বাংলাদেশে দুর্গা পূজা চলাকালীন ভয়াবহ হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা কে ব্যবহার করে, প্রতিবেশী ভারতের শাসক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি সীমান্তবর্তী বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে গত ২০শে অক্টোবর ২০২১ থেকে এক ভয়াবহ মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
হাজার হাজার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত গুন্ডাবাহিনী কে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ত্রিপুরার সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে।
ধারাবাহিক মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার জেরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ঘর-বাড়ি আর মসজিদ ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতেও আক্রান্ত হয়েছেন মুসলিমেরা, ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁদের মসজিদ।
ত্রিপুরার গোমথি জেলার উদয়পুরের মহারাণী অঞ্চলে ভাঙচুর করা হয় মসজিদে। চন্দ্রপুর, কৃষ্ণনগর, ধর্মনগর, পানিসাগর, প্রভৃতি জেলায় ২০শে অক্টোবর থেকে দফায় দফায় মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার জেরে ভাঙচুর করা হয়েছে মুসলিমদের মসজিদ ও ঘর বাড়ি। অনেক মুসলিমদের বাড়ির সামনে ও মাথায় নাকি গেরুয়া পতাকা টাঙানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মাক্তুব মিডিয়া।
প্রায় ২১টির উপর হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, ১৫জন পুলিশ কর্মী সহ বহু মানুষ আহত হয়েছেন। ভাঙা হয়েছে প্রায় ১৬টির উপর মসজিদ। সবচেয়ে বেশি হিংসার ঘটনা এখনো পর্যন্ত পানিসাগরে ঘটেছে। দফায় দফায় হিংসাত্মক আক্রমণে সেখানে ধ্বংস হয়েছে সাধারণ মানুষের বাড়ি। বৃহৎ মিছিল করে ইসলাম বিদ্বেষী স্লোগান তোলা হয়েছে হিন্দিতে আর মুসলিমদের তাড়ানোর ডাক দেওয়া হয়েছে।
একদিকে যখন গোটা ত্রিপুরা জুড়ে আরএসএস এর শাখা সংগঠনগুলো—বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দল, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (এইচজেএম), প্রভৃতি —দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধেই পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছে। নানা অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও পুলিশ জেনেশুনেই ভিএইচপি, বজরং দল, বা এইচজেএম এর ভাড়াটে বহিরাগত গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
যত দূর খবর পাওয়া গেছে, ত্রিপুরার আদিবাসী সমাজের বৃহৎ অংশ এই মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার বিরোধিতা করছে ও আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে, এই দাঙ্গার হোতা, হিন্দিভাষী উত্তর ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দুরা হলেও, তাদের দলে যোগ দিয়েছে উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের একটি বড় অংশ।
দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ হতে থাকা চাকমা আদিবাসীদের একটা বড় অংশও আশ্চর্যজনক ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সাথে হাত মিলিয়েছে যদিও তাঁদের নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা বিজেপির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত।আশঙ্কা করা হচ্ছে যে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯), কে খুড়োর কলের মতন ঝুলিয়ে, নাগরিকত্ব দেওয়ার টোপ দিয়ে বিজেপি এই চাকমা আদিবাসীদের আর ত্রিপুরার উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে।
সিএএ ২০১৯ এর মাধ্যমে একমাত্র ৩১,৩১৩ জন দীর্ঘস্থায়ী ভিসা-প্রাপ্ত, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে আসা ছয়টি অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষই নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারবেন।
তবুও এর আগে পাশ হওয়া সিএএ ২০০৩ এর অনুসারে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) বানানোর ফলে বেনাগরিক হতে বসা কোটি কোটি দলিত, আদিবাসী ও উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের নিজের দিকে টেনে রাখার টোপ দিতে এই সিএএ ২০১৯ এর মতন একটা ফাঁপা আইনকে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকার ব্যবহার করে চলেছে। আর পাছে ঝুলির থেকে বেড়াল বের হয়ে যায়, তাই এই আইনের নিয়মাবলী এখনো বার করেনি, যাতে জনগণ এই আইনের আসল রূপ না দেখতে পান।
এই প্রথমবার প্রাক্তন আদিবাসী প্রধান রাজ্য ত্রিপুরায় মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটলো। বহু দশক ধরে ত্রিপুরার মাটিতে বাঙালি হিন্দুদের আগমনে ঘটে যাওয়া জনসংখ্যার বিরাট পরিবর্তন হওয়ার ফলে, আদিবাসীদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ভাবে পর্যুদস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে, যে বাঙালি-বিদ্বেষী রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, তার ফলে বাঙালি বনাম আদিবাসী দ্বন্দ্ব এই যাবৎ কাল অবধি ত্রিপুরার, বিশেষ করে পূর্ব ত্রিপুরার প্রধান জাতি দ্বন্দ্ব ছিল। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ছিল না।
বাঙালি মুসলিমদের সাথে আদিবাসী জনগণের কোনোদিন কোনো তিক্ততার ঘটনা সাম্প্রদায়িক হিংসায় গড়ায়নি। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ইসলাম বিদ্বেষ থাকলেও সেই বিষ এত বছরে কোনো দিন প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। কিন্তু ক্রমাগত ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার ও ঘৃণার বাণী ছড়িয়ে, মুসলিমদের প্রতি তিক্ততা কে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের সরকার। এর ফলে ত্রিপুরায় মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ত্রিপুরার জনসংখ্যার প্রায় ৯.২% মুসলিম সংখ্যালঘুরা মূলত বাঙালি, যদিও এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অল্প সংখ্যায় হিন্দি আর উর্দুভাষী মুসলিমও আছেন। ঠিক যে ভাবে উনবিংশ শতাব্দীতে, নমনী অসম বলে পরিচিত পূর্বের অখন্ড বাংলার অংশে উত্তরবঙ্গের থেকে বাঙালি মুসলিম কৃষকদের এনে কৃষি কার্য করিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা, সেই ভাবেই বহু যুগ আগে ত্রিপুরার মাণিক্য রাজত্বে প্রতিবেশী অখণ্ড বাংলার থেকে মুসলিম কৃষকদের তৎকালীন শাসকেরা কৃষির ফলন বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে নিয়ে আসে ও তাঁদের জমি প্রদান করে।
বাংলা ভাগের সময়ে যদিও অনেক মুসলিম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমান বাংলাদেশে, চলে যান, অনেক মুসলিমেরা ত্রিপুরায় থেকে যান। ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের আগমনে ত্রিপুরার জনসংখ্যার জাতিগত সমীকরণে পরিবর্তন হওয়ার পরে বাঙালি মুসলিম কৃষিজীবীরা একেবারেই প্রান্তিক হয়ে যান। বামফ্রন্ট আমলে ৯.২% মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে মাত্র ২.৫% সরকারি চাকরিতে সুযোগ পান। বাকি আদিবাসীদের মতনই তাঁদের কে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভাবে বঞ্চিত করে সাবর্ণ ভদ্রলোক সম্প্রদায়।
যেহেতু এই সংখ্যালঘু মুসলিমদের ভোট নির্বাচনের ফলাফলে কোনো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে না, তাই এদের ত্যাজ্য করে রেখেছে রাজ্যের সমস্ত সংসদীয় দলই। ফলে আজ এই আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে ত্রিপুরায় কোনো দলই নেই। দিল্লীর ত্রিপুরা ভবনে যদিও এক দল বাম ও মুসলিম-পরিচয় রাজনীতির লোকেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই হিংসার ঘটনার সমালোচনা করেছেন, ত্রিপুরার মাটিতে, বিশেষ করে পানিসাগরে কেউই আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াননি, কেউই কোনো ভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলেনি ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে।
যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] ত্রিপুরার উপর ২৫ বছর যাবৎ শাসন করেছিল এই ২০১৮ পর্যন্ত, আজ তাদের দলের একটি গণসংগঠনও আক্রান্ত মুসলিমদের পক্ষে দাঁড়ালো না, নিদেনপক্ষে একটি ধর্মঘটের ডাকও দেয়নি। সমগ্র বামফ্রন্টের তরফ থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে সিপিআই (এম) দলের চিরাচরিত সুবিধাবাদ আর রাজনৈতিক দেউলিয়া আবার প্রকট হয়েছে।
সরকার তাঁর বিবৃতিতে জানান যে সিপিআই (এম) ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরোধিতা করছে ও পুলিশ এবং প্রশাসন কে দাঙ্গা রুখতে নিজের ভূমিকা পালনের অনুরোধ করছে। অথচ যে বিজেপি দাঙ্গা ব্যবহার করে প্রতিটি নির্বাচনে জেতে, যে বিজেপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িক হিংসা রয়েছে, সেই বিজেপি আর তারই মুখ্যমন্ত্রী দেবের সরকার কেন এমন লাভজনক সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা বন্ধ করার প্রচেষ্টা করবে? সিপিআই (এম) তার যেমন জবাব দেয়নি, তেমনি জানায়নি যে কেন একটি স্বঘোষিত বামপন্থী দল হিসাবে তারা রাস্তায় নেমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের রুখছে না।
সিপিআই (এম) না হয় অভিযোগ করবে যে গত তিন বছরে আক্রান্ত হতে হতে, ও আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখার ফলে এই পূর্ববর্তী শাসকদলের এখন তালপুকুরে আর ঘটি ডোবে না, দলে লোকজনও আর নেই, তাই এই অবস্থা। কিন্তু ত্রিপুরা নিয়ে চরম উৎসাহিত মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের বেলায় কী অজুহাত চলবে?
বন্দোপাধ্যায়ের দল তো প্রশান্ত কিশোরের সহায়তায় ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে, কংগ্রেসে আর বিজেপিতে ভাঙন ধরিয়ে নিজের দিকে নেতা টানার চেষ্টাও করছে। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব আজ দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ সাজলেও কেন ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে চুপ করে আছে? কেন প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না ভিএইচপি আর বজরং দলের বিরুদ্ধে?
পাকিস্তানের কাছে ভারতের ক্রিকেট দলের টি-২০ বিশ্বকাপে শোচনীয় হার, হিন্দি সিনেমা অভিনেতা শাহরুখ খানের পুত্র এরিয়ান খানের ড্রাগ সেবন কাণ্ডে গ্রেফতার ও জামিন হওয়া নিয়ে এবং নানা ব্র্যান্ডের উত্তর ভারতের দীপাবলি উৎসবের মরশুমে বাজারে আনা সম্ভারের বিরুদ্ধে হিন্দু-বিরোধী হওয়ার বিতর্ক নিয়ে ভারতের মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম এই মুহূর্তে ব্যস্ত। ত্রিপুরার মতন একটি উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য কে নিয়ে, সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে তাই তাদের কোনো চিন্তা নেই। তাই ত্রিপুরা নিয়ে বেশি কথা খরচ করতে গররাজি দিল্লীর তথাকথিত “জাতীয়” সংবামাধ্যম।
ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে যখন সবাই চুপ করে নিজেদের স্বার্থের ডিমে তা দিচ্ছেন, সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলা জলপাইগুড়িতে লাগলো ভয়ানক মুসলিম-বিরোধী সন্ত্রাসের আগুন। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা ও বিজেপির বিরোধী সেজে দেশের মসনদে বসার লালসা রাখা বন্দোপাধ্যায়ের রাজত্বে মুসলিমেরা আক্রান্ত হলেন আরএসএস এর হাতে।
গত শনিবার, ২৩শে অক্টোবর, জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি অঞ্চলের বাঁকালি বাজার অঞ্চলে ঘটলো রাজবংশী মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তির আক্রমণ। ঘটনার সূত্রপাত হয় সেই দুপুরে, তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে বিজেপির কর্মীদের স্থানীয় ধরমপুর পঞ্চায়েত প্রধানের—যিনি বিজেপির—নিজের কোটার থেকে টিকা বণ্টন করার ঘটনা কে কেন্দ্র করে বচসা শুরু হওয়ার পর থেকে।
প্রথমে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের—যাঁদের বেশির ভাগই রাজবংশী মুসলিম—সাথে বিজেপির গুন্ডাদের মারামারি হলেও, ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক রং নেয় বিকেল বেলার থেকে। একদল আরএসএস এর ভাড়াটে গুন্ডা, যাঁরা আদিবাসী রাজবংশী সম্প্রদায়ের, স্থানীয় সর্দার পাড়ার একটি মসজিদে গিয়ে ইসলাম-বিদ্বেষী স্লোগান দেয়। তাঁরা মসজিদ ও দুইটি মাদ্রাসায় ভাঙচুর চালায় ও কিছু মুসলিমদের বাড়িতে পাথর ছোড়ে।
এর পরে, তাঁরা সেখানকার মসজিদ কে আজান দিতে মানা করে ও জানতে চায় সেখানে বেশি নামাজী কোথা থেকে জড় হয় নামাজ পড়তে। যদিও স্থানীয় মুসলিমেরা মানতে চাননি যে সেখানে নামাজ পড়তে আসা মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেই সন্ধ্যায় স্থানীয় গোলাবাড়ি অঞ্চলের একটি অস্থায়ী মসজিদে (ওয়াক্তিয়া মসজিদ) হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীরা হামলা করে। যখন নামাজ পড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা ইমাম ও মাদ্রাসার ছাত্রেরা দাঙ্গাকারীদের ডাকে সাড়া দেননি, তখন তাঁদের ধরে বেধড়ক মারধর করে এই ফ্যাসিবাদীরা। ইমাম সহ দুই জন নাবালক এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়। আতঙ্ক গ্রস্ত হন অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলিমেরা, যাঁদের বেশির ভাগই রাজবংশী মুসলিম।
যদিও দাঙ্গা করার জন্যে চার জন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও শনিবার থেকে অঞ্চলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়, বিজেপির হামলার ভয়ে গ্রামবাসীরা কেউ পুলিশে রিপোর্ট করেননি। অন্যদিকে বিজেপির স্থানীয় দলিত-নমঃশূদ্র নেতারা এসে মুসলিমদের আশ্বস্ত করলেও স্থানীয় সংখ্যালঘুরা ভয়ে আছেন। এই প্রথম এই অঞ্চলে ভূমিপুত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ চালালো ভূমিপুত্র রাজবংশী হিন্দুরা।
এর ফলে সামনে এল এক নতুন সামাজিক সমীকরণ যা আরএসএস ও বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে করা ধর্মীয় মেরুকরণের ফসল।এ যাবৎকাল অবধি যদিও রাজবংশী হিন্দুদের সাথে উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের দ্বন্দ্ব উত্তরবঙ্গের মূল জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল, এবং রাজবংশী হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল ছিল, এই প্রথম যে ফাটল জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়িতে দেখা গেল তা যে শুধুই বাঁকালি বাজারে আটকে থাকবে না সে কথা বলাই বাহুল্য।
এর আগে কুচবিহারের নির্বাচন সংক্রান্ত হিংসার ঘটনায় দেখা গেছে যে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যেকার সংঘর্ষ মূলত রাজবংশী মুসলিম বনাম রাজবংশী হিন্দু ও উদ্বাস্তু নমঃশূদ্রদের সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে আলাদা কামতাপুর রাজ্যের কার্ড খেলে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লার নেতৃত্বে যে নতুন মেরুকরণ শুরু করেছে আরএসএস তার ফলেও অনেক রাজবংশী হিন্দুর চোখে স্থানীয় মুসলিমেরা বিষাক্ত হয়ে উঠেছেন।
জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়িতে ঘটা মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বা বিরোধী সিপিআই (এম), কংগ্রেস, ইত্যাদি “ধর্মনিরপেক্ষ” দলগুলোর তরফ থেকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়নি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্যে বা বিজেপি ও আরএসএস কে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে ঠেকাতে।
যেহেতু কুচবিহার জেলার বাইরে, বিশেষ করে জলপাইগুড়িতে, মুসলিম সম্প্রদায় রাজনৈতিক ভাবে কোনো প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না নগন্য সংখ্যার জন্যে, তাই ত্রিপুরার মতন এখানেও তাঁদের ব্রাত্য করে রেখেছে সমস্ত সংসদীয় দলগুলো। বর্তমানে তাই এই আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে কোনো অমুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কিছু ছোট বাম দল ছাড়া, গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন না কারণ তার ফলে তাঁদের হিন্দু ভোট কাটা পড়তে পারে।
বিজেপি আর আরএসএস-র টানা গন্ডির মধ্যে, তাদের বেঁধে দেওয়া নিয়মাবলী মেনেই আজ পশ্চিমবঙ্গের মতন একটি অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যেও হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের কথা চিন্তা করে রাজনৈতিক দলগুলো কে কাজ করতে হচ্ছে ও এর ফলে এদের তীব্র ব্রাক্ষণত্ববাদী শাঁসটা ধর্মনিরপেক্ষতার খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ছে। নানা কায়দায় এই সংসদীয় দলগুলো আর কোনো ভাবেই তাঁদের গেরুয়া অন্তর কে গোপন করতে পারছে না।
ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাগুলোর থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে যে চুপ করে থাকার রাজনীতি, যে এড়িয়ে যাওয়ার রাজনীতি বর্তমানে “ধর্মনিরপেক্ষ” হিসাবে বাজার গরম করা রাজনৈতিক দলগুলো করছে, যে ভাবে সংবাদমাধ্যম এই হিংসার খবর চেপে গিয়ে শাসককে অত্যাচার করার সুযোগ করে দিচ্ছে, তার ফলে কিন্তু আগামী দিনে এদের সকলকেই ইতিহাস চিহ্নিত করবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সহচর হিসাবে। ফলে বিজেপি বিরোধিতা এরা কী ভাবে আগামী দিনে করেন সেটাও আজ দেখার বস্তু।