অধিকার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, নিজের শরীরের উপর অধিকার হরণ করে যে বিজেপি রাজনীতি করে, সেই বিজেপির নেতার সাথে সহবাস করা নুসরাত জাহান কোন প্রতিবাদী বা নারীমুক্তির প্রতীক না, তিনি প্রতীক হলেন ব্রাহ্মণবাদী পুরুষতন্ত্রের কাছে নারীর পদানত হওয়ার। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কাছে উদারতাবাদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের।