কয়েকদিন আগেই কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল থেকে গ্রেফতার হলেন এক দল ছাত্র ছাত্রী। কেন? কারণ তাঁরা আন্দোলন করছিলেন স্কুল-কলেজ খোলার দাবিতে। তাঁদের দাবি ছিল প্রায় ৫০০ দিনের উপর বন্ধ স্কুল-কলেজ খুলে, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে শিক্ষার ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করা হয়েছে অনলাইন শিক্ষার নামে, তা অবিলম্বে শেষ করা হোক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের মা-মাটি-মানুষের সরকার এই দাবিকে শুধু নস্যাৎই করেনি, পুলিশী দমন পীড়নের সাহায্যে ছাত্র আন্দোলন কে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করলো। এর বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো বিরোধী দল কে সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নামতে দেখা গেল না।
যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ২৫শে মার্চ ২০২০ থেকে চাপিয়ে দেওয়া দেশ জোড়া সর্বনাশা লকডাউনের বিরোধিতা বন্দোপাধ্যায় করেছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজের সরকার আজ পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করেনি যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে তৃণমূল কংগ্রেস সত্যিই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরোধী।
এর আগে, লোকাল ট্রেন চালানোর দাবি তোলা আন্দোলনকারীদের পড়তে হয়েছে পুলিশী সন্ত্রাসের মুখে। নির্দ্বিধায় রাজ্যের বাসিন্দাদের সমন পাঠিয়ে কেন্দ্রের রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী (আরপিএফ) জানতে চেয়েছে তাঁদের আন্দোলন করার কারণ কী? এই ঘটনার পরেও কিন্তু উদ্ভট যুক্তি দিয়ে লোকাল ট্রেন চলতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী। তারপরেও নানা কারণে, নানা গণআন্দোলন কে পড়তে হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণের মুখে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতের মাত্র ৯% স্কুল ছাত্রদের কাছে স্মার্ট ফোন আছে। প্রায় ৫৬% ছাত্ররা লেখাপড়া করা ছেড়ে দিয়েছে অনলাইন শিক্ষার কারণে, যার মধ্যে শহরাঞ্চলের ১৯% আর গ্রামাঞ্চলের ৩৭% ছাত্র-ছাত্রী আছেন। শহরাঞ্চলের ৩৪% আর গ্রামাঞ্চলের ৩৫% ছাত্র-ছাত্রী শুধু মাঝে মধ্যে পড়াশুনো করতে পারছেন। শহরাঞ্চলের মাত্র ২৮% ও গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৮% ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করতে পারছেন।
একদিকে বেসরকারি স্কুলগুলো, যাদের বেতন লকডাউনের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের কর্মসংস্থান চলে গেলেও এক পয়সাও কম হয়নি, যেমন নিজেদের অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, সরকারি স্কুলগুলোর বেশির ভাগ সেই কাজ করে উঠতে সক্ষম হয়নি। অন্যদিকে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে শুধু যে গ্রামাঞ্চলের গরিব পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা যে অনলাইন শিক্ষার কারণে শিক্ষা লাভের থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাই নয়, বরং একটা বড় অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেও কিন্তু কলেজে বা উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হতে পারছেন না। ফলে একটা বড় অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার থেকে।
এই সময়ে, বিজেপি-বিরোধী হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করতে বন্দোপাধ্যায়ের উচিত ছিল করোনা বিধি মেনে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া, গরিব ও প্রান্তিক ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে বঞ্চিত না হন সেই ব্যবস্থা করা ও ড্রপ আউট, বা শিক্ষা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা রোখা, যাতে করে কোনো ভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত যাতে অন্ধকার না হয়। কিন্তু তার বদলে তিনি কী করলেন?
বন্দোপাধ্যায় একদিকে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড শুরু করে, রাষ্ট্রের ঘাড়ে ন্যস্ত শিক্ষার দায়িত্ব অনায়াসে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে অল্প বয়স থেকেই, মার্কিন ছাত্র সমাজের মতন, চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তার বন্দোবস্ত করলেন। অন্যদিকে তিনি নির্লিপ্ত ভাবে শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথে চলার মোদী সরকারের নির্দেশ মেনে নিলেন। যখন মেডিক্যাল শিক্ষার জন্যে বাধ্যতামূলক করা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি-কাম-এন্ট্রান্স টেস্ট (নীট) এর বিরুদ্ধে তামিলনাড়ু সরকারের ন্যায্য সংগ্রামের পাশে দাঁড়ালেন না বরং গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বনাশকারী, রাজ্য বোর্ডের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বৈষম্য মূলক নীট কে মেনে নিলেন।
এহেন কাজকর্মের পরে, কী ভাবেই বা বন্দোপাধ্যায় এক দল ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবি মেনে নেবেন? চাবুক তো তাঁকে চালাতেই হবে। তাই স্বাভাবিক কারণেই, ফ্যাসিবাদী রাজনীতির নিয়ম কানুন মেনেই, তাঁর সরকার আক্রমণ নামিয়ে এনেছে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের দমন করতে, নিপীড়ন করতে। ২০২৪ এর নির্বাচনে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়বে কি না, তা পরে জানা গেলেও, ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের পছন্দের শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্ট হওয়ার দৌড়ে যে তিনি কোনো ভাবেই পিছিয়ে থাকবেন না, কলেজ স্ট্রিট থেকে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রেফতার করে সেই কথাই জানান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।