গোটা কলকাতা জুড়ে জনসমুদ্র চলেছে দুর্গা পূজার এক প্যান্ডেল থেকে আর এক প্যান্ডেল। বুর্জ খলিফা থেকে লন্ডন টাওয়ার না হয় কলকাতার আকর্ষণ, নানা ধরণের থিম পূজা আর ডিজাইনার প্যান্ডেলের পসার সাজিয়ে বসা মফস্বলেরও জাঁকজমকে কোনো খামতি নেই।
দূর্গা পূজা উপলক্ষ্যে কলকাতা শহর বা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে জনপ্লাবন দেখতে পাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু গত এক বছর সাত মাস ধরে দেশে সরকারি হিসাবে মহামারী চলছে।
করোনা ভাইরাসের জুজু দেখিয়ে বারবার করা হয়েছে লকডাউন, গরিবের পেটে লাথি মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও অসংগঠিত শিল্প কে। আর অন্যদিকে, ওষুধ, চিকিৎসা আর অক্সিজেনের অভাবে গোটা দেশে নিহত হয়েছেন ৪৫১,১৮৯ জন। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বিনা চিকিৎসায় আর বিনা অক্সিজেনে সরকারি ভাবে নিহত ১৮,৯২৪ জন।
দুর্গা পূজা চলাকালীন, সপ্তমীর দিন―মঙ্গলবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২১―সরকারি হিসাবে ৭৬৮জন আক্রান্তের মধ্যে নিহত হন ১০ জন। এই নিহতের সংখ্যা এমন এক সময়ে দেখা গেল যখন রাজ্য জুড়ে হাসপাতালের বেডের বা অক্সিজেনের আকাল দেখা দেয়নি গত এপ্রিল-মে মাসের মতন। তবুও এতগুলো মৃত্যু এই রাজ্যে হল একদিনে।
বর্তমানে সরকারি ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করার অনুমতি দেয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা লোকাল ট্রেন—যা শুধু “জরুরী পরিষেবার” সাথে যুক্তদের যাতায়াতের জন্যে উন্মুক্ত রয়েছে—অসংখ্য গরিব মানুষের অর্থনৈতিক ভাবে সর্বনাশ করেছে। কাজ হারিয়েছেন রেল হকার থেকে শুরু করে সাধারণ দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমিকেরা। তাঁদের এখনো সরকারি ভাবে যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ রাজ্য সরকারের ভয় হল লোকাল ট্রেন চললেই করোনা ছড়াবে।
রাজ্যের সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে কারণ সরকারের বিশ্বাস সেগুলো খোলা হলেই করোনা ছড়াবে। তাই চরম বৈষম্যমূলক অনলাইন শিক্ষার ওকালতি করে চলেছে রাজ্য সরকার। ছাত্ররা সব স্কুল-কলেজ খোলার দাবি নিয়ে আন্দোলন করা মাত্রই কলকাতা পুলিশ তাঁদের আটক করেছে, তাঁদের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ কে দমন করেছে।
অথচ সেই একই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে বড় বড় থিম পূজা দেখছেন। গত এপ্রিল মাস থেকেই তৃতীয় ঢেউয়ের সতর্কতা বাণী প্রচার করেছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেছিলেন ছোটদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের। কিন্তু সেই নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের।
যে রাজ্য সরকার করোনা জুজু দেখিয়ে মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষার নামে গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি চরম বৈষম্য কে প্রশ্রয় দিয়েছে, সেই সরকারই আজ দুর্গা পূজা উপলক্ষে সব করোনা বিধি লঙ্ঘন করে লক্ষ লক্ষ মানুষের সারি কে পথে নামতে দিয়েছে। কেন অনলাইন শিক্ষার মতনই অনলাইন দুর্গা পূজা দর্শন করার ব্যবস্থা প্রচলিত করা হয়নি?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের রথ কে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে পরাস্ত করতে দল বেঁধে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস কে ভোট দেন। সেই তৃণমূল কংগ্রেস, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় সমস্ত ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। অথচ সেই মুসলিমদের উৎসব দুইটি ঈদের সময়ে বারবার করে প্রচার করা হয়—বিজেপি কে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে ইন্ধন যোগানও দেওয়া হয়—যে নামাজ পড়লে করোনা ছড়াবে। যেন জমায়েত ইত্যাদি না হয়, প্রভৃতি।
অথচ সেই সরকারই কিন্তু হিন্দু উৎসবের ক্ষেত্রে একে বারে উল্টোপুরাণ গাইছে। আর কোনো জমায়েত করার উপর নিষেধাজ্ঞা নেই। শুধু পূজার প্যান্ডেলে প্রবেশ নিষেধ কিন্তু বাইরের থেকে ভিড় করে দেখার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা নেই। এহেন কাণ্ড দেখে প্রশ্ন জাগে, করোনা কি শুধু মুসলিম উৎসবে ছড়ায়? করোনা কি শুধু মাত্র স্কুল থেকে ছড়ায়? কেন লোকাল ট্রেন সরকারি ভাবে চালু হলে যে করোনা ছড়ায় বলে বন্দোপাধ্যায় দাবি করেন, তা প্যান্ডেলের বাইরের ভিড় থেকে ছড়ায় না?
প্রতিটি মানুষের যেমন তাঁর ধর্ম পালনের স্বাধীনতা আছে অন্য কে কোনো অসুবিধায় না ফেলে, তেমনি প্রতিটি গরিব মানুষেরও নিজের কর্ম ক্ষেত্রে যাওয়ার অধিকার আছে, গরিব পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার আছে। তাহলে সরকার শুধু নিজের সুবিধামত অন্যের অধিকার খর্ব কী ভাবে করতে থাকতে পারে?