দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুর অঞ্চল থেকে গত ১১ই জুলাই তিনজন বাঙালি মুসলিম কে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার করে। বলা হয় ধৃত জয়রাম ব্যাপারী ওরফে নাজিউর রহমান, রাবিউল ইসলাম ও মিকাইল খান ওরফে সাবির নাকি জামাত এ মুজাহিদিন –বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্য। এর পর থেকেই লাগাতার বাজারি সংবাদ মাধ্যমে চলতে থাকে তাঁদের সম্পর্কে পুলিশী বয়ান ব্যবহার করে কুৎসা। আর এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে, ইসলাম বিদ্বেষ কে তীব্র করে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো। এর ফলে আক্রান্ত হচ্ছেন হরিদেবপুর অঞ্চলের খেটে খাওয়া বাঙালি মুসলিমরা।

যখন পিপলস রিভিউ বাংলা এই তথাকথিত বাংলাদেশী “জঙ্গীদের” ঘাঁটিতে গেল অনুসন্ধান করে বাস্তবতার নিরিখে খবর করতে তখন জানা গেল যে এলাকার মানুষের বক্তব্য বাজারি সংবাদমাধ্যম নাকি বিকৃত করে বারবার পরিবেশন করেছে। স্থানীয় তাজ স্পোর্টিং ক্লাবের সেক্রেটারি এস কে আহমেদ জানালেন যে বারবার মিডিয়া তাঁদের কথা কেটে দিয়ে নিজেদের তৈরি কাল্পনিক কাহিনী দিয়ে মানুষ কে বিভ্রান্ত করছে ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করছে। তাঁদের অভিযোগ যে একদিকে সংবাদ মাধ্যম পুলিশের বয়ান কে সত্য বলে প্রচার করছে আর অঞ্চলে খবর করতে এসে তাঁরা তিল কে তাল করে মানুষ কে আতঙ্কিত করছেন মুসলিমদের সম্পর্কে। 

কী কী ভয়ানক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে জয়রাম, রাবিউল বা সাবিরের কাছ থেকে? এসটিএফ জানিয়েছে পাওয়া গেছে একটি ডায়েরি, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট। এই না হল একেবারে সন্ত্রাসবাদী হওয়ার অকাট্য প্রমাণ! সন্ত্রাসবাদী ছাড়া কারা ডায়েরি ব্যবহার করে? কারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট খোলে? এই কাজ তো কলকাতা পুলিশের মতে খাঁটি সন্ত্রাসীদের, তাও যে সে নয়, খাস বাংলাদেশ থেকে আসা জেএমবি সন্ত্রাসীদের। 

হরিদেবপুর ঘুরে আমাদের সাংবাদিক সৌম্য মন্ডল জানলেন কী ভাবে ছাতা সারাইয়ের রড হয়ে যায় বোমা বানানোর সরঞ্জাম, কী ভাবে ছাতার বাঁট হয়ে যায় বন্দুকের বাঁট আর কী ভাবে সিলিং ফ্যানের মতন একটি বস্তু কে বলা হয় বোমা বানানোর উপকরণ, তা দেখাচ্ছে বাংলার কুখ্যাত রিপাবলিক বাংলা। তাহলে কলকাতা শহর বা পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ৮০% ঘরেই বোমা বানানোর মূল উপকরণ —সিলিং ফ্যান—রয়েছে এবং সবাই কেই গ্রেফতার করা উচিত।

এই ভিডিওতে দেখুন আমাদের গ্রাউণ্ড রিপোর্ট

ধৃত সাবির সম্পর্কে অঞ্চলের সবার মত হল সে খুবই গরিব পরিবারের ছেলে এবং প্রায় ১৫ বছরের উপর সে ওই অঞ্চলে বাস করছেন। ব্যাপারী বা ইসলাম সম্পর্কে কেউই বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। জানা গেল, সাবির আগে মরশুম হিসাবে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন কিন্তু সম্প্রতি লকডাউনের ফলে তাঁর আর্থিক অবস্থার চূড়ান্ত ক্ষতি হয়। বর্তমানে ফল বিক্রি করে তাঁর উপার্জন হত। সেই মানুষটা যদি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ধরা পরে জেল খাটে তাহলে তাঁর জন্যে মামলা লড়ার খরচ যোগাবে কে? আর এই মামলা কোন দুঁদে উকিল লড়বে না বলেই কি কলকাতা পুলিশের এই পদক্ষেপ? 

যেদিন কলকাতা পুলিশের এসটিএফ সাবির, জয়রাম ও রাবিউল কে গ্রেফতার করে, সেইদিন কিন্তু কয়েকশো মাইল দূরে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ কয়েকজন মুসলিম যুবক কে গ্রেফতার করে সন্ত্রাসবাদী বলে। এই ভাবেই গত অনেক বছর ধরে দলে দলে মুসলিম যুবদের সন্ত্রাসী বলে জেলে বন্দী করা হয়। অনেকে কাশ্মীরের বশির আহমেদ বাবা-র মতন ১১ বছর জেল খাটার পরে বা অনেকে অন্যদের মতন ২৩ বছর পরে নির্দোষ হিসাবে সব্যস্ত হয়ে ছাড়া পাবেন, অনেকেই বিচারাধীন অবস্থায় মারা যাবেন রাষ্ট্রের বজ্রকঠিন নিরাপত্তা বেষ্টনীর ফাঁসে। তবে এই ভাবেই যে কোন গরিব মুসলিম কে ধরে যে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে একটি সম্প্রদায়ের নাম করে যা ইচ্ছে তাই মিথ্যা অভিযোগ লাগানো যায় তা ভারতের শাসকশ্রেণী ও তাঁদের পেটোয়া মিডিয়া ভালই জানে। তাই হরিদেবপুর গিয়ে জানা গেল কী ভাবে মুসলিম বস্তির গরিব মানুষদের হেনস্থা করা হচ্ছে, যে মুহূর্তে তাঁরা সেই হিন্দু অঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করছেন ফেরি করতে বা রিকশা চালিয়ে দুই পয়সা উপার্জন করতে। 

আমরা এই প্রবন্ধে দেখেছি কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের জোর করে বাংলাদেশী বলে জেলে চালান করছে দক্ষিণের তামিলনাড়ু, যেখানে ক্ষমতায় আসীন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মতনই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) – বিরোধী দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘম (ডিএমকে), যা ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল বলে পরিচিত হয় ভারতের রাজনীতির আঙিনায়। এই মুহূর্তে এই “প্রগতিশীল” ও “গণতান্ত্রিক” সাজা দলগুলোই কিন্তু বিজেপি-র কর্মসূচী পূর্ণ করছে তা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের বাংলাদেশী বলে চালান করেই হোক আর হরিদেবপুরের ঘটনার মতন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েই হোক। আর এর ফলেই প্রকাশিত হচ্ছে কী ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ সমস্ত দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। হরিদেবপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া তিন হতভাগ্য বাঙালি মুসলিমের করুণ দশা দেখাচ্ছে আগামী দিনে কী ভয়ানক ভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি ইসলামবিদ্বেষ ছড়াতে চাইছে আর মুসলিম, দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের সব অধিকার কেড়ে তাঁদের সস্তা দাসশ্রমিকে পরিণত করতে চাইছে। 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla