উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মীরাট, সাহরানপুর, শামলি, মুজাফফর নগর প্রভৃতি জেলা আখ চাষের জন্যে বিখ্যাত। আর আখ চাষীদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন (বিকেইউ), যা মুখ্যত এই অঞ্চলের জাট সম্প্রদায়ের ধনী ও মধ্য কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করে। এই অঞ্চলের আরও একটা পরিচয় ছিল – ২০১৩ সাল থেকে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলো ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তার পিতৃপ্রতিম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সাম্প্রদায়িকতার গবেষণাগারে পরিণত হয়। কেন বলা হচ্ছে “পরিচয় ছিল”? এর কারণ, ২০২১ সালে এসে, হাওয়া ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। মুজাফফর নগর কিষান মহাপঞ্চায়েত দিল সেই সঙ্কেত।
৫ই সেপ্টেম্বর ২০২১ এ মুজাফফর নগর দেখলো এক নতুন ভোরের আলো। যে মুজাফফর নগর ভারতে কুখ্যাত হয়েছিল ২০১৩ সালের মুসলিম নিধন যজ্ঞের জন্যে, যে মুজাফফর নগরের মুসলিম গণহত্যার ভিত্তিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে গোটা উত্তরপ্রদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিজয়ী হন, সেই মুজাফফর নগর থেকেই মোদী সরকারের পতনের ডাক দেওয়া হল। ডাক দিলেন বিকেইউ নেতা রাকেশ টিকায়েত। সেই রাকেশ টিকায়েত যিনি নিজের ভাই নরেশ টিকায়েতের সাথে মিলে বিজেপি আর আরএসএস কে ২০১৩ তে মুজাফফর নগরে স্থান করে দিয়েছিলেন, জাট কৃষকদের মুসলিম জাটদের (মুল্লা জাট) হত্যা করতে ইন্ধন দিয়েছিলেন, মহাপঞ্চায়েত করে মুসলিমদের থেকে জাট কৃষকদের আলাদা করেছিলেন।
এইবারও সেই মহাপঞ্চায়েত হল, তবে কৃষকদের নিজস্ব মহাপঞ্চায়েত– কিষান মহাপঞ্চায়েত হল। স্থান সেই মুজাফফর নগর আর স্লোগান উঠলো বিজেপি আর আরএসএস এর বিরুদ্ধে, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আর ঘোষণা হল যে ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কে উত্তরপ্রদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। আর এই উচ্ছেদের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলেন সেই কৃষকেরা যাঁদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চায় মোদী সরকার আর বিজেপি।
গত ৫ই সেপ্টেম্বর যখন কিষান মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হল মুজাফফর নগরের ইন্টার কলেজের ময়দানে, তখন প্রায় ২৫ লক্ষ কৃষক সেখানে যোগদান করেন। লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী কৃষক যাঁরা গত নয় মাস ধরে মোদী সরকারের তিনটি কৃষক-বিরোধী আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লীর সীমান্তে আর পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরত, তাঁরা এসে যোগ দিলেন এই কিষান মহাপঞ্চায়েতে, যেখান থেকে টিকায়েত ঘোষণা করলেন যে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিকেইউ আবার তার পুরানো স্লোগান, আলাহু আকবর-হর হর মহাদেব, ব্যবহার করবে। ২০১৩ সালে যখন মুসলিম গণহত্যার মাধ্যমে বিকেইউ কে বিভক্ত করা হয়, তখন এই স্লোগান দেওয়া বন্ধ করা হয় টিকায়েতদের পক্ষ থেকে, বিজেপি ও আরএসএস এর চাপে। এই স্লোগানের উৎপত্তি হয়েছিল রাকেশের প্রয়াত পিতা, বিখ্যাত কৃষক নেতা মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের আমলে, হিন্দু আর মুসলিম জাট কৃষকদের ঐক্য কে তুলে ধরতে।
যে মুজাফফর নগর থেকে একদিন তাঁরা উত্তরপ্রদেশ ও ভারত জয়ের অভিযান শুরু করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষের ঘাড়ে চেপে, সেই মুজাফফর নগরে লক্ষ লক্ষ কৃষককে মোদীর বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে দেখে, বিজেপি নিপাত যাক স্লোগান দিতে দেখে ও টিকায়েতের মতন নেতা আবার স্টেজ থেকে ঘোষণা করায় যে কৃষকেরা নির্দ্বিধায় আল্লাহু আকবার-হর হর মহাদেব বলবেন দেখে বিজেপি ও আরএসএস ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
এর মধ্যেই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের বিউগল বেজে গেছে। গত বার বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ১৪ দিনের মধ্যে আখের দাম পাইয়ে দেবে কৃষকদের চিনি কল মালিকদের থেকে, আর পুরানো বকেয়া ১২০ দিনের মধ্যে পাইয়ে দেবে। কিন্তু সরকারি হিসাবেই ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ₹২৬,০০০ কোটির উপর আখের বকেয়া ছিল। ন্যাশনাল হেরাল্ড একটি রিপোর্টে জানিয়েছে যে ২০২০ সালের বকেয়া এখনো যেমন পাওয়া যায়নি তেমনি ২০২১ সালের জিরো প্রাইস কুপন পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে গত তিন বছর ধরে যোগী আদিত্যনাথের সরকার আখের স্টেট-অ্যাডভাইজড প্রাইস (এসএপি) বৃদ্ধি করেনি। ফলে আখ চাষীদের বিস্তর ক্ষতি হয়েছে।
তবে ভোটের দামামা বাজতেই সুর পাল্টেছে বিজেপি। কৃষক আন্দোলন যে কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করেছে তা দেখা যাচ্ছে সরকারের মিথ্যার বেসাতি দিয়ে নিজের ঘর গোছানোর কার্যকলাপ দেখে। ইন্ডিয়া টুডে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় একটি আবেদন করে জেনেছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের নাকি কোনো আখের বকেয়া নেই। এটা যদিও সরকারি হিসাব, যাতে চিনি কলের মালিকদের বকেয়া জড়িত নেই, কিন্তু যোগী সরকার তাও চুপ না থেকে হঠাৎ আগষ্ট মাসে ঘোষণা করে যে আখের বকেয়া অর্থের ৭৫% নাকি মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বার যদি আখের বকেয়া অর্থের ৭৫% দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেও সম্পূর্ণ বকেয়া কে কেমন করে শূন্য দেখাচ্ছে সরকার ইন্ডিয়া টুডে কে দেওয়া জবাবে?
কৃষক মহাপঞ্চায়েতের পরে এই বকেয়ার কথা গোটা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে উঠবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন জ্বলন্ত অবস্থায় থাকার ফলে চিনি কল মালিকদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম জোরদার হচ্ছিল না। তাঁরা দরদাম করতে পারছিলেন না সংঘবদ্ধ ভাবে এই বিভাজনের কারণে। এখন, মোদীর তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করে, বিশেষ করে ২৬ জানুয়ারি কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে যখন বিজেপি গাজীপুর বর্ডার থেকে রাকেশ টিকায়েত কে উচ্ছেদ করতে যায়, তখন তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে যে ভাবে দলে দলে উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের হিন্দু আর মুসলিম জাট কৃষকেরা তাঁর পাশে দাঁড়ান, আন্দোলনে সামিল হন, মহাপঞ্চায়েত করে বিজেপি কে একঘরে করেন, যেভাবে তাঁরা উদ্ধত শির হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে টিকে আছেন, তার ফলে তাঁদের মধ্যে আবার ঐক্য গড়ে উঠছে, তাঁরা নিজেদের স্বার্থে চিনি কল মালিকদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন ইতিমধ্যেই।
এই লড়াই থেকে তাঁদের বিরত করতে আর সমগ্র কৃষক আন্দোলনটা ধ্বংস করতে বিজেপি-আরএসএস আর মোদী সরকারের কাছে এখন বিরাট আকারের একটি সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু খারাপ সময় যাকে বলে, বিজেপি-আরএসএস দাঙ্গা করার আগেই কৃষক নেতারা জানিয়ে দিলেন এই রকম সম্ভাবনার কথা। তাঁরা সাবধান করলেন যেন কৃষকেরা কোনো ভাবেই কোনো সাম্প্রদায়িক উস্কানির ফাঁদে না পড়েন, পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় জড়িয়ে না পড়েন। মুজাফফর নগর কিষান মহাপঞ্চায়েত থেকে কৃষকদের সাবধান করে দেওয়া হয় যে বিজেপি যে কোনো জঘন্য চক্রান্ত করতে পারে, যে কোনো হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী নেতা কে খুন করিয়ে দায় চাপিয়ে দিতে পারে মুসলিমদের উপর আর তার মাধ্যমে শুরু করতে পারে কোনো বড়সর দাঙ্গা। এই ভাবে পদে পদে কৃষকেরা জানলেন কী কী ভাবে তাঁদের ন্যায্য সংগ্রাম কে ধ্বংস করতে পারে বিজেপি।
মুজাফফর নগর কিষান মহাপঞ্চায়েত থেকে ঘোষণা করা হয় শুধু পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেই না, বরং গোটা উত্তরপ্রদেশে, বিজেপির শক্ত ঘাঁটিগুলো সমেত, প্রায় ১৭টি মহা সমাবেশ করবে কৃষক আন্দোলনের কর্মী আর নেতারা। এর ফলে যে বিজেপি হেঁচকি তুলছে তা বলাই বাহুল্য। এর সাথেই যখন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময়কার “নো ভোট টু বিজেপি” (বিজেপি কে একটিও ভোট নয়) কায়দায় প্রচার উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি আর রাষ্ট্রীয় লোক দলের (আরএলডি) সাথে মিলে তৈরি করতে পারে টিকায়েত ও অন্য কৃষক নেতারা, তাহলে অন্তত নির্বাচনী ময়দানে হয় বিজেপি কে হিংসার সাহায্যে ভোটে জিততে হবে আর না হয় ব্যাপক নির্বাচনী কারচুপি করতে হবে। কী হবে ২০২২ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে তা এখন থেকে বলা যাবে না, তবে হাওয়া যে দিকে ঘুরছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপক বিরোধী ভোট কাটাকাটি না হলে—সৌজন্যে আচমকা ব্রাক্ষণ তোষণে লিপ্ত হওয়া মায়াবতী ও তাঁর বহুজন সমাজ পার্টি এবং মুসলিম ভোটের মেরুকরণ করতে চাওয়া আসাদ উদ্দিন ওয়াইসির সারা ভারত মজলিস-এ-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমীন (এআইমিম)—বিজেপি কে ভীষণ চাপে পড়তে হতে পারে। কৃষক আন্দোলন কে হালকা ভাবে নিয়ে আজ অবধি বিজেপি বারবার চোট খেয়েছে, এইবারও যদি মোদী সরকার কৃষকদের স্বার্থ-বিরোধী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দ্বারা চাপানো কৃষি আইনগুলো বাতিল না করে, তাহলে বিজেপির কপালে সত্যিই দুঃখ আছে।