পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে প্রায় ৩০০ জন সাংবাদিক, সরকারি আমলা, শাসকদল আর বিরোধী দল নেতা কর্মীদের, রাজনৈতিক কর্মী আর পুঁজিপতিদের উপর গোপনে নজরদারি চালাবার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছেন বিরোধীরা ও হাতেগোনা সরকার-বিরোধী সংবাদ মাধ্যম। গত কয়েকদিন ধরে পেগাসাস প্রকল্প নিয়ে কাজ করা ১৭টির উপর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-র মতন সংগঠন যে ৫০,০০০ ফোন নাম্বারের উপর তদন্ত করেছিল তাতে ভারতীয় নম্বরগুলো দেখিয়ে বিরোধীরা অভিযোগ করেছে যে চূড়ান্ত আতঙ্ক থেকে মোদী-র নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার এই ফোনগুলোতে নজরদারি চালিয়েছিল পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে।
যদিও এই কথা সত্য যে ভারতের মতন একটা দেশে, যেখানে প্রায় ১২৫ কোটি মানুষ তাঁদের সমস্ত তথ্য, আঙ্গুল আর চোখের মণির ছাপ সহ, রাষ্ট্রীয় নজরদারির জন্যে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন আধার প্রকল্পের মাধ্যমে, সেই দেশে মাত্র ৩০০ জন বিশিষ্ট মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ঘটনা নিয়ে হইচই করা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি, কিন্তু সেই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যদি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে, জায়নবাদী ফ্যাসিবাদের সাথে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তির একটা অশুভ আঁতাতে ঘটনা সামনে আসে, তখন কিন্তু বিষয়টা একটা অন্য মাত্রা পায়।
জায়নবাদী দখলে থাকা ফিলিস্তিনের ভূমিতে অবস্থিত এনএসও গ্রুপ নামক যে সংস্থাটি পেগাসাস স্পাইওয়্যার তৈরি করে, তারা নিজেদের গ্রাহকদের তালিকা বাইরে প্রকাশ করে না। যদিও এনএসও গ্রুপ ঘোষণা করেছে যে তারা কিছু “পরীক্ষিত সরকার” ছাড়া আর কাউকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রি করে না, তবুও এই সরকারগুলো কারা সেটা তারা জানায় না। আবার ভারত সরকারও স্বীকার করতে চায় না পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করার কথা। যদিও মোদীর মানুষের উপর নজরদারি চালাবার দীর্ঘদিনের স্বভাবের কথা শুধু বিরোধী শিবিরেই না, এমন কী বিজেপির ভিতরেও সবার জানা, তবুও সেটা দিয়ে বা তাঁর বিরোধী বা সমালোচকদের ফোনে আঁড়ি পাতা ও সমস্ত তথ্য চুরি করা প্রমাণ হয় না। তাহলে কী ভাবে প্রমাণ হবে যে মোদী সরকারের হাতে পেগাসাস স্পাইওয়্যার এসেছিল?
পেগাসাস স্পাইওয়্যার: মার্কিন থেকে জায়নবাদী সম্পর্ক
যখন ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতির দৌড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামিল হন, তখন তিনি মাইকেল ফ্লাইন কে তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে পরিচিত করান, ও স্থির হয় যে তিনি সরকার গড়লে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হবেন প্রাক্তন সিআইএ অধিকর্তা ফ্লাইন। নভেম্বর ২০১৬তে ট্রাম্প নির্বাচন জেতার পরে, কিন্তু সরকার গড়ার আগেই, ডিসেম্বর মাসে ভারত সফরে আসেন ফ্লাইন। দেখা করেন মোদীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথে। তাঁদের দুই জনের আলোচনার খবর ভারতের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল।
এর পরে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বিদেশীদের থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে ফেঁসে ফ্লাইন পদত্যাগ করেন। জানা যায় তিনি অনেকগুলি নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানির সাথে যুক্ত থাকার সাথেই ওএসওয়াই টেকনোলজিস এস.এ.আর.এল নামক লুক্সেমবার্গ-অবস্থিত একটি কোম্পানির বোর্ডের উপদেষ্টা ছিলেন এবং সেখান থেকে ২০১৬ সালে তিনি ৪০,২৮০ মার্কিন ডলার আয় করেন। এই ওএসওয়াই টেকনোলজিস এস.এ.আর.এল হল এনএসও গ্রুপের একটা সংস্থা যা আয়কর বাঁচাতে লুক্সেমবার্গে খোলা হয়েছিল। সন্দেহ করা হয় যে নিজের পরিচিতি ও প্রভাব ব্যবহার করে ফ্লাইন ওএসওয়াই টেকনোলজিস এস.এ.আর.এল এর পণ্য নানা দেশের সরকার কে বিক্রি করতেন। সেই দিক থেকে দেখলে, জানুয়ারি ২০১৭-তে ট্রাম্প সরকার গঠনের আগেই ভারতে এসে ফ্লাইন যে ভাবে দোভালের সাথে বৈঠক করলেন, তাতে এনএসও গ্রুপের পেগাসাস স্পাইওয়্যারের সাথে ভারতের নিরাপত্তা বিভাগ কে পরিচিত করিয়ে দেন তিনি, এমন সম্ভাবনাই প্রবল।
যদিও ফ্লাইনের ভারত ভ্রমণের পরেই এনএসও গ্রুপ থেকে কিন্তু মোদী সরকার পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেনেনি, বরং তার প্রস্তুতি নিয়েছে। মার্চ ২০১৭-তে দোভাল জায়নবাদী-অধিকৃত ফিলিস্তিনে যান ও তৎকালীন জায়নবাদী সন্ত্রাসী পাণ্ডা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র রাজত্বের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের সাথে বৈঠক করেন মোদীর রাষ্ট্রীয় সফরের পটভূমি তৈরি করতে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মোদী জায়নবাদী শক্তির কবলে থাকা ফিলিস্তিনি অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সফরে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যান ও নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠক করেন, হাত ধরাধরি করে ছবিও তোলেন।
এই সময়ে, মোদী ও নেতানিয়াহু বৈঠকের পর যে যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর টুইট করে, যাতে বলা হয় “স্টার্টআপ থেকে মহাকাশ, যোগাযোগ থেকে সাইবারন্যাটিক্স, ইজরায়েলের প্রযুক্তিগত ক্ষমতাগুলো ভারতের সাথে মিলে একাকার হচ্ছে”।
সাইবারন্যাটিক্স হল সেই শিল্প যার অন্তর্গত হল পেগাসাসের মতন স্পাইওয়্যার। এই যৌথ বিবৃতিতে বোঝা যাচ্ছে যে প্রাথমিক ভাবে ভারত আর জায়নবাদী শক্তির মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল জুলাই ২০১৭-তে সাইবারন্যাটিক্স নিয়ে, এবং এর মধ্যেই থাকতে পারে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের রহস্য।
জুলাই ২০১৭-র মোদীর সফরের পরে, জানুয়ারি ২০১৮-তে ভারত সফরে আসেন নেতানিয়াহু। সেই সময়ের অনেকগুলো মৌ চুক্তি স্বাক্ষর হয় ভারত আর জায়নবাদী শক্তির মধ্যে। ভারতীয় আমলা বিজয় গোখালে আর জায়নবাদী ইউভাল রোতেম এর সাক্ষর করা একটি মৌ চুক্তি “ভারত ও ইজরায়েলের” সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা নিয়েও ছিল, যা জুলাই ২০১৭-তে ঘোষিত সাইবারন্যাটিক্স প্রযুক্তির আদানপ্রদানের সাথে যুক্ত।
এর ঠিক পরেই, ২০১৮ সালের থেকেই নজরদারি শুরু হয় অনেক মোবাইল ফোনে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আটক সুধীর গডলিং, রোনা উইলসন, সোমা সেন, হানি বাবু এমটি, ভেরনন গনসালভেস, অরুণ ফেরেরা, গৌতম নভালকা, সুধা ভরদ্বাজ, প্রভৃতির সাথে বিরোধী নেতাদের, আমলাদের, সাংবাদিকদের নাম্বার।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রির প্রক্রিয়া ও ভারতের সম্ভাব্য তালিকায় থাকা
এনএসও গ্রুপ ২০১৬ সাল থেকেই বারবার বিতর্কে ফাঁসে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা মামলায় সামনে আসে পেগাসাস স্পাইওয়্যার এর নাম, কিন্তু জানা যায় ট্রাম্প জনরোষের চাপে খাসোগি হত্যা নিয়ে সৌদি কে চাপ দেওয়ার ভান করলেও আড়ালে এনএসও গ্রুপ কে আশ্বাস দেন কাজ চালিয়ে যেতে। এই সময়ে, ও পরবর্তী কালে, ২০১৯ সালে, হোয়াটসঅ্যাপ যখন ধরে ফেলে ফোন হ্যাক করার ঘটনা আর ক্যানাডায় স্থিত সিটিজেন ল্যাব কে দিয়ে এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার এর পরীক্ষা করায়, তখন চাপের কারণে একটি মানবাধিকার নিয়ে নিজের পলিসি প্রকাশ করে জায়নবাদী সংস্থার মালিকেরা, যার সারমর্ম হল যে যেহেতু এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে অনেক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে তাই তাঁরা “পরীক্ষিত” সরকারি এজেন্সিকে এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে এবং সেটা একমাত্র হতে পারে জায়নবাদী প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অনুমতি সাপেক্ষে।
জায়নবাদী শক্তির প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সাম্প্রতিক তথ্য জানাচ্ছে যে ২০২০ সালেই জায়নবাদী শক্তি বিদেশে ৮৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করে। এর মধ্যে ৫% বা ৪১.৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের “ইন্টেলিজেন্স, তথ্য ও সাইবার সিস্টেমস” ছিল। এই বিভাগেরই অন্তর্ভুক্ত হল পেগাসাস স্পাইওয়্যার ঘরানার প্রযুক্তি। খবরে প্রকাশিত যে জায়নবাদী শক্তির থেকে বিশাল পরিমাণের সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করে ভারত। এর ফলে ভারতের সরকার অবশ্যই জায়নবাদী শক্তির চোখে “পরীক্ষিত” সরকার আর তাই সেখানকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক অবশ্যই এনএসও গ্রুপ কে ভারতে পেগাসাস স্পাইওয়্যার রফতানি করতে বাঁধা দেবে না।
ফলে এনএসও গ্রুপ থেকে ভারত আমদানি করতে পারবে না এই রকম কোন সম্ভাবনা নেই, বরং ভারতের মতন দেশেরই বেশি সম্ভাবনা এই রকম প্রযুক্তি কেনার। এনএসও গ্রুপের এই তথ্যটি সত্য হিসাবে গণ্য করা যায় যে ওই সংস্থা নিজের থেকে কারুর ফোনে আঁড়ি পেতে তথ্য চুরি করে না বরং তারা তাদের গ্রাহকদের একবার নিজেদের স্পাইওয়্যারের লাইসেন্স বিক্রি করার পরে নিজেদের ভূমিকা শুধু মাত্র সফটওয়্যারের প্রযুক্তি সংক্রান্ত সহায়তার মধ্যেই সীমিত রাখে। কোন দেশেরই গোয়েন্দা সংস্থা অন্য দেশের কোম্পানি কে নিজের তথ্য তুলে দেবে না, বা দেখতেও দেবে না।
তাহলে, ভারত যেমন নিজ ক্ষমতায়, বিনা বাঁধায়, জায়নবাদী শক্তির থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার কিনতে পারে তেমনি একমাত্র ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাই তা ব্যবহার করতে পারে।
ভারতে কে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করতে পারে?
এনএসও গ্রুপের ঘোষণা অনুসারে একটি “পরীক্ষিত” সরকারের এজেন্সি একমাত্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। যেহেতু কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) প্রাক্তন কর্তা চাকরিরত অবস্থায় এই নজরদারির শিকার হন, তাই এর পিছনে এই এজেন্সির হাত থাকা সম্ভব না। আবার ভারতের বহিঃ গুপ্তচর সংস্থা র অধিকর্তারও ফোনে যেহেতু পেগাসাস দিয়ে নজরদারি চালাবার অভিযোগ উঠেছে, তাই সেই সংস্থার হাত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। যেহেতু দোভালের সাথে ফ্লাইনের বৈঠক থেকেই এনএসও গ্রুপের ভারতে যাত্রার সূচনা ধরা যেতে পারে, ও যেহেতু ভীমা কোরেগাঁও কাণ্ডে অভিযুক্তদের ফোনেও আঁড়ি পাতা হয়েছিল, তাই দোভালের ভরসার জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) কিন্তু সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
এনআইএ দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির শাখা হিসাবে কাজ করছে ও মুসলিম, দলিত, আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে এনে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ধর্মীয় মেরুকরণ করার প্রকল্প কে মদদ করছে। এহেন এনআইএ-র পক্ষেই সম্ভব ভারতের নাগরিকদের উপর বেআইনী নজরদারি চালানো। আর যেহেতু এনআইএ-র সাথে দোভালের সম্পর্ক নিবিড় আর দোভাল আবার মোদীর প্রিয়পাত্র, বিজেপির আপন, তাই তাঁকে রক্ষা করতে ও মোদী কে রক্ষা করতে আজ বিজেপি সরকার কে বারংবার অস্বীকার করতে হচ্ছে ফোনে নজরদারি করার কথা।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার আর রাষ্ট্রীয় নজরদারির সমস্যা
পেগাসাস স্পাইওয়ার নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় আজ রাষ্ট্রের নজরদারি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে মূলধারার মিডিয়ায়। বিরোধী দলগুলি এই নিয়ে সুর চড়িয়েছে। অথচ অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে “প্রথম বিশ্বের” ইস্যু দিয়ে “তৃতীয় বিশ্বের” ভারতের জনগণ কে কোন ভাবেই উদ্বুদ্ধ করা যাবে না, কারণ যাঁরা দুইবেলা খেতে পাননা, তাঁরা কিন্তু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে ভাবিত নন, দেশের ৩০০জন রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, আমলা, প্রভৃতিদের উপর নজরদারি নিয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যথা নেই। ফলে এই ইস্যু নিয়ে মোদী সরকার আর বিজেপি কে বিপদে ফেলার প্রচেষ্টা এক ধরণের শিশুসুলভ রাজনীতি।
যুগে যুগে, দেশে দেশে, শাসক শ্রেণী বিরোধীদের উপর, সংবাদ মাধ্যমের উপর আর নিজের সন্দেহের লোকেদের উপর নজরদারি চালিয়ে এসেছে। এই নজরদারির প্রযুক্তি যুগে যুগে বদলেছে। আর তার সাথেই বদলেছে সেই প্রযুক্তি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার সরকার বিরোধীদের কৌশল। সমস্যা আজ এনএসও গ্রুপ বা পেগাসাস স্পাইওয়্যার নয়, কারণ একটি ব্যবসায়িক সংস্থা বাজারে চাহিদা দেখে এমন পণ্য তৈরি করতে থাকবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যা দিয়ে সে মুনাফা আয় করতে পারবে। আজ এনএসও গ্রুপ তো কাল অন্য কেউ, আজ পেগাসাস স্পাইওয়্যার তো কাল অন্য কিছু।
সমস্যা হল নজরদারি চালানোর মনোভাবের। এই মনোভাব থেকে এডলফ হিটলারের জন্যে আইবিএম কোম্পানি যে পাঞ্চ কার্ড ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর নজরদারি চালানোর ও মানুষের জীবনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে রাখার ব্যবস্থা হল কেন্দ্রীয় সরকারের আধার প্রকল্প। এই আধার দিয়ে যে মোদী সরকার শুধুই নজরদারি চালাবে তা নয়, বরং “এক দেশ এক রেশন কার্ড” ব্যবহার করে যেমন প্রায় ২০ কোটি গরিবের পেটের ভাত মারবে তেমনি, জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) তৈরি করে, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর (এনআরসি) দিয়ে মানুষ কে, গরিব, দুস্থ জন কে বেনাগরিকও সে করতে চায়।
একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে যেহেতু নির্বাচিত সরকার জনগণের প্রতিনিধি, তাই কোন ভাবেই সেই সরকার জনগণের উপর নজরদারির ছড়ি ঘোরাতে পারে না। এর সাথে মোদী সরকারের জনগণ কে জানানো উচিত যে তাঁদের রক্ত ঘামে অর্জিত অর্থ দিয়ে দেওয়া কর কেন জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পে খরচ না করে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে, বিরোধী ও সাংবাদিকদের উপর নজরদারি করতে ব্যবহার করা হল?
হয় মোদী সরকার স্বীকার করে নিতে পারে যে সরকারি ভাবেই এই নজরদারি চলছিল এবং সংসদ কে জানাতে পারে এর পিছনে কত খরচ করা হয়েছিল আর না হয় অস্বীকার করতে পারে। যে দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর নিজের ফোন হ্যাক হয়, সেই দেশের সরকারের “ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি” গোছের কথা বলে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হাস্যকর।
যদি মোদী সরকার সততার সাথেই অস্বীকার করে যে এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে সে নজরদারি চালাচ্ছিল, তাহলে তার এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত করা উচিত। কারণ এটা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাহলে অবিলম্বে সরকারের উচিত তদন্ত করে সংসদে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। এর পরেও যদি মোদী সরকার কোন তদন্ত না করে, কোন শ্বেতপত্র প্রকাশ না করে, জনগণ কে না জানায় তাঁদের অর্থে কী মোচ্ছব করা হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে যে এই সরকার মানুষের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারগুলো কে খর্ব করছে।
একজন কর্মচারী কে চাকরিতে রাখার পরে যদি সংস্থার কর্তার মনে হয় যে সেই কর্মচারী তাঁরই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বা তাঁর গোপন তথ্য চুরি করছে, তখন সেই কর্তার পূর্ণ অধিকার থাকে এই রকম কর্মচারী কে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। ঠিক তেমনি, যে সরকার কে আর রাষ্ট্রের যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো কে জনগণ নিজের গাঁটের টাকার দিয়ে পুষছে, সেই সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্র যদি করদাতার বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে, তার অধিকার খর্ব করে, চুক্তি লঙ্ঘন করে তখন তাদেরও চাকরি থেকে তাড়াবার অধিকার জনগণের, অর্থাৎ দেশের মালিকের আছে। ফলে পেগাসাস স্পাইওয়্যার থেকে শুরু করে আধারের মতন গরিব মারা নজরদারি ব্যবস্থা কে সরকার কে বাতিল করতে বাধ্য করা দেশের জনগণের কর্তব্য আর এই কাজে যে রাজনৈতিক শক্তি জনতার পাশে দাঁড়াবে না, জনতার দাবির বিরোধিতা করবে, মোদী সরকার ও বিজেপির মতন সেই শক্তিকেও নিন্দিত ও দণ্ডিত করার অধিকার জনগণের আছে ও থাকবে।