একটা ফেসবুক পোস্ট, আর তাতে “আল-ভিদা” লিখে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান দিয়ে, সক্রিয় রাজনীতির থেকে, বা বলা ভাল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) থেকে, অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন গায়ক থেকে রাজনীতিবিদ থেকে সাংসদ থেকে মন্ত্রী হওয়া সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয়। অনেকদিন ধরেই ইঙ্গিত দিয়েও, শনিবার, ৩১শে জুলাই, নিজের মনের কথাটা জানিয়ে দিলেন।
তবে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা করা সত্ত্বেও মোহনবাগান ক্লাবের প্রতি তাঁর সমর্থনের সাথেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির প্রতি তাঁর আনুগত্য কে বারবার জাহির করেছেন বাবুল তাঁর ফেসবুক পোস্টে। তিনি জানান অতীতেও তিনি রাজনীতি ছাড়ার প্রস্তাব দিলেও মোদী ও তাঁর গোমস্তা অমিত শাহ তাঁকে আটকে দেন। তবে তাঁর হাতে মন্ত্রিত্ব না থাকা যে এই সিদ্ধান্ত কে ত্বরান্বিত করেছে, তাও জানাতে ভোলেননি বাবুল। একদা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও আসানসোলে তাঁর কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী জিতেন্দ্র তিওয়ারি কে বিজেপিতে নেওয়ার ফলে চাপেই ছিলেন বেশ কিছুদিন। দলের বৈঠকেও যোগ দিচ্ছিলেন না বাবুল।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর ক্যাবিনেটের রদ বদল করায় চাকরী গেছিল নিজেকে একমাত্র “প্রপার নাউন” বলে জাহির করা প্রাক্তন মন্ত্রী মশাইয়ের। নিন্দুকেরা বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি গো-হারা হারায় তাঁর উপর কোপ পড়ে, কারণ তিনিই মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদারও ছিলেন, কিন্তু ফলাফলে দেখা যায় টালিগঞ্জ আসনে অরূপ বিশ্বাসের কাছে নিজেই হেরে গেছেন। একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন আর সেখানে হেরে যাচ্ছেন, এই দৃশ্যের ফলে রীতিমত নাক কাটা যায় মোদীর আর বিজেপির। তা ছাড়াও, আসানসোল অঞ্চলের বিধানসভা কেন্দ্রগুলোতে ভাল ফল করতে পারেনি বিজেপি আর তার দায়ও বাবুলের কাঁধেই চাপানো হয়।
২০১৪ সালে আসানসোল থেকে প্রথমবার সাংসদ হয়ে সবাই কে চমকে দিয়েছিলেন বাবুল। সেই আসানসোল কেন্দ্র থেকে যেখানে বামফ্রন্ট সমর্থিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] প্রার্থী বংশ গোপাল চৌধুরী সেই ২০০৯ সালের বামেদের ভরাডুবির সময়েও জয়লাভ করেন। তারপরে তাঁকে আর বিজেপিতে পিছন ঘুরে তাকাতে হয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) বাইরে থেকে বিজেপিতে যোগ দিলেও বাবুল সঙ্ঘ পরিবারের মাথাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন কারণ তাঁর গায়ক হিসাবে একটা খ্যাতি ছিল, আর তাঁকে ব্যবহার করেই পশ্চিমবঙ্গের সাবর্ণ বাঙালি আর হিন্দি-ভাষীদের নিজের দিকে টানা শুরু করে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের “তারকা” সম্প্রদায়কে প্রলুব্ধ করতে আরএসএস এর তরুপের তাস হন বাবুল। সিপিআই (এম) আর কংগ্রেস কে সরিয়ে রাজ্যে বিজেপি কে প্রধান বিরোধী করার পিছনে তাঁর অবদান বিজেপি ভুলতে পারবে না।
আজ বাবুল সুপ্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা বলায় অনেকেই, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকেরা, বেজায় খুশি হচ্ছেন। তাঁরা আশা করছেন যে বাবুল তাঁদের দলে যোগ দেবেন। অনেকে ভাবছেন যে বাবুল চলে যাওয়ায় বিজেপি চাপের মুখে পড়বে। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশ করছেন যে বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি ছেড়ে ভাল করছেন কারণ বিজেপির মতন প্রতিক্রিয়াশীল দলে বেশি দিন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ থাকতে পারেন না। তাঁদের মত, বাবুল বিজেপির ভিতর মানিয়ে নিতে না পারায় তাঁকে দল ছাড়তে হল। কিন্তু বাবুল কি কখনো এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি বিজেপির ভিতরে ঠিক “মানিয়ে উঠতে” পারছেন না? কখনো কি তিনি বিজেপির নীতিগত বিরোধিতা করেছেন?
তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে সাংসদ পদ ছাড়ার কথা বলার সাথে সাথে তিনি জানান দেন যে তিনি সারা জীবন বিজেপির প্রতি আনুগত্য দেখাবেন। উত্তর ভারতীয়, হিন্দি-ভাষী প্রভুদের ভাল ভৃত্য থাকার অঙ্গীকার করতে বারবার মোদী, শাহ আর জেপি নাড্ডা-র নামের পরে “জি” যোগ করে সেই আনুগত্য ও ভবিষ্যতে দর কষকষি করার দরজা খোলা রাখলেন পরিণত রাজনীতিবিদ বাবুল সুপ্রিয়। আর যাঁরা ভাবছেন বাবুল সুপ্রিয় ভুল পার্টিতে ছিলেন, তাঁরা হয়তো বাবুলের গত সাড়ে সাত বছরের কর্মকাণ্ড ভুলে গেছেন।
বাবুল সুপ্রিয় ২০১৪-১৫ সাল থেকেই আসানসোল ও সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে বিজেপির সাংগঠনিক বিস্তারের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের উপর জোর দেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে, উত্তর ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দু উৎসব “রাম নবমী” পশ্চিমবঙ্গে জোর করে পালন করার অজুহাতে নানা অঞ্চলে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু করে আরএসএস। তার মধ্যে অন্যতম হল আসানসোল ও রানীগঞ্জ। আসানসোলের হিংসায় মৃত্যু হয় এক হিন্দু মহিলার ও এক মুসলিম কিশোরের। কিশোরের বাবা, নূরানী মসজিদের ইমাম, মওলানা ইমদাদুল রাশিদী তাঁর শান্তির বাণী দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মন জয় করেন। সাম্প্রদায়িক হিংসা ও দ্বেষ বর্জন করে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দেন। ঠিক তখনই, বাবুল সুপ্রিয় কিন্তু ক্রমাগত তাঁর মনিব মোদীর কথা শুনে, মোদীর মতন করে সাম্প্রদায়িক হিংসায় উস্কানি দেন।
পূর্ব উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে দলে দলে ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী এনে আর আসানসোল অঞ্চলের অবাঙালি দুষ্কৃতীদের সাহায্যে বিজেপি মুসলিম অধ্যুষিত রেল পাড় অঞ্চলে বারবার হামলা চালায়। বাবুল তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কে গালাগাল করেন, “জিহাদী” বলেন ও মিথ্যা খবর ছড়িয়ে হিংসায় ইন্ধন দেন। প্রশাসন কেও হিংসা দমনের কাজ করতে তিনি বাঁধা দেন আর “ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার হুমকি দেন”। রাজ্য প্রশাসন কোন অজানা কারণে তাঁর নামে কিন্তু চার্জশিট দেয়নি। তাই একটি গণহত্যাকারী দলের হয়ে আসানসোল অঞ্চলটির দীর্ঘদিনের সম্প্রীতির আর শান্তির আবহাওয়া কে বিষাক্ত করেও, বুক ফুলিয়ে, অকুতোভয় হয়ে, বন্দোপাধ্যায়ের শাসনে বাবুল ঘুরতে পারেন।
এরপরে সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ, এই বাবুল সুপ্রিয় এক দল অবাঙালি ভাড়াটে গুন্ডা নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হামলা করেন। সেখানে ছাত্র ও ছাত্রীদের তিনি শারীরিক ভাবে হেনস্থা করেন। এর বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে গর্জে ওঠে ছাত্ররা, আর পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হতেই লেজ গুটিয়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বীর সেনাবাহিনী কে সেদিন যাদবপুর ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়। বাবুলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে গুন্ডা লেলিয়ে দেয় বিজেপি। তাঁদের বাড়ি গিয়ে আক্রমণ করে হিন্দি-ভাষী বহিরাগত গুন্ডারা।
এ ছাড়াও নানা সময়ে তিনি মুসলিম বিদ্বেষী কথা বলেছেন, মহিলাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছেন, নির্বাচনের লাইনে দাঁড়ানো এক মহিলার গায়ে ধাক্কা মেরে তাঁকে লাইন থেকে বের করে দিয়েছেন। এই হচ্ছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বাবুল সুপ্রিয়ের কার্যকলাপ। এ ছাড়াও তিনি দেশজোড়া বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু – বিরোধী জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) সমর্থন করেন, যার ফলে অসম রাজ্যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তু আজ বেনাগরিক হচ্ছেন। মোদী আর শাহের সাথে হাত মিলিয়ে বাবুলও পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মুসলিম তাড়ানোর নাম করে এনআরসি করিয়ে দলিত, আদিবাসী ও দেশভাগের শিকার হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব কাড়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হন। বাঙালি-বিরোধী এই ষড়যন্ত্রে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে লিপ্ত হয়ে বাবুল প্রমাণ করেছিলেন তিনি কত বড় বাঙালি বিদ্বেষী।
বাবুল সুপ্রিয় সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন নীতিগত কারণে না। সেটা করার থাকলে তিনি ২০১৪ সালেই দল ছাড়তে পারতেন। বাবুল সুপ্রিয় সক্রিয় রাজনীতি থেকে অংশ নিচ্ছেন কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ নেই আর তাই ক্ষমতার মাখন তিনি খেতে পারবেন না। এ ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের কোটার থেকে মোদী উত্তরবঙ্গে দাঙ্গার আগুন জ্বালানো নিশীথ প্রামাণিক আর জন বার্লা কে এবং দক্ষিণবঙ্গে ভাল ফল করা বাঁকুড়ার সুভাষ সরকার কে মন্ত্রিত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। বাবুলের কপালে কেন্দ্রেও মন্ত্রিত্ব নেই। ফলে শুধুই আসানসোলের সাংসদ হয়ে থাকতে, “কমন নাউন” হয়ে থাকতে “প্রপার নাউন” বাবুলের স্বাভাবিক ভাবেই আর ভাল লাগবে না।
বাবুল বিজেপি ছাড়ছেন না, তিনি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ছাড়ছেন না, মুসলিম বিদ্বেষ ছাড়ছেন না, তিনি ছাড়ছেন শুধু পদ আরও বড় পদ পাওয়ার জন্যে। তিনি যদি আরও বড় পদ পান তাহলে তিনি আবার তাঁর মনিব মোদীর গোয়ালে ফিরে আসবেন। সেই রাস্তা তিনি খোলাই রাখছেন। আর বিজেপি ত্যাগ করলেই বাবুল সুপ্রিয় তাঁর কৃত অপরাধের থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারেন না। মোদীর হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অশান্তি ছড়িয়ে, সাম্প্রদায়িক হিংসায় উস্কানি দিয়ে, গণহত্যাকারী বিজেপি আর আরএসএস এর হয়ে কাজ করে কি আজ শুধু অবসর গ্রহণের কথা বলেই বাবুল নিষ্কৃতি পাবেন?
কেন বন্দোপাধ্যায়ের সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তিন বছরেও? কেন তাঁকে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করা হয়নি সাম্প্রদায়িক হিংসায় উস্কানি দেওয়ার ঘটনায়? কেন আসানসোল দাঙ্গার তদন্তের চার্জশিট বাবুল সুপ্রিয় কে নিয়ে নিশ্চুপ? যে মানুষটি আসানসোল শহরের কেউই না বরং নিজের গানের কারিয়ার শেষ হওয়ায় শহরের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঘটিয়ে নির্বাচন জিতে সেই শহরেই আগুন লাগিয়েছেন এই কারণে যে তাঁর বাড়ি এই আগুনে পুড়বে না, তাঁর পরিবার এই হিংসায় আক্রান্ত হবে না, তাঁকে কি আসানসোল বাসী, সচেতন, গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষেরা ক্ষমা করবেন?
তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের উচিত বাবুল সুপ্রিয় ও অন্য বিজেপি এবং আরএসএস নেতাদের ২০১৮ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসায় ভূমিকা খতিয়ে দেখা, তদন্ত করা ও তাঁদের কে আদালতে তোলা যাতে এই হিংসায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ ন্যায় পান। বাবুল সুপ্রিয় বা তাঁর মতন দাঙ্গাবাজ রাজনীতিবিদেরা যদি আইনের থেকে শত যোজন দূরে থাকতে সক্ষম হন তাহলে যে কোন বহিরাগত শক্তি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াতে সাহস পাবে। বাবুল কে নিয়ে যাঁরা আশাবাদী হচ্ছেন, ভাবছেন তিনি মোদী বিরোধিতা করবেন, তাঁদেরও জেনে রাখা ভাল যে তিনি বিজেপি আর আরএসএস এর নীতির কট্টর সমর্থক তার ফলে কোনদিনই তিনি ফ্যাসিবিরোধী, এমন কি সংসদীয় ভাবে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের আপন কোনদিনই হবেন না। তাই বাবুল সুপ্রিয় কে নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা না করে তাঁকে তাঁর দুষ্কর্মের জন্যে যেন আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়, সেই দাবিতে আজ আন্দোলন হওয়া উচিত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে।