বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কী ধরনের রাজনীতি হচ্ছে?

সম্পাদকীয়

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা উৎসবের সময়েই তাঁদের উপর আক্রমণ নেমে আসলো বাংলাদেশে। এই ঘটনার পরে পদ্মা ও মেঘনা দিয়ে অনেক পানি বয়ে যাওয়ার পরেও, ঢাকার শাহবাগ থেকে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা, সর্বত্রে প্রতিবাদে মুখর নাগরিকদের বিক্ষোভের পরেও, শান্তিতে নেই বাংলাদেশের হিন্দুরা। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী ভারতের রাজনীতিতে, যেখানে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

বিজেপি ও তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় খুবই আনন্দিত। কারণ, এই হিংসার উদাহরণ দিয়ে ভারতে ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে, বাঙালি হিন্দু সহ অবাঙালি হিন্দুদের একটা বড় অংশ কে ধর্মীয় মেরুকরণের শিকার বানানো যাবে। কিন্তু সেই কাজে বিজেপি বা আরএসএস এগিয়ে গেলেও বাকি ধর্মনিরপেক্ষ বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়া দলগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দলগুলো, এই ঘটনা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছে না। 

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে কোনো জোরালো বক্তব্য রাখেনি। এই চুপ থাকাটা ইঙ্গিত দিল যে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে নিজের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক কে চটাতে চাইছে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনো মুসলিমই বাংলাদেশের মুসলিম দাঙ্গাকারীদের পক্ষ অবলম্বন করেননি। বরং গোটা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের সহানুভূতি ও সংহতি বাংলাদেশের আক্রান্ত হিন্দুদের দিকে গেল, কারণ এক দেশের নিপীড়িত সংখ্যালঘু হয়ে তাঁরা অন্য দেশেরও সংখ্যালঘুদের বেদনা যেমন উপলব্ধি করতে পারেন, তেমনি তাঁরা জানেন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসা কে শিখন্ডি করে, তাঁদের উপরেও আক্রমণ নামিয়ে আনতে পারে বিজেপি ও আরএসএস। 

মুসলিমদের না চটানো যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকতো, তাহলে কেন বন্দোপাধ্যায় ঈদের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করবেন করোনা ভাইরাসের নাম করে, কেন মিলাদ-উল-নবী অনুষ্ঠানের অনুমতি দেবেন না করোনার নাম করে, আর সারা বাংলায় দুর্গা পূজা হতে দেবেন, বাঁধন-হারা ভিড় হতে দেবেন? তার মানেই তাঁর রাজনীতির মধ্যে সুপ্ত ইসলামবিদ্বেষ রয়েছে। 

বন্দোপাধ্যায় আর বিজেপি কে একই ছাঁচে ফেলে বিরোধিতা করেও প্রধান বিরোধী না হতে পারা কংগ্রেস ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] কিন্তু আরও মুশকিলে পড়েছে। একদিকে তাঁদের দ্বারা নব্য লেনিন সাজানো আব্বাস সিদ্দিকী হঠাৎ “কল্লা ফেলার” হুমকি দিল তাঁদের যাঁরা নিজেকে সেকুলার বলে, তাও আবার যখন তাঁর নিজের দলের নাম “ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট”। পরে আবার কংগ্রেস আর সিপিআই (এম)-এর চাপে পড়ে সিদ্দিকী ক্ষমা চাইলেন, বললেন তাঁর এই কথা বলা উচিত হয়নি আর ওটা নাকি “স্লিপ অফ টাং” বা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া কথা। 

যদিও পশ্চিমবঙ্গের কোনো মুসলিম সিদ্দিকীর কথা পাত্তা দেননি। কোনো মুসলিম হিন্দুদের উপর আক্রমণ করতে যাননি, বরং তাঁরা সংঘবদ্ধ ভাবে সিদ্দিকীর নিন্দা করেছেন, তবুও এই পীরজাদার হুমকি কে ব্যবহার করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বাজার গরম করা শুরু করে। ভীত-সন্ত্রস্ত দলিত বাঙালিদের, যাঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ থেকে দেশভাগের শিকার হয়ে ভারতে ছিন্নমূল অবস্থায় বাস করছেন, যাঁদের নাগরিকত্বের অধিকার মোদী সরকার জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) করে কেড়ে নিতে চাইছে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা দেখিয়ে নিজের দিকে টেনে নিতে চাইছে বিজেপি ও আরএসএস।  

জোট শরিকের এহেন মন্তব্য নিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পড়া সিপিআই (এম) ও কংগ্রেসের সময় লেগে গেল বিবৃতি দিতে। মোটামুটি তাঁরাও সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির চক্রান্ত ও সংহতির পুরানো বার্তা দিল। রাজ্যের অন্য তথাকথিত বাম আর প্রগতিশীল ঘরানার লোকেরা ব্যস্ত ছিল হয় মুসলিম মৌলবাদ কে নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে না হয় বাংলাদেশের কিছু মন্দির ও প্যান্ডেলের বাইরে সেখানকার মুসলিমদের পাহারা দেওয়ার ছবির কোলাজ দেখাতে। 

এরই মধ্যে একদল লোক, বৈচিত্রময় যাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান, হঠাৎ শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ সরকার কে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলেন। অনেক বামপন্থী আর তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এই কোরাসে যোগ দিল। এখানে মোটামুটি নরেন্দ্র মোদী আর শেখ হাসিনার মধ্যেকার মিল কে লুকিয়ে হঠাৎ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে হাসিনার সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা শুরু হল। 

দেখানো হল যে হাসিনা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হওয়া হিন্দুদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছেন, যেখানে মোদী ২০০১ সালের গুজরাট মুসলিম-নিধন যজ্ঞের সময়ে আর ২০২০ সালে দিল্লী শহরের মুসলিম নিধন অভিযানের সময়ে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো তো দূর, এই নিয়ে কোনো বিবৃতিও দেননি। সুশীল বুদ্ধিজীবীরা তুলে ধরছেন যে “ধর্মনিরপেক্ষ” ভারতের মোদী সরকারের পুলিশ কী ভাবে আরএসএস-এর মুসলিম-নিধন যজ্ঞ চলাকালীন গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশ বা দিল্লীতে মুসলিমদেরই বেছে বেছে মেরেছে আর অন্যদিকে ইসলাম যে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম, সেই বাংলাদেশে কী ভাবে মুসলিম পুলিশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের দাঙ্গাকারীদের উপর গুলি চালিয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষা করতে।  

তাঁরা তুলে ধরেছেন কী ভাবে বাংলাদেশের পুলিশ ৪৫ জন দাঙ্গাকারী কে গ্রেফতার করলো আর কী ভাবে ভারতের দিল্লী শহরের পুলিশ মুসলিম-নিধন যজ্ঞের সময়ে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুসলিমদের গ্রেফতার করে মিথ্যা কেস দিল। এই সব উদাহরণ দেখিয়ে, তার সাথে বাংলাদেশের আপামর শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, খেলোয়াড়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের আক্রান্ত হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে, আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা কে তুলে ধরে, শাহবাগের প্রতিবাদ কে তুলে ধরে তাঁরা প্রমাণের চেষ্টা করলেন যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ভারতের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত। 

এইসব বলে হাসিনা যে আসলে মোদীর পুতুল, আওয়ামী লীগ যে আসলে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পুতুল, আর গোটা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মদদ বাদে কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা যে ঘটতে পারে না, তা গোপন করা হল। গোপন করা হল যে মোদী আর আরএসএস-বিজেপির মতন হাসিনাও ২০১৪ সাল থেকে গণতান্ত্রিক মতামত প্রকাশের কণ্ঠরোধ করে, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রাম কে পিষ্ট করে, বাংলাদেশে একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। 

প্রশ্ন তোলা উচিত, এই যে গোটা দেশজুড়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে এখন যে প্রতিবাদ আর ধর্ণা করছেন নানা সংগঠনের নেতৃত্ব, যে ভাবে শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার, জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ চলছে, তাঁরা এই হিংসার ঘটনার সময়ে কেন রাস্তায় নামেননি? কেন গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেননি সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাঁচাতে? কার ইশারায় তাঁরা ঠিক তখন প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ শুরু করলেন যখন হিংসার রেশ কেটে গেল? কী তার কারণ? তাহলে কি বুঝতে হবে যে এই শক্তিগুলো হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার কে চটাতে চায়নি? 

ভারতের রাজনৈতিক শক্তিগুলো যাঁরা আজ হাসিনার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক বলছেন, মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশ সাংবিধানিক ভাবে একটি ইসলামিক দেশ ও সেই দেশের সংবিধান শুরু হয় “বিসমিল্লাহ” দিয়ে। বাংলাদেশ কে ইসলামিক দেশে পরিণত করার, অর্থাৎ ইসলাম কে রাষ্ট্রের ধর্মে পরিণত করার চক্রান্ত ছিল সম্পূর্ণ ভাবে মুক্তি যুদ্ধ বিরোধী।  

মুখে বড় বড় কথা বললেও আজ অবধি হাসিনার সরকার সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম কে বাদ দিয়ে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বানাবার কোনো চেষ্টাই করেননি। বরং একদিকে যখন তাঁর সরকার গণতান্ত্রিক শক্তির কণ্ঠরোধ করেছে, গুমখুন আর “ক্রস ফায়ার” দিয়েছে, তখন অন্যদিকে তাঁরই সরকার ও পার্টি ইসলামিক মৌলবাদীদের আস্কারা দিয়েছে তাঁদের শ্রীবৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে যে হাসিনা কে নিয়ে যাঁরা মৌলবাদ-বিরোধী সংগ্রামের স্বপ্ন ভারতে বসে দেখছেন তাঁদের জেনে রাখা উচিত যে মৌলবাদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক হলেন এই হাসিনা। 

আজ সমস্যাটা বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে কে কী ভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধ করেছে তা নিয়ে অবাস্তব আলোচনা চালানোর নয়। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাজ হল এই উপমহাদেশে যে ভাবে আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক কে ব্যবহার করে, বড় পুঁজির স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ভাঙতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ব্যবহার করা হচ্ছে, তার শিকড়ে গিয়ে আঘাত করা যাতে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার মতন ঘটনা যখনই কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ঘটাতে যাবে তাদের গণ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


আপনার মতামত জানান