বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ফলে রক্তস্নাত হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সর্ব বৃহৎ উৎসব দুর্গা পূজা। সালাফী ইসলামী সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারালেন দুই জন হিন্দু ও পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন চারজন মুসলিম। হিংসা রোধ করতে আওয়ামী লীগ সরকার আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মোতায়েন করে। তবুও নানা জায়গায় এখনো অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি।
মঙ্গলবার, ১৯শে অক্টোবর, থেকে দশ দিনের জন্যে ২৬টি জেলার পুলিশ কে সতর্ক থাকার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের সাতটি জেলা আছে, রাজশাহী বিভাগের দুইটি, খুলনা বিভাগের পাঁচটি, কুমিল্লা সহ চট্টগ্রাম বিভাগের চারটি, ঢাকার চারটি ও সিলেটের চারটির মধ্যে তিনটি জেলা রয়েছে।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ঘর বাড়ি হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন রংপুর সহ নানা জায়গার আক্রান্ত সংখ্যালঘু পরিবারগুলো। আর এই সময়ে হিন্দু ধর্মের লক্ষী পূজা ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব থাকায় আরও উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার পূর্ণ বৃত্তান্ত
বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার সূত্রপাত হয় কুমিল্লা জেলার নানুয়ার দীঘির পাড়ে একটি দুর্গা পূজার মণ্ডপ থেকে।
বুধবার, ১৩ই অক্টোবর হঠাৎ অভিযোগ ওঠে যে মণ্ডপে ঢোকার রাস্তায় সাজানো নানা হিন্দু সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেব-দেবীর মূর্তির মধ্যে উত্তর ভারতীয় হিন্দিভাষী হিন্দুদের—যাঁদের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই নগন্য তবে প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে—আরাধ্য হনুমানের পায়ের কাছে নাকি ইসলাম ধর্মের পবিত্র বই কোরান শরীফ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এই রকম কাজ পূজা উদ্যোক্তারা বা অন্য ভক্তরা কেউই করেননি। তাঁদের অভিযোগ যে এই কাজ বহিরাগতরা চক্রান্ত করে করেছে।
এই মূর্তির পায়ের কাছে রাখা পবিত্র কোরানের ছবি মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর পরেই কুমিল্লার সেই দুর্গা পূজার উপর আক্রমণ চালায় সালাফী ইসলামী সন্ত্রাসীদের একটি দল। তাঁরা নাকি স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে এসেছিল বলে বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলো কে জানায় স্থানীয় জনগণ।
বিলেতের বিবিসি কে কুমিল্লা জেলার পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক নির্মল পাল বলেছেন, “পূজা বানচালের জন্য পরিকল্পিত ভাবে কোরান রেখে এ ঘটনা ঘটিয়ে তারাই এখন শহর জুড়ে পূজাবিরোধী বিক্ষোভ করছে। কয়েকটি মণ্ডপে হামলার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু পুলিশের বাধায় ভেতরে ঢুকতে না পারলেও গেইট বা সামনের স্থাপনা ভাঙচুর করেছে।”
কুমিল্লার ঘটনায় মোহাম্মদ ফয়েজ আহমদ নামক একজন সহ ৪৩ জন কে অভিযুক্ত হিসাবে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন। সন্দেহ করা হচ্ছে, যে চক্রান্ত করে পূজা মণ্ডপে পবিত্র কোরান শরীফ হনুমান মূর্তির পায়ের কাছে রাখা হয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে।
ঘটনার পরে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের নির্দেশে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ সায়েদুল আরেফিনের নেতৃত্বে, একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে দুর্গা পূজার মণ্ডপে হনুমান মূর্তির পদতলে পবিত্র কোরান শরীফ রাখা নিয়ে। এই কমিটিতে আছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ ও আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকিয়া আফরিন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার, ১২ই অক্টোবর, সন্ধ্যার থেকে বুধবার, ১৩ই অক্টোবর, অর্থাৎ ঘটনার দিন, রাত ২টা পর্যন্ত ওই পূজা মণ্ডপে পূজা-অর্চনা করা হয়। সকাল সাতটা নাগাদ একরাম হোসেন নামক এক ব্যক্তি ৯৯৯ নাম্বারে কল করে খবর দেন যে পূজা মণ্ডপে হনুমানের মূর্তির পায়ের তলায় কোরান শরীফ রাখা আছে।
হোসেনের খবর পেয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম সাদা পোশাকের বাহিনী নিয়ে সেখানে যান ও কোরান শরীফটি নিজের হেফাজতে নেন। সেই সময়েই গ্রেফতার হওয়া ফয়েজ সেখান থেকে ফেসবুক লাইভ করে মুসলিম জনগণ কে উস্কানি দেওয়া শুরু করেন এই বলে যে হিন্দুরা পূজা মণ্ডপে কোরান শরীফের অবমাননা করেছেন।
পুলিশ কে ফয়েজ জানিয়েছেন যে তিনি ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রভাবে উত্তেজিত হয়ে ওই লাইভটি করেন ও তাঁর সাথে অন্য কারুর কোনো সম্পর্ক নেই। কুমিল্লার কান্দিরপাড় খন্দকার হক ম্যানশনে মোবাইল ফোনের দোকানদার ফয়েজ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকলেও করোনা কালে দেশে ফেরেন। তিনি থাকেন নানুয়া দীঘির পাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে দিগাম্বরী তলায়। তবে তাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় এখনো সামনে আসেনি।
ওই লাইভ দেখে যাঁরা অঞ্চলে বিক্ষোভ দেখানোর নাম করে হামলা করতে আসেন তাঁরা কেউই কোনো কওয়ামী সংগঠনের সদস্য হিসাবে পরিচিত নন, এমনকি, এলাকাবাসীর বয়ান অনুসারে, তাঁদের পোশাকও ধার্মিক-নামাজী মুসলিমদের মতন ছিল না। তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ ও অঞ্চলের মানুষের অপরিচিত।
এলাকার মসজিদগুলোর থেকে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার এবং হট্টগোল না করার আবেদন মাইকে করে প্রচার করা হলেও এই তরুণেরা তা কানে দেননি এবং দূর্গা মণ্ডপটির উপর হামলা করেন। প্রায় ৩০০-৪০০ জন দাঙ্গাকারী অঞ্চলে পৌঁছায় এবং সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের শান্ত করতে পৌঁছালেও সেই দাঙ্গাকারীরা কোনো কথা না শুনে সন্ত্রাস শুরু করে এবং ইঁট ছোড়া শুরু করে।
বেলা ১১-১১.৩০ এর মধ্যে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ কে সিটি মেয়র ও অন্য নেতাদের সরিয়ে টিয়ার গ্যাস ও লাঠি চার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
পুলিশ দাবি করেছে নানুয়ার দীঘির দূর্গা পূজার অস্থায়ী মণ্ডপে কোরান শরীফ রাখার ঘটনার মূল দোষী কে সনাক্ত করতে পেরেছে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। তাঁর নাম ইকবাল হোসেন, বয়স আনুমানিক ৩৫, বাবার নাম নূর আহমেদ আলম। হোসেনের বাড়ি কুমিল্লা নগরের সুজানগর এলাকায় এবং তাঁকে সনাক্ত করা গেলেও এখনো গ্রেফতার করা যায়নি কারণ তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন ও ক্রমাগত অবস্থান বদলাচ্ছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন অবশ্য ঘোষণা করে দিয়েছেন যে কুমিল্লার ঘটনার মূল কুচক্রী কে পুলিশ নাকি ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করে ফেলেছে। তবে হোসেন যে গ্রেফতার হয়েছেন সেই খবর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়া অবধি যাচাই করা যায়নি।
নানুয়ার দীঘির পাড়ের অস্থায়ী মণ্ডপের পূজা সহ গোটা কুমিল্লা কোতোয়ালিতে ৭৪টি দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে বেশির ভাগ পূজা মন্দির প্রাঙ্গনে, স্থায়ী মণ্ডপে হয়। যেহেতু নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজাটি অস্থায়ী মণ্ডপে—প্যান্ডেল বানিয়ে—হয় তাই এই মণ্ডপটি রাত ২টার থেকে সকাল ৭টা অবধি অরক্ষিত ছিল।
খবরে প্রকাশ ২০০১ সালে তৎকালীন মন্ত্রী আকবর হোসেন তাঁর বাড়ির সামনে নানুয়া দীঘির পাড়ে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সুধীর চন্দ্র রায় কর্মকারের তত্বাবধানে প্রথম অস্থায়ী দুর্গা পূজা মণ্ডপ স্থাপনের বিষয়ে উৎসাহ দেন। দীর্ঘ ২০ বছর সেখানে শরৎ কালে দুর্গা পূজা হয়ে আসছে। কর্মকারের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর পরিবার এই পূজার দায়িত্ব পালন করেন ও আজ অবধি সেখানে কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়নি।
গোটা বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৩২,১১৮টি দুর্গা পূজা হয়েছে ও তার মধ্যে ২৩৮টি পূজা রাজধানী ঢাকায় হয়েছে।
কুমিল্লার থেকে গোটা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ছড়িয়ে যায় দাবানলের মতন। বান্দরবান, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, গাজীপুর, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলবীবাজার, রংপুর প্রভৃতি জায়গায় হিন্দুদের উপর, তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর, উপাসনালয়ের উপর ও দুর্গা পূজার মণ্ডপের উপর হামলা শুরু করা হয় সংগঠিত ভাবে।
বুধবার থেকে শনিবার অবধি এই অবাধ হিংসার ঘটনায় সহস্র হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ও দোকান ভাঙচুর করা হয়, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত সংবাদের হিসাবে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে দুর্গা মন্ডপে আক্রমণ করার সময়ে পুলিশের গুলিতে চারজন সালাফী ইসলামী সন্ত্রাসী নিহত হয়। অন্যদিকে, নোয়াখালীর চৌমুহনীতে দুই জন হিন্দু সালাফী ইসলামী সন্ত্রাসী আক্রমণে নিহত হন।
প্রান্ত দাস (২০) নামক একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ইস্কন ভক্তের লাশ নোয়াখালী জেলার, বেগমগঞ্জ উপজেলার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার হয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নোয়াখালীর নেতা কিশোর রায় অভিযোগ করেন যে দাস কে চৌমুহনীতে স্থানীয় ইস্কন মন্দিরে হামলার সময় খুন করা হয়েছিল।
এর আগে যতন কুমার সাহা (৪৫) নামক একজন হিন্দু কে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে দুর্গা পূজার উপর হামলার সময়ে খুন করা হয়। নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট শাহ ইমরান সংবাদ মাধ্যম কে জানান যে বেগমগঞ্জ কলেজ রোড ও ডিবি রোড সংলগ্ন অঞ্চলে একটি মিছিল কুমিল্লায় কোরান শরীফের অবমাননার অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে। এর পরেই, সেই মিছিল থেকে একটি দুর্গা পূজা মণ্ডপে হামলা করা হয়। এই হামলায় সাহা নিহত হন।
ইমরান জানান যে এই ঘটনায় প্রায় ১৮ জন আহত হন। এই হিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশও সালাফীবাদী সন্ত্রাসী শক্তির হাতে আক্রান্ত হয়। বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি কামারুজ্জামান শিকদারও এই হিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে গুরুতর আহত হন।
সাহার হত্যার ঘটনা নিয়ে একটি ভুয়া ভিডিও প্রচার করা হয়। মে মাসে ঢাকার পল্লবীতে শিশুপুত্রের সামনে ঘটা নৃশংস সাহিনুদ্দিন হত্যার ভিডিওকে সম্প্রতি নোয়াখালীর সাহার হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বলে দাবি করে ফেসবুকে ছড়ায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দুইটি আইডি। র্যাব তদন্ত করে এই সূত্র পেয়েছে বলে জানায় প্রথম আলো।
উত্তর-পূর্বের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় বৃহস্পতিবার, ১৪ই অক্টোবর, একদল মাদ্রাসা ছাত্র তাঁদের সালাফীবাদী মৌলবীর উস্কানিতে হিন্দুদের দুর্গা পূজার মণ্ডপের উপর হামলা চালায়। এই হিংসাত্মক ঘটনায় প্রায় ২০ জন আহত হয়েছে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর ও উপাসনাস্থলের চরম ক্ষতি হয়েছে।
এই হিংসা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেই পুলিশের উপর মাদ্রাসা ছাত্ররা হামলা চালায়। তাঁদের নির্মম হামলায় গুরুতর আহত হন স্থানীয় নবীগঞ্জ থানার ওসি ডালিম আহমেদ।
সিলেটের জাকিগঞ্জে বৃহস্পতিবার প্রায় ৫০০ জনের একটি দল রাস্তায় দাঙ্গা শুরু করে। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ি ভেঙে দেয়, হিন্দু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলা করে, অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ ৫০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার বান্দরবানের লামাতে সংঘবদ্ধ ভাবে সালাফীবাদী ইসলামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় হিন্দুদের উপর। লামা বাজারে মুসলিম তৌহিদী জনতার ব্যানারে জড় হন কয়েক শো দাঙ্গাকারী। তাঁরা নিকটবর্তী হরি মন্দিরে আক্রমণ করেন, লুঠপাট, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করা হয়।
লামা বাজারের এই দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দেন শাসক আওয়ামী লীগের লামা উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম। তাঁর সাথে ছিলেন ছাত্র লীগের স্থানীয় নেতা মোঃ শাহীন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা হৃদয় হাসান ওরফে জাহিদ (২০) ১৩ই অক্টোবর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয় যে কুমিল্লার কোরান শরীফ অবমাননার অভিযোগ নিয়ে “আন্দোলন” হবে হাজীগঞ্জ বিশ্বরোড থেকে আর সেইদিন সন্ধ্যা ৬টায় সকল “মুসলিম ভাইদের” উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করে।
হাজীগঞ্জের এই মিছিলের থেকেই পরে পূজা মণ্ডপে হামলা করা হয়। পুলিশ, সোমবার, ১৮ই অক্টোবর, ওই হামলার ঘটনায় জাহিদের বাবা দিলওয়ার হাসান (৪২) ও ভাই জুবায়ের হাসান (১৮) কে গ্রেফতার করেছে। জাহিদ, যে একজন ছাত্র লীগ কর্মী হিসাবে পরিচিত, এখনো পলাতক। জাহিদের মা, শাহিদা বেগম, ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নারী কাউন্সিলর ছিলেন।
শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পরে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। হাজার হাজার দাঙ্গাকারী সমগ্র বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন ছড়িয়ে দেয়। সেই শুক্রবার, ১৫ই অক্টোবর, আবার ছিল দুর্গা পূজার শেষ দিন।
জুম্মার নামাজের পরে সিলেটের হাওলাদার পাড়ায় প্রায় ১৫০ জন সালাফীবাদী দুষ্কৃতী হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দুদের দুর্গা পূজার মণ্ডপে ও কালীবাড়ির উপর হামলা করে। আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ পুলিশ প্রশাসনের কাছে মদদ চেয়েও নিরাশ হয়েছেন।
রাজধানী ঢাকায়, জুম্মার নামাজের পরে সালাফীবাদী ইসলামী দাঙ্গাকারীরা একটি বিশাল মিছিল বের করে কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ করে, হিন্দু-বিরোধী স্লোগান তুলে। মিছিলটি রাজধানীর পল্টন ক্রসিং ও বিজয়নগর মোড় পেরিয়ে আসতেই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় ও গোটা অঞ্চল কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ঢাকার তিনটি থানায়——পল্টন, রমনা আর চৌকবাজারে——প্রায় ৪,০০০ জনের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করার মামলা রুজু করা হয়। এর মধ্যে, পল্টন থানায় ২,৫০০ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের ও ১১ জন পরিচিত দুষ্কৃতীর নামে মামলা রুজু হয় যার মধ্যে পাঁচ জন কে গ্রেফতার করা হয়; রমনা থানায় ১,৫০০ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের ও দশ জন পরিচিত দুষ্কৃতীর নামে মামলা দায়ের করা হয়, এর মধ্যে দশ জন কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। চৌকবাজার থানায় ৩৫-৪০ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের ও পাঁচজন পরিচিত দুষ্কৃতীর নামে মামলা করা হয় যাদের পাঁচ জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
শনিবারেও কার্যত বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ফেনীতে হিন্দুরা যখন দুর্গা পূজা মণ্ডপে হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তখন সেই সমাবেশে হামলা করে সালাফীবাদী ইসলামী জঙ্গীরা। এই হিংসার ঘটনায় ৪০ জন গুরুতর ভাবে আহত হন। ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন এই সংঘর্ষ রুখতে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান। তাঁকে অন্যান্যদের সাথে ফেনী সাধারণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রংপুরে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগানো হয় কোনো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে কাবা শরীফ নিয়ে কেউ ব্যঙ্গ করায়। হিংসার ঘটনা ঘটে মৌলবীবাজারে। প্রচুর হিন্দুদের বাড়ি ঘর ভেঙে দেওয়া হয়, উপাসনালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যশোর ও খুলনাতেও নানা স্থানে দুর্গা পূজার মণ্ডপে হামলা করা হয়। লক্ষ লক্ষ হিন্দু এর ফলে চরম অসুরক্ষার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
যদিও পুলিশ মামলা দায়ের করে অনেক অভিযুক্ত কে গ্রেফতার করেছে ও র্যাব-বিজিবি নানা স্থানে টহল দিচ্ছে ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়াস করছে তবুও হিন্দুদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নটির কোনো সমাধান বের হচ্ছে না।
বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক তরজা
কুমিল্লার দুর্গা পূজায় কোরান শরীফ কে অবমাননা করার অভিযোগ নিয়ে সারা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটার পর থেকে রাজনৈতিক চাপানউতর শুরু হয়েছে গোটা দেশ জুড়েই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার কড়া হাতে হিংসা দমন করতে বদ্ধপরিকর ও কুমিল্লার ঘটনার তদন্ত করে কারা এই কাজ করেছে তা বের করে, তাঁদের আইন মারফত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। হাসিনা বলেছেন, সরকার অপরাধীর ধর্ম দেখবে না।
“কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটছে তার তদন্ত হচ্ছে। ব্যাপকভাবেই তদন্ত হচ্ছে। অনেক তথ্যই আমরা পাচ্ছি এবং অবশ্যই এই ধরনের ঘটনা যারা ঘটাবে, তাদের আমরা খুঁজে বের করবো। এটা আমরা করতে পারবো। প্রযুক্তির যুগে এটা বের করা যাবে। সে যেই হোক না কেন, যে ধর্মের হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। আমরা তা করেছি এবং করবো। কিছু মানুষের মধ্যে এই দুষ্ট বুদ্ধিটা আছে। যখন একটা জিনিস সুন্দর ভাবে চলছে সেটাকে নষ্ট করা। বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, এই যাত্রাটাকে ব্যাহত করা আর দেশের ভেতরে একটা সমস্যা সৃষ্টি করা, এ ধরনের কিছু লোক আছে। যারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে না, বিশ্বাস অর্জন করতে পারে না। যাদের রাজনীতি নেই, কোনও আদর্শ নেই, তারাই এ ধরনের কাজ করে। এটা অনেকটাই তাদের এক ধরনের দুর্বলতা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যদি সবাই সচেতন থাকেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের কেন্দ্রীয় পূজা মণ্ডপে হিন্দু ভক্তদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন যে সরকার তদন্তের কাজে অনেক এগিয়ে গেছে ও প্রমাণ সংগ্রহের কাজও চলছে। রবিবার বিকেলে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইতিমধ্যে আপনারা অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন। যেহেতু তদন্ত চলছে, সেহেতু আমি আপাতত আর কিছু বলছি না। তবে যে-ই করে থাকুক, তাকে খুঁজে বের করা হবে। আইন অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।”
“যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা উদ্দেশ্য মূলক। যাঁরা এগুলো করেছেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে করেছেন, সে উদ্দেশ্য কোনো দিন সফল হবে না। কারণ, এ দেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এ দেশ মুসলমান, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ–সবার। সবাইকে নিয়েই এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা মনে করি ও হৃদয়ে ধারণ করি বলেই আমাদের গতি অপ্রতিরোধ্য,” খান বলেন।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন যে কুমিল্লার ঘটনা একটি ষড়যন্ত্রের অঙ্গ। “কুমিল্লায় পবিত্র কোরান অবমাননার ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের, নীল নকশার বহিঃপ্রকাশ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কেউ এ কাজ করবেন, সুস্থ মস্তিস্কের কেউই তা বিশ্বাস করবে না, করতে পারে না। একজন বেকুবও বুঝবে যে এটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রের অংশ,” রাজ্জাক বলেন।
কুমিল্লার ঘটনা কে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মঙ্গলবার, ১৯শে অক্টোবর, ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভেন্যু-স্থিত নিজেদের সদর কার্যালয় থেকে একটি “সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধ” মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ। মিছিল শেষ হয় শহীদ মিনারে গিয়ে। অসংখ্য আওয়ামী লীগ সদস্য এই মিছিলে যোগ দেন, যদিও সেই দলেরই বহু নেতা ও কর্মীরা এই হিংসার ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত।
সরকারপক্ষ এই সব কথা বললেও বা মিছিল করলেও বিরোধী পক্ষও চুপ করে বসে নেই।
রবিবার, ১৭ই অক্টোবর, ঢাকার নয়া পল্টনে তাঁদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে, বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কুমিল্লার ঘটনার ও সমগ্র বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন। আলমগীর বারবার অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন শাসক আওয়ামী লীগের দিকে।
আলমগীর বলেন “পবিত্র কোরান অবমাননা, পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরে নিরাপত্তা বিধান না করে হামলা-ভাঙচুর-সংঘাত-সংঘর্ষকে উস্কে দিয়ে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, মদদ দিয়ে, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চক্রান্তে মেতে উঠেছে সরকার। গণতন্ত্রের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তারা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উপকরণ ছড়িয়ে, সহিংস রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে উদ্ধার কর্তার ভূমিকায় অভিনয় করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুদৃষ্টি পেতে চায়। সরকারের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও এর ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী রক্তাক্ত হিংসাশ্রয়ী ঘটনার আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
“এখন একটি প্রশ্ন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, কে বা কারা পবিত্র কোরান শরীফ পূজা মণ্ডপে নিয়ে গেছে? সরকারের নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাসের পর কেবলমাত্র ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট দুষ্টচক্র ছাড়া দেশের জনগোষ্ঠীর কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ই এই কদর্য কাজ করবে না বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সরকারের মদদেই কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর পাড়ের পূজা মণ্ডপে চক্রান্ত মূলক কুৎসিত কাজটি করা হয়েছে। এর বড় প্রমাণ – ঘটনার পরপরই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা অতিসত্বর পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরগুলোতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পাঠানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এই অনুরোধে সাড়া না দিয়ে অনেক পরে পুলিশ পাঠিয়েছে,” আলমগীর অভিযোগ করেন।
প্রতিবাদ কর্মসূচি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রয়াস
বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে অনেকগুলো সংগঠনই দেশজুড়ে প্রতিবাদ করছে। রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তরফ থেকে গোটা দেশজুড়ে ২৩শে অক্টোবর থেকে বিক্ষোভ ধর্ণা ও অনশন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলোও ঢাকায় ও অন্যান্য শহরে নানা ধরণের বিক্ষোভ কর্মসূচী নিচ্ছে। অনেক বাম দলের নেতাই শাসক আওয়ামী লীগের আস্কারা পেয়েই যে দাঙ্গাবাজেরা গোটা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটিয়েছে, সেই অভিযোগ করছেন।
অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া নানা ছবিতে যেমন দেখা গেছে যে দল বেঁধে হিন্দুদের দুর্গা পূজা উৎসব পাহারা দিচ্ছেন কিছু মুসলিম, তেমনি অনেক মুসলিম সমাজকর্মীরা, বিশেষ করে যাঁরা আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত, হিংসার ঘটনা কম হওয়ার পরে নানা মন্দিরে পাহারা দেওয়া শুরু করলেন, যাতে জঙ্গীদের আক্রমণ থেকে তা রক্ষা করা যায়।
বাংলাদেশের আপামর জনগণের ৮৯% সুন্নি মুসলিম ও মাত্র ৮% হিন্দু হলেও, এই সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ইসলাম প্রচারক হিসাবে——আলেম বা হুজুর——পরিচিত অনেকেই নিজেদের ওয়াজে বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার তীব্র বিরোধিতা করেছেন ও এই কর্মকান্ড কে ইসলাম-বিরোধী বলেছেন।
তবুও, সালাফীবাদের প্রভাবে থাকা জঙ্গী মনোভাবের লোকেরা সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস ) দ্বারা সংগঠিত মুসলিম নিধনের উদাহরণ টেনে, বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা চালিয়েছে। যদিও কেন একজন মুসলিম এই কাজে অভিযুক্ত হয়েছে তা নিয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের হিন্দু মহাজোটের নেতা গোবিন্দ চন্দ্র——যিনি ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আরএসএস-এর উর্দি ধারণ করে প্রকাশ্যে আসেন—একটি চ্যানেলে বাংলাদেশের হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নিয়ে বলতে গিয়ে স্বীকার করেন যে অনেক মুসলিমেরা হিন্দুদের উপাসনালয় রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছেন।
ষড়যন্ত্র না স্বতঃস্ফূর্ত দাঙ্গা?
মোটামুটি গত এক সপ্তাহে কুমিল্লার দুর্গা পূজা কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার যে ঘটনাগুলো ক্রমাগত, অবাধ ভাবে ঘটেছে, যে ভাবে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে ভাবে তাঁদের উপাসনালয়ে ও তাঁদের ব্যবসা বাণিজ্যগুলো কে বেছে বেছে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা তাতে ভাঙচুর করা হয়েছে, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই সব ঘটনা কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ের দুর্গা পূজার মণ্ডপে কোরান শরীফ অবমাননার ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া নয় বরং একটি সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্তের ফসল।
যদি পুলিশের অভিযোগ কে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয় ও ধরে নেওয়া হয় যে কুমিল্লা কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত হোসেনই কোরান শরীফ দুর্গা পূজার মণ্ডপে রেখেছিল, তাহলে প্রশ্ন হল এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার ইন্ধন কে দিল? এটা কি জামাত-এ-ইসলামী বা ছাত্র শিবির করিয়েছে? এই ঘটনা কি বিএনপি বা অন্য বিরোধীরা ঘটিয়েছে? কী পরিচয় এই হোসেন-এর?
কাল হয়তো খুব সহজেই হোসেন কে মানসিক ভারসাম্যহীন বা ইসলাম থেকে বিপথে যাওয়া বলে দাগিয়ে দেবেন সালাফীবাদী মুমিনেরা, যাঁরা ক্রমাগত হিন্দু-বিরোধী সন্ত্রাসের সমর্থন করে এসেছেন। কিন্তু কেন তাঁরা, ইসলামের জ্ঞানে টইটম্বুর হয়েও একটি মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের কীর্তির জন্যে হাজার হাজার হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির, দোকানপাট ধ্বংস করলেন? কী কারণে?
সেটা কি তাঁরা কোনো দিনই জানাবেন? না নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচ করে “মুশরিক”, “মালাউন” বলে চিহ্নিত হওয়া হিন্দু সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপূরণ দেবেন? তাঁরা কি মানবেন যে এই ঘটনায় তাঁরা দোষী?
যে হুজুরেরা ওয়াজে গিয়ে গরম গরম ভাষণ দেন, যাঁদের বেশির ভাগ বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার সময়ে চুপ থাকলেন, কি নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করবেন? ক্ষতিপূরণ দেবেন হিন্দুদের কারণ এক “মানসিক ভারসাম্যহীন” মুসলিমের কাণ্ডে তাঁদের ঘর-বাড়ি, উপাসনালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য সব শেষ হয়ে গেছে?
সরকার পক্ষ বারবার চক্রান্তের কথা বলে আওয়ামী লীগ-বিরোধী শক্তিকে দোষারোপ করলেও নিজের দোষটা তাঁরা ঢাকতে পারবেন না। অনেকে আঙ্গুল তুলছেন উগ্রপন্থী জামাত-এ-ইসলামী, ছাত্র শিবির বা অন্য সকল সাম্প্রদায়িক শক্তির দিকে। কিন্তু হাসিনা সরকারের দমন পীড়নের ফলে জামাত বা শিবির আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। বিএনপির মতন বড় দলেরও আজ টিমটিম করে বাতি জ্বলছে।
গোটা বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগের লোকেরা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচনে জিতছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কোন শক্তির এত বড় সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থবল আর, অবশ্যই, সাহস থাকবে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন জ্বালাবার?
হাসিনার সরকার যদি না চাইতো তাহলে কি সারা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে পারতো? বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, যে সরকারের মদদেই কুমিল্লার ঘটনা ঘটেছে, যে সরকার চাইলে কড়া হাতে পরিস্থিতি শুরুর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, তা কি মিথ্যা?
বাংলাদেশ সরকার কী ভাবে র্যাব আর বিজিবি নামিয়েও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারলো না? কী ভাবে যে ৪৩ জন কে গ্রেফতার করা হল তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা থাকে? কী ভাবে তাহলে লামা বাজারে আওয়ামী লীগের নেতা দাঙ্গাকারী জঙ্গীদের নেতৃত্ব দেন? কী ভাবে হাজীগঞ্জে ছাত্র লীগ নেতা দাঙ্গাকারীদের জড়ো করে হাঙ্গামা করেন?
যে ভাবে গোটা বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা দাবানলের মতন ছড়িয়েছে আর যে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের তাঁতিয়ে তোলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে এই ঘটনার পিছনে অনেক বড় মাপের একটি পরিকল্পনা ছিল আর আওয়ামী লীগের সরকার যে এই ব্যাপারে কিছুই জানে না তা হতে পারে না।
দোষী কে?
যেহেতু ঘটনাগুলি সবই পরস্পরের সাথে যুক্ত তাই হোসেনের মণ্ডপে গিয়ে কোরান রাখা, তারপরে একরাম নামে ৯৯৯ তে ফোন করা, ফয়েজের লাইভ করা, নানা জায়গার থেকে অপরিচিত মুখের দাঙ্গা বাঁধাতে নিয়ে আসা, এবং দাপটের সাথে, বিজিবি ও র্যাবের সামনে, হিংসা করা, ইত্যাদী, প্রমাণ করছে যে এই ঘটনার সাথে সাধারণ মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বা হিন্দুদের কোনো যোগ থাকা সম্ভব নয়।
পুলিশের তদন্ত চলছে আর হয়তো অনেক নতুন তথ্য সামনে আসতে পারে। হয়তো আওয়ামী লীগের চাপে পড়ে পুলিশ পুরো কেসটার গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে পারে। হয়তো আসল অপরাধী কোনোদিনই ধরা পড়বে না বরং কিছু চুনোপুঁটি কে ব্যবহার করে সরকার বাহবা কুড়াবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে।
তবুও বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার জটিল কেসের সমাধানে একটাই সূত্র সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে––এই সাম্প্রদায়িক হিংসায় কার লাভ হয়েছে?
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হিন্দুরা, তাই অবশ্যই সাধারণ হিন্দুরা এই ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন না।
জামাত-এ-ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। গোটা বাংলাদেশে দাঙ্গা করার মতন সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক সাহস দুটোই এদের নেই। আর হঠাৎ দাঙ্গা করে পুলিশী সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার কোনো অভিপ্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই শিবিরের নেতৃত্বের থাকতে পারে না।
বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলো বেশির ভাগ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারে না, তাঁরা দেশজোড়া দাঙ্গা করবে কার সমর্থনে? পুলিশী দমন পীড়ন কী ভাবে আটকাবে?
আওয়ামী লীগ যদি এই হিংসায় মদদ দিয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের ক্ষতি হবে। নৌকা ছাপে ভোট কমে যাবে।আর অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে হিন্দুদের বিশ্বাস ফিরে পেতে শাসক দলের অনেক বেশি সময় লাগবে। তার উপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করুণ চিত্র, সাম্প্রদায়িক হিংসার ছবি, প্রভৃতি দেশের সরকারের পক্ষে অপমানজনক হবে।
রইলো বিদেশী শক্তির ভূমিকা। পাকিস্তান, ভারত আর চীন, বাংলাদেশের উপর সার্বিক প্রভাব বিস্তারের জন্যে এই তিনটি দেশের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে চীন আর ভারতের, এই দেশের রাজনীতিকে নানা ভাবেই প্রভাবিত করে থাকে।
যদি পাকিস্তান আর চীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসা উস্কে দেয় তাহলে বাংলাদেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হলেও, এই দুই দেশের সাথে শীতল সম্পর্ক রাখা হাসিনার সরকার যদি কড়া হাতে এই হিংসা কে দমন করে ফেলতো তাহলে চীন ও পাকিস্তানের কী লাভ হত?
ভারতের শাসক বিজেপি আর তার পিতৃপ্রতীম সংগঠন আরএসএস-এর ক্ষেত্রে কিন্তু সমীকরণটা আলাদা। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নিধনের ঘটনা ভারতে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি কে সাধারণ হিন্দুদের তাঁতিয়ে তুলতে সাহায্য করবে, নিজের ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতে দেবে, আর বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ কে প্রচার করার পথ প্রশস্ত করে দেবে।
একদিকে যেমন উপরোক্ত যতন সাহা হত্যার ভুয়া ভিডিও ছড়াবার ঘটনায় কলকাতার যোগ পাওয়া গেছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ফলে শান্তিপুর উপনির্বাচনে তাঁর দল তিনগুণ বেশি ভোট পাবে।
বাংলাদেশের হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় ভারতের বিজেপি-আরএসএস যেমন দেশভাগের শিকার হওয়া ছিন্নমূল বাঙালি উদ্বাস্তুদের ভয় দেখিয়ে নিজের শিবিরে টেনে রাখতে পারবে, তেমনি আগামী কিছু নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণ কে তীব্র করে সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জেতার চেষ্টা করবে অবাঙালি রাজ্যগুলোয়।
এর সাথেই বিজেপি ও আরএসএস মুসলিম-বিরোধী গণহত্যায় প্ররোচনা দেবে, যার ফলে ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের আরও নিপীড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেল।
ভারতের আরএসএস বা বিজেপির বাংলাদেশে কী প্রভাব আছে?
বাংলাদেশের চাকুরিজীবী, শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে আরএসএস তার বিদেশী সংগঠন হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (এইচএসএস) মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। আরএসএস-এর মতে বাংলাদেশ অখণ্ড, হিন্দি-ভাষী, ব্রাক্ষণত্ববাদী, সাবর্ণ হিন্দু-শাসিত ভারতের অংশ আর তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জমি কে——মুসলিম জনগণ কে বাদ দিয়ে——ভারতের সাথে যুক্ত করার কর্মসূচী বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই সশস্ত্র আধা সামরিক জঙ্গী বাহিনী অনুসরণ করে চলেছে।
আরএসএস-এর অংশ ও ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে শুরু করে ২০০২ সালের গুজরাট মুসলিম নিধন যজ্ঞের সাথে যুক্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) রাজধানী ঢাকার পুরাতন পল্টন অঞ্চলে নিজেদের সদর দফতর থেকে গোটা দেশে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী নীতির প্রচার ও সংগঠনের প্রসার করছে। নানা জায়গায় সালাফীবাদীদের সাথে এদের গোপন আঁতাত তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
হিন্দুদের সংগঠন হিসাবে বাংলাদেশে খ্যাতি লাভ করা হিন্দু মহাজোটের সাথেও আরএসএস-এইচএসএস-এর গোপন আঁতাত নানা ভাবেই প্রকট হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তির বাংলাদেশে মাথাচাড়া দেওয়ার পিছনেও কিন্তু হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সখ্যতার হাত আছে।
ভারতের গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিম-নিধনের কাণ্ডে জনগণের দ্বারা অভিযুক্ত মোদী বাংলাদেশে আসলে, তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হওয়া জনরোষ কে দমন করতে গুলি চালাতেও হাসিনার সরকার কে দুইবার ভাবতে হয়নি। এই সময়ে, তাই বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর চরম আক্রমণ নেমে আসলেও মোদী টু শব্দটি করেননি এবং আরএসএস-এর পুরানো মুখ ও চরম ইসলাম-বিদ্বেষী তথাগত রায় বলেন, হাসিনার সরকার থাকলেই নিরাপদে থাকবেন হিন্দুরা।
ফলে যখন এই ভাবে ভারতের বিজেপি-আরএসএস ও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ হাত মিলিয়ে চলছে, তখন প্রশ্ন হল যদি বাংলাদেশের হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার পিছনে আরএসএস-এর বা এইচএসএস বা ভিএইচপি-র হাত পাওয়া যায়, তাহলে কী ভাবে হাসিনার সরকার জবাবদিহি করবে? নাকি সেই তদন্ত কে ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? আগামী দিনেই এর জবাব পাওয়া যাবে।